কমে আসছে খেজুর গাছিদের ছুটাছুটি

এক সময় শীতের আগমনী বার্তা গায়ে পৌঁছার আগেই কুমিল্লার গ্রামে গঞ্জের আনাচে কানাচে ছুটাছুটি করতে দেখা যেত খেজুর গাছিদের আনা গোনা। মাটির তৈরি ছোট কলস, দৃষ্টি নন্দন মোড়ানো দড়ি আর দেশিয় তৈরি করাত নিয়ে বাড়ি বাড়ি তাদের নানান সুরের গান শোনা যেত। ‘খেজুর গাছের রস পাড়ি, খাবেন গিয়ে মামার বাড়ি, নতুন জামাই আসলে ঘরে, নয়া রস খাওয়াবেন তবে’ এরকম নানা গান ইনিয়ে বিনিয়ে খেজুর গাছের মালিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। যাতে নিজের গাছের রস কুড়ানোর দায়িত্বটি তাকে দেয়া হয়। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে কুমিল্লায় কমে আসছে খেজুর গাছের সংখ্যাও। এখন আর গাছিদের ছোটাছোটির দৃশ্য চোখে পড়ে না। গ্রামের রাস্তার আশে-পাশে পাহাড়ে সারি সারি খেজুর গাছ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। বিকেল বেলা গাছ কাঁটা গাছে হাড়ি দিয়ে যেতো গাছিরা। সকালে সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গেই রস আহরণ করে গাছ থেকে নামতো। অনেক হাড়ি ভর্তি হয়ে রস গাছের নিচে পড়ে রসে ভিজে থাকতো ওই গাছের নিচের জায়গা। এখন আর ওই দৃশ্য মিলে না। হাট বাজারে বিক্রয় হতো খেজুরের রস। এখন খেজুর গাছকে লাভনজক মনে না হওয়ায় এখন গৃহস্তরা নানা কাঠ বা অন্য ফল গাছের দিকে ঝুঁকছে। তারপরও কুমিল্লার ১৬ উপজেলার নানা প্রান্তে জুড়ে আছে অসংখ্য খেজুর গাছ। আগের চেয়ে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি কমে আসছে গাছিদের সংখ্যাও। যারা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে দেয় তাদেরকে বলা হয় গাছি। খেজুরের রস দিয়ে শীতের সময়ের নানা পীঠা পায়েস এখনো কুমিল্লার তথা সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
খেজুরের রস একটি মুখ রোচক পানীয় খাবার। এই রস চুলায় জাল দিয়ে তৈরি করা হয় গ্রামের ভাষায় রাব বা আধরশী। আবার এই রস দিয়ে তৈরি করা হয় মুছি গুর যা দেখতে সুন্দর এবং খেতেও ভারি মজা।
এক সময় হাট বাজারে বিক্রয় হতো খেজুরের রস। এই মৌসুমে আমন ধান কাঁটার পড় এই ধানের চাল থেকে চালের আটা এই রস দিয়ে হরেক রকমের পিঠা-পায়েস তৈরি করতো। অনেকে আবার মেয়ের জামাইকে দাওয়াত দিয়ে পিঠা-পায়েসের আপ্যায়ন করতো। তাও এখন আর চোখে পড়ে না। আগে ভোর বেলা পাখির কিচির-মিচিরের পড় গাছিরা হাড়িতে করে রস বিক্রি করার জন্য মুখে শব্দ করে বলতেন খেজুরের রস রাখবেন। এখন আর গাছিদের ওই শব্দ আর শোনা যায় না। তেমনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সালমানপুর এলাকা জুনাব আলীর ছেলে গাছি মফিজ বলেন , আমার পূর্ব পুরুষ থেকে বাবা-দাদারা গাছির কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। আমি বর্তমানে ২৪ টি খেজুর গাছে ঘটি দেই। এই গাছগুলো থেকে প্রতিদিন ৬০-৭০ কেজি রস সংগ্রহ করি। ২০ কেজি রস চুরি হয়। প্রতি কেজি রস ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি করি। মৌসুমী রস বিক্রি করে ৫০-৬০ হাজার টাকা উপার্জন করি। মাঝে মাঝে খেজুর গাছে ঘটি দিতে পারি না, কারণ স্বাস্থ্য ভাল থাকে না। এলাকার এইসব গাছিরা কাজের সঙ্গে জড়িত নেই কেউ। তাই দিন দিন এই গাছিদের কাজ ধ্বংসের পথে। তেমনি বাগমারা রায়পুর এলাকার মো. হোসেন হৃদয় জানান দীর্ঘ কয়েক বছর খেজুরের রস খেতে পারছিনা। তাই মনে খুব আপসোস কারণ একটাই এলাকায় খেজুর গাছ আছে বটে কিন্তু গাছির অভাবে খেজুরের রস সংগ্রহ করা যাচ্ছে না।
কয়েকজন গাছির সঙ্গে আলাপ করে জানা জানায়, গাছ কেটে ঘটি দিয়ে রস সংগ্রহ করে গাছের মালিককে দিয়ে আগে যে টাকা উপার্জন হতো এখন তা অর্ধেক নেমে এসেছে। আবার এখন গাছের সংখ্যাও কম। তাই বর্তমানে হারাতে বসেছে শীতের ভোরে গাছিদের পদচারণা।
গাছিদের বক্তব্য, এখন মানুষ যে ভাবে অন্য ফলের গাছ লাগানোর ঝোঁক কিন্ত খেজুর গাছ লাগানোর প্রতি এখন আর তেমন আগ্রহ দেখি না। গাছি কমে যাওয়া এটাও একটা কারণ বলে তারা জানান। খেজুর রসের ঐতিহ্য ফিরে আনতে হলে পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানোর দিকে নজর দিতে হবে বলে জানান গাছিরা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর