ঢাকা ১২:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কী আশায় এসেছিলেন মাহমুদ আব্বাস

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৫২:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
  • ৩৯৫ বার

ঢাকার রাস্তায় ফিলিস্তিন আর বাংলাদেশের পতাকা পাশাপাশি উড়ছে। দৃশ্যটা মনে করাচ্ছে মুক্তিকামী দুই জাতির সংগ্রামী সংহতির ইতিহাসের কথা। এই সংহতির কথা বাংলাদেশের সংবিধানেও আছে, ‘সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ন্যায্য সংগ্রামে বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষকে সহায়তা’র প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে।

মার্কিন লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ১৯৮৮ সালের এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ‘৮ হাজার বাংলাদেশি যুবক ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার (পিএলও) হয়ে যুদ্ধ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হয়েছিল’। ১৯৮১ ও ১৯৮৭ সালে ইয়াসির আরাফাত ঢাকায় এসে বাংলাদেশিদের ফিলিস্তিনের সংগ্রামে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৯৮০ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধার ছবি দিয়ে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

মার্কিন ওই প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের বাংলাদেশে সামরিক প্রশিক্ষণ পাওয়ার কথাও বলা আছে। ১৯৮২ সালে ইসরায়েলের বৈরুত দখলের প্রাক্কালে ব্রিটিশ যুদ্ধ-সাংবাদিক ক্রিস স্টিল-পার্কিন্স ভূমধ্যসাগর তীরে একদল বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধার ছবি তুলেছিলেন। ওই যুদ্ধে নিহত বাংলাদেশি যোদ্ধাদের একজন কামাল মোস্তফা আলী। লেবাননের শাতিলা শরণার্থীশিবিরের ফিলিস্তিনি শহীদদের পাশে তার কবর। কবরের সমাধিফলকে আরবিতে লেখা ‘বীরোচিত শহীদ’।

ফিলিস্তিনের পক্ষে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন আরেক বাংলাদেশি গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে তিনি জর্ডানি ও ইরাকি বিমানবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেন। তখন তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। আরবে তখন সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের স্বর্ণযুগ। কয়েকটি আরব দেশের অনুরোধে পাকিস্তান জর্ডান, সিরিয়া, ইরাক ও মিসরে তাদের বিমানবাহিনীর কিছু সদস্যকে মোতায়েন করে। সাইফুল আজম মাত্র দুটি আকাশযুদ্ধে তিনটি ইসরায়েলি জঙ্গিবিমান ধ্বংস করেন। আজ পর্যন্ত এককভাবে সর্বাধিক ইসরায়েলি বিমান ধ্বংসের রেকর্ড তারই। জর্ডান, ইরাক তাকে সম্মাননা দিলেও সর্বোচ্চ উপাধি দিয়েছে মার্কিন বিমানবাহিনী। তিনি বিশ্বের ২২ জন ‘লিভিং ইগলস’ খেতাবধারী বিমানসেনার একজন।

সাইফুল আজম ১৯৭৯ সালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে অবসর নেন। দুঃখের কথা, এই বাংলাদেশি তরুণেরা আগে যেতেন ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়াই করতে। এখন সেসব তরুণের অনেকেই বিভ্রান্তির শিকার। কেউ কেউ যান আইএসে যোগ দিতে, যার কার্যকলাপ শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলকেই সাহায্য করছে।

দুই জাতির এই সংহতি কোনো কাকতালীয় ব্যাপারও নয়, নিছক ধর্মীয় কারণেও নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ১৯৭১ সালের বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের

মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে যেসব মূল্যবোধ, মূলনীতি ও আদর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে, ফিলিস্তিনের জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামে দৃঢ় সংহতি জানাতে সেগুলোই আমাদের পথ দেখায়।’

(বিডিনিউজ২৪.কম, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫) যে ৩৬টি দেশ আজ অবধি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি তার মধ্যে মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশও যেমন আছে, তেমনি আছে অমুসলিম ভুটান, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, নিকারাগুয়ার মতো দেশও। ১৯৬৭ সালের আগের সীমান্তের ভিত্তিতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি বাংলাদেশ অবিচলভাবে সমর্থন করে।

এদিকে পৃথিবীতে এখন ট্রাম্প-যুগ চলছে। তিনি যেখানে হাত দেবেন সেটা ভন্ডুল হবে না, তা কি হয়? ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন তিনি ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নিয়ে যাবেন। এটা করা মানে ইসরায়েলের জেরুজালেমের অবৈধ দখল সম্পূর্ণ হওয়া। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়েরই স্বপ্ন পবিত্র জেরুজালেম নগরীকে নিজ নিজ রাজধানী করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান হলো, ‘পূর্ব জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা…’।

জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কেবলা ছিল। এখন এটি মক্কা ও মদিনার পর তৃতীয় পবিত্র পুণ্যভূমি। মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরানোর অর্থ আন্তর্জাতিকভাবে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকার করা। তাই ট্রাম্প যদি সত্যিই এটা করেন তাহলে এমনিতেই নারকীয় অবস্থার শিকার মধ্যপ্রাচ্য নতুন করে জ্বলে উঠবে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, জেরুজালেম চিরকালই ইসরায়েলের রাজধানী ছিল এবং থাকবে। দখলদার ও যুদ্ধবাজরা ইতিহাসের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক স্লোমো স্যান্ড দ্য ইনভেনশন অব জুয়িশ পিপল নামক গবেষণাগ্রন্থে দাবি করেছেন, ৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইহুদিদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়নের ঘটনা অসত্য।

তিনি ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন আদি ইসরায়েলি হিব্রু জাতির বর্তমান বংশধর ইসরায়েলি ইহুদিরা নয়। বরং খোদ ফিলিস্তিনি মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ই বাইবেলে বর্ণিত হিব্রু জাতির উত্তরাধিকারী। ডিএনএ বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন ইসরায়েলের ইহুদিরা আদতে এক জাতিও নয়, একই উৎস থেকে তারা আসেওনি।

বাইবেলের যুগে ফিলিস্তিন থেকে ইহুদিদের নির্বাসিত হওয়ার মিথটিরও কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। আজকের ইহুদিদের বেশির ভাগই পূর্ব ইউরোপের খাজারীয় জাতি থেকে আসা আশকেনাজি জনগোষ্ঠীর লোক। তারা ইতিহাসের কোনো একপর্যায়ে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
মানে দাঁড়াল, ইউরোপীয় ইহুদিদের দিয়ে আরব ভূমিতে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার কোনো ঐতিহাসিক ও যৌক্তিক ভিত্তি নেই। এই মিথের আড়ালে সত্য নেই, রয়েছে আগ্রাসী ভূরাজনৈতিক প্রকল্প।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনোই জেরুজালেমে ইসরায়েলের দখলদারি মেনে নেয়নি। সম্প্রতি প্যারিসের শান্তি সম্মেলনেও সেই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করা হলে তা ‘খুবই গুরুতর পরিণতি’ ডেকে নিয়ে আসবে। এর অর্থ হলো, শান্তিপ্রক্রিয়া এবং সেই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দুইয়েরই অবসান। ইতিমধ্যে চীন-রাশিয়াও ফিলিস্তিনের পক্ষে মতামত জানিয়েছে।

কার্যত আরব শান্তি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের মাতব্বরি খর্ব করেছে রাশিয়া, চীন ও ইইউ। ওদিকে আরব গণমাধ্যম তৃতীয় ইন্তিফাদার (অভ্যুত্থান) আলামত দেখতে শুরু করেছে। ইসরায়েলের ২১ শতাংশ আরব (বেশির ভাগ মুসলিম এবং কিছু অংশ খ্রিষ্টান) এবং ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানরাও জেরুজালেমের ইহুদীকরণ ও ইসরায়েলীকরণ মেনে নেবে না। যে আরব রাষ্ট্রগুলো এখন ইসরায়েল তোষণ করে চলছে, তাদের শাসকেরাও নিজ জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়বে। ট্রাম্প প্রশাসনের কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণার পর জেরুজালেম নিয়ে নয়ছয় করা মানে সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।

এ রকম এক জ্বলন্ত সময়ে মাহমুদ আব্বাস ঢাকা সফর করেছেন। বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের শীর্ষ কূটনীতিক বলেছেন, এই সফর ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’। এই সফরে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের অংশ। এই জোটের লক্ষ্য মূলত ইরানকে মোকাবিলা করা। কিন্তু জেরুজালেম প্রশ্নে বাংলাদেশের কী নীতি ও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? এর উত্তরের জন্য আমাদের হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ফিলিস্তিনে আবু মাজেন নামে পরিচিত মাহমুদ আব্বাস যে কিছু একটা আশা করে এসেছিলেন, তা পরিষ্কার। বাংলাদেশ তার মিত্রদের নিয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে জাতিসংঘে জোরালো অবস্থান নিতে পারে।

শেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচভ সম্প্রতি বলেছেন, পৃথিবী আবার এক মহাযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। অবশ্যম্ভাবীভাবে সেই যুদ্ধের বড় এক মঞ্চ মধ্যপ্রাচ্য। এ অবস্থায় শতাব্দীর দীর্ঘতম স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মাহমুদ আব্বাস দেশ থেকে দেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন। ফিলিস্তিনিরা আরাফাতকে বলত আবু আমর। আর আব্বাসের অন্য নাম আবু মাজেন। আমরা তার সাফল্য কামনা করি।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক। প্রথম আলো

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

কী আশায় এসেছিলেন মাহমুদ আব্বাস

আপডেট টাইম : ১১:৫২:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

ঢাকার রাস্তায় ফিলিস্তিন আর বাংলাদেশের পতাকা পাশাপাশি উড়ছে। দৃশ্যটা মনে করাচ্ছে মুক্তিকামী দুই জাতির সংগ্রামী সংহতির ইতিহাসের কথা। এই সংহতির কথা বাংলাদেশের সংবিধানেও আছে, ‘সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ন্যায্য সংগ্রামে বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষকে সহায়তা’র প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে।

মার্কিন লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ১৯৮৮ সালের এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ‘৮ হাজার বাংলাদেশি যুবক ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার (পিএলও) হয়ে যুদ্ধ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হয়েছিল’। ১৯৮১ ও ১৯৮৭ সালে ইয়াসির আরাফাত ঢাকায় এসে বাংলাদেশিদের ফিলিস্তিনের সংগ্রামে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৯৮০ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধার ছবি দিয়ে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

মার্কিন ওই প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের বাংলাদেশে সামরিক প্রশিক্ষণ পাওয়ার কথাও বলা আছে। ১৯৮২ সালে ইসরায়েলের বৈরুত দখলের প্রাক্কালে ব্রিটিশ যুদ্ধ-সাংবাদিক ক্রিস স্টিল-পার্কিন্স ভূমধ্যসাগর তীরে একদল বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধার ছবি তুলেছিলেন। ওই যুদ্ধে নিহত বাংলাদেশি যোদ্ধাদের একজন কামাল মোস্তফা আলী। লেবাননের শাতিলা শরণার্থীশিবিরের ফিলিস্তিনি শহীদদের পাশে তার কবর। কবরের সমাধিফলকে আরবিতে লেখা ‘বীরোচিত শহীদ’।

ফিলিস্তিনের পক্ষে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন আরেক বাংলাদেশি গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে তিনি জর্ডানি ও ইরাকি বিমানবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেন। তখন তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। আরবে তখন সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের স্বর্ণযুগ। কয়েকটি আরব দেশের অনুরোধে পাকিস্তান জর্ডান, সিরিয়া, ইরাক ও মিসরে তাদের বিমানবাহিনীর কিছু সদস্যকে মোতায়েন করে। সাইফুল আজম মাত্র দুটি আকাশযুদ্ধে তিনটি ইসরায়েলি জঙ্গিবিমান ধ্বংস করেন। আজ পর্যন্ত এককভাবে সর্বাধিক ইসরায়েলি বিমান ধ্বংসের রেকর্ড তারই। জর্ডান, ইরাক তাকে সম্মাননা দিলেও সর্বোচ্চ উপাধি দিয়েছে মার্কিন বিমানবাহিনী। তিনি বিশ্বের ২২ জন ‘লিভিং ইগলস’ খেতাবধারী বিমানসেনার একজন।

সাইফুল আজম ১৯৭৯ সালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে অবসর নেন। দুঃখের কথা, এই বাংলাদেশি তরুণেরা আগে যেতেন ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়াই করতে। এখন সেসব তরুণের অনেকেই বিভ্রান্তির শিকার। কেউ কেউ যান আইএসে যোগ দিতে, যার কার্যকলাপ শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলকেই সাহায্য করছে।

দুই জাতির এই সংহতি কোনো কাকতালীয় ব্যাপারও নয়, নিছক ধর্মীয় কারণেও নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ১৯৭১ সালের বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের

মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে যেসব মূল্যবোধ, মূলনীতি ও আদর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে, ফিলিস্তিনের জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামে দৃঢ় সংহতি জানাতে সেগুলোই আমাদের পথ দেখায়।’

(বিডিনিউজ২৪.কম, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫) যে ৩৬টি দেশ আজ অবধি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি তার মধ্যে মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশও যেমন আছে, তেমনি আছে অমুসলিম ভুটান, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, নিকারাগুয়ার মতো দেশও। ১৯৬৭ সালের আগের সীমান্তের ভিত্তিতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি বাংলাদেশ অবিচলভাবে সমর্থন করে।

এদিকে পৃথিবীতে এখন ট্রাম্প-যুগ চলছে। তিনি যেখানে হাত দেবেন সেটা ভন্ডুল হবে না, তা কি হয়? ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন তিনি ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নিয়ে যাবেন। এটা করা মানে ইসরায়েলের জেরুজালেমের অবৈধ দখল সম্পূর্ণ হওয়া। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়েরই স্বপ্ন পবিত্র জেরুজালেম নগরীকে নিজ নিজ রাজধানী করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান হলো, ‘পূর্ব জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা…’।

জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কেবলা ছিল। এখন এটি মক্কা ও মদিনার পর তৃতীয় পবিত্র পুণ্যভূমি। মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরানোর অর্থ আন্তর্জাতিকভাবে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকার করা। তাই ট্রাম্প যদি সত্যিই এটা করেন তাহলে এমনিতেই নারকীয় অবস্থার শিকার মধ্যপ্রাচ্য নতুন করে জ্বলে উঠবে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, জেরুজালেম চিরকালই ইসরায়েলের রাজধানী ছিল এবং থাকবে। দখলদার ও যুদ্ধবাজরা ইতিহাসের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক স্লোমো স্যান্ড দ্য ইনভেনশন অব জুয়িশ পিপল নামক গবেষণাগ্রন্থে দাবি করেছেন, ৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইহুদিদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়নের ঘটনা অসত্য।

তিনি ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন আদি ইসরায়েলি হিব্রু জাতির বর্তমান বংশধর ইসরায়েলি ইহুদিরা নয়। বরং খোদ ফিলিস্তিনি মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ই বাইবেলে বর্ণিত হিব্রু জাতির উত্তরাধিকারী। ডিএনএ বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন ইসরায়েলের ইহুদিরা আদতে এক জাতিও নয়, একই উৎস থেকে তারা আসেওনি।

বাইবেলের যুগে ফিলিস্তিন থেকে ইহুদিদের নির্বাসিত হওয়ার মিথটিরও কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। আজকের ইহুদিদের বেশির ভাগই পূর্ব ইউরোপের খাজারীয় জাতি থেকে আসা আশকেনাজি জনগোষ্ঠীর লোক। তারা ইতিহাসের কোনো একপর্যায়ে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
মানে দাঁড়াল, ইউরোপীয় ইহুদিদের দিয়ে আরব ভূমিতে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার কোনো ঐতিহাসিক ও যৌক্তিক ভিত্তি নেই। এই মিথের আড়ালে সত্য নেই, রয়েছে আগ্রাসী ভূরাজনৈতিক প্রকল্প।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনোই জেরুজালেমে ইসরায়েলের দখলদারি মেনে নেয়নি। সম্প্রতি প্যারিসের শান্তি সম্মেলনেও সেই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করা হলে তা ‘খুবই গুরুতর পরিণতি’ ডেকে নিয়ে আসবে। এর অর্থ হলো, শান্তিপ্রক্রিয়া এবং সেই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দুইয়েরই অবসান। ইতিমধ্যে চীন-রাশিয়াও ফিলিস্তিনের পক্ষে মতামত জানিয়েছে।

কার্যত আরব শান্তি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের মাতব্বরি খর্ব করেছে রাশিয়া, চীন ও ইইউ। ওদিকে আরব গণমাধ্যম তৃতীয় ইন্তিফাদার (অভ্যুত্থান) আলামত দেখতে শুরু করেছে। ইসরায়েলের ২১ শতাংশ আরব (বেশির ভাগ মুসলিম এবং কিছু অংশ খ্রিষ্টান) এবং ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানরাও জেরুজালেমের ইহুদীকরণ ও ইসরায়েলীকরণ মেনে নেবে না। যে আরব রাষ্ট্রগুলো এখন ইসরায়েল তোষণ করে চলছে, তাদের শাসকেরাও নিজ জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়বে। ট্রাম্প প্রশাসনের কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণার পর জেরুজালেম নিয়ে নয়ছয় করা মানে সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।

এ রকম এক জ্বলন্ত সময়ে মাহমুদ আব্বাস ঢাকা সফর করেছেন। বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের শীর্ষ কূটনীতিক বলেছেন, এই সফর ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’। এই সফরে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের অংশ। এই জোটের লক্ষ্য মূলত ইরানকে মোকাবিলা করা। কিন্তু জেরুজালেম প্রশ্নে বাংলাদেশের কী নীতি ও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? এর উত্তরের জন্য আমাদের হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ফিলিস্তিনে আবু মাজেন নামে পরিচিত মাহমুদ আব্বাস যে কিছু একটা আশা করে এসেছিলেন, তা পরিষ্কার। বাংলাদেশ তার মিত্রদের নিয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে জাতিসংঘে জোরালো অবস্থান নিতে পারে।

শেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচভ সম্প্রতি বলেছেন, পৃথিবী আবার এক মহাযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। অবশ্যম্ভাবীভাবে সেই যুদ্ধের বড় এক মঞ্চ মধ্যপ্রাচ্য। এ অবস্থায় শতাব্দীর দীর্ঘতম স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মাহমুদ আব্বাস দেশ থেকে দেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন। ফিলিস্তিনিরা আরাফাতকে বলত আবু আমর। আর আব্বাসের অন্য নাম আবু মাজেন। আমরা তার সাফল্য কামনা করি।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক। প্রথম আলো