সাত দশকের বেশি সময় কেটে গেছে, ৭৩ বছর! এর মধ্য ইউরোপ আর এশিয়ায় কত যুদ্ধ হয়েছে, দেশে দেশে মানুষের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম হয়েছে, প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে কিংবা রক অ্যান্ড রোল যুগের উত্থান ঘটেছে। যত ঝড়-ঝাপ্টাই যাক, এই দম্পতি এই সুদীর্ঘ সময় ধরে এক বিছানা শেয়ার করেছেন।
অনেক সময়ই বাড়ি থেকে দূরে থাকতে হয়েছে জর্জ মরিসকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে ছুটে যেতে হয়েছে। কিন্তু সব সময় বাড়ি ফিরেছেন প্রিয়তমা স্ত্রী ইলোইসের কাছে। অবসরপ্রাপ্ত আর্মি কর্নেল জর্জ মোরিস কখনো স্ত্রীকে ফেলে চলে যাননি।
কিন্তু এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন জর্জ। কথাও বলতে পারেন না ঠিকমতো। ফোর্ট বেলভয়ের কমিউনিটি হসপিটালের বিছানায় জীবনের শেষ সময় কাটাচ্ছেন ৯৪ বছর বয়সী সাবেক সেনা। তার সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়েছে স্ত্রীকে। জর্জের স্ত্রী ইলোইসের বয়স এখন ৯১ বছর। ক্যান্সার থেকে বেঁচে গিয়েছেন তিনি। পরে কোমর ও কাঁধের হাড় ভেঙেছে দুই বার। তাকে শুতে দেওয়া হয়েছে স্বামীর সঙ্গে। শুধু তাই নিয়, তাদের দুজনের বিছানাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
দুজনকে এক করতে বিশেষ কৌশল নিয়েছে হাসপাতাল। দুজনকেই ভর্তি করেছেন রোগী হিসাবে। এটাকে আবেগতাড়িত ভর্তি বলে মন্তব্য করেছেন এক চিকিৎসক। টিনএজ বয়সে এই দুজন এক হয়েছিলেন কেন্টাকির এক প্রত্যন্ত গ্রামে, সেই ১৯৩০ সালে। এখন এই হাসপাতালে জীবনে শেষ কটা দিন কেন আলাদা থাকবেন? হাসাপাতালের বিশেষ ব্যবস্থায় আবারো এক হয়েছেন তারা।
ইলোইস জানান, হাই স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম আমি। আরকটি স্কুলে খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানেই সে (জর্জ) আমাকে দেখে। সে বাড়িতে গিয়ে তার মাকে আমার কথা জানায়। আমি যে মেয়েটিকে দেখেছি তাকে বিয়ে করতে চাই- এভাবেই মাকে মনের কথা জানায় সে। আরো জানায়, আমি তাকে ভালো করে দেখেছি। তার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই কেবল একটা বাঁকা দাঁত ছাড়া।
পরে ভালোবাসা শুরু হয়। একটি সিনেমা দেখতে যান দুজন। ছবির নাম মনে নেই ইলোইসের। অন্ধকারে দুজন হাত ধরে ছবি দেখেছিলেন তারা। এক পিকনিক করেছিলেন। এর কথা কখনো ভোলার নয়। সেখানে পেছনে হাত লুকিয়ে কিছু একটা আনলো জর্জ। ওটা ছিল একটা ছোট ফোনোগ্রাফ। ওটায় বেজে উঠলো ‘সুইট ইলোইস’ গানটি। সেই সময় দারুণ জনপ্রিয় এক গান।
কলাম্বিয়ায় থাকতেন জর্জ। আট মাইল দূরে রাসেল স্প্রিংস-এ থাকতেন ইলোইস। গাড়ি ছিল না, তাই পায়ে হেঁটে ইলোইসকে দেখতে আসতেন জর্জ। মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রেমিকার হাতে আঙটি পরিয়ে দেন জর্জ। তার ছিল পাতলা ভ্রূ আর দুষ্টুমিভরা চোখ। আমার চোখে সে ছিল দারুণ সুদর্শন এক যুবক। আমার মনে হতো, সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে মেধাবী মানুষ, যা আগে কখনো দেখিনি আমি।
বিয়ে হয় তাদের। দুটো সন্তান হয় তাদের। টকিও ও আলাস্কা ঘুরে অবশেষে ভার্জিনিয়ায় স্থির হন।
সেই বিখ্যাত ভ্রূ-জোড়া এখন ধূসর হয়ে পড়েছে। চোখ জোড়া প্রায় বন্ধ থাকে। ইলোইস কথা বলামাত্র জর্জের কণ্ঠ থেকে কিছু বেরোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে শব্দ স্পষ্টতা পায় না।
ইলোইস বলেন, আমাদের খুব যে আনন্দে সময় কেটেছে তা নয়। কিন্তু আমাদের সময়গুলো বেশ উপভোগ্য ছিল। আমাদের অনেক কিছু ছিল না। কিন্তু মিষ্টি মুহূর্ত ছিল। আমাদের চারদিকে অনেক অনেক ভালোবাসা বিরাজ করতো।
জন্মের আগেই ইলোইসের মাকে ছেড়ে চলে যান বাবা। মায়ের সঙ্গেই থাকতেন। নানীর গরু-ভেড়া আর মুরগির দেখাশোনা করতেন।
আকাশের সেনা যে মানুষ, তার স্ত্রী হওয়া সত্যিই চ্যালেঞ্জিং। একবার জর্জ পি-৫১ মাসট্যাং ফাইটার প্লেনে করে ইলোইসকে ওড়ান। সেখানে তিনি স্ত্রীকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন। বিমানটি যখন ঘোরাচ্ছিলেন, ভয়ে তখন ইলোইসের প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
জর্জের অনেক বন্ধু ছিল যাদের অনেকেই যুদ্ধ থেকে ফিরে আসেনি। একটা কষ্টের কথা বলতেন জর্জ, জানা ইলোইস। সে সব সময় বলতো, আমি মৃত সেনাদের নিয়ে বাড়িতে ফিরি। এটা ছিল তার সেরা কষ্টের একটা। খুব কম বয়সে সেনারা মারা যেত। জর্জ ১৯৭০ সালে অবসর নেন।
সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে এত সুখী থাকার রহস্য কি? সুখী থাকতে হবে। সুখী থাক বা নাই থাক, হাসতে হবে। এভাবেই রহস্যের জানান দিলেন স্ত্রী।
চিকিৎসরা বলেছেন, বার্ধক্যজনিত বেশ কিছু সমস্যায় ভুগছেন জর্জ। এই দুজনকে যতটা সম্ভব ভালো রাখার চেষ্টা করছেন তারা।
ইলোইসের জন্য এখনো জর্জকে এ অবস্থায় দেখাটা কষ্টের বিষয়। বলেন, একজন সবকিছু হারাচ্ছে দেখাটা সত্যিই কষ্টের।
কিন্তু স্ত্রীর অবস্থান তাকে অনেক শান্তি দিচ্ছে বলেই মনে হয়। ইলোইস জানান, সে ঘুমের মধ্যে কথা বলার চেষ্টা করে। আমি তার গায়ে হাত রাখি আর সে চুপ হয়ে যায়। দিনের বেলায় ইলোইস তার সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু তিনি কিছু শোনেন কিনা তা বোঝা যায় না।
মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়েন ইলোইস। তখন তিনি জর্জের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। তার হাত ধরার চেষ্টা করেন। তাদের দুই হাত এক হয়ে যায়, তারা শিরা-উপশিয়ায় এক হয়ে যান। সূত্র:
বেঙ্গলি টাইমস