সু চি, আপনার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাও আর অবশিষ্ট নেই

মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের যেভাবে অমানবিক নিপীড়নের মাধ্যমে জাতিসত্ত্বাগতভাবে নিশ্চিহ্ন (ethnic cleansing) করার প্রক্রিয়া চলছে, তাকে ‘গণহত্যা’ বললেও কম বলা হয়। সেখানে একাধারে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে কুপিয়ে-পিটিয়ে-পুড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে, নারী-শিশুদের — করা হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি-স্কুল-মসজিদ-দোকানপাট পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, তাদের সম্পদ লুন্ঠন করা হচ্ছে, রোহিঙ্গা এলাকায় পরিকল্পিতভাবে খাদ্য-সঙ্কট সৃষ্টি করা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে জঙ্গলে বা নদীতে, না হয় প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে-যে বিষয়টাকে এক কথায় বলতে গেলে ‘মানবতা-বিরোধী অপরাধ’ বলতে হবে।

এই পরিস্থিতিতে আমরা সবাই আশা করেছিলাম, তিনি গর্জে উঠবেন। মানবতার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু না, তিনি বিশ্ববিবেককে হতবাক করে নীরব ভূমিকা পালন করলেন। অশান্ত অবস্থা সম্পর্কে মাত্র দু’একটা মন্তব্য খরচ করেছেন, তা-ও পাশ কাটানো। তিনি মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী অং সাং সুচি। গত বছর নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে তার দলের জয়ের পরে কাগজেকলমে সরকার তিনিই চালাচ্ছেন। মায়ানমার দীর্ঘদিন ছিল সরাসরি সামরিক বাহিনীর দখলে।

বিশেষ করে ১৯৮৮ সাল থেকে ফৌজি নায়কদের বজ্র আঁটুনি চেপে বসেছিল। ২০১১ সালে পরিস্থিতি একটু বদলায়, ক্ষমতায় আসে আধা-সামরিক সরকার। তার দেশের নিপীড়িত মানুষকে গণতন্ত্রহীনতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবেন বলেই সু চি আন্দোলন করেছেন, গৃহবন্দি থেকেছেন টানা পনেরো বছর। তিনিই সেই মহামানবী, যার ভরসার আঁচল ধরতে চেয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। অথচ, নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তিনি এত উদাসীন! তারা কি নিপীড়িত নন? তারা কি দেশের মানুষ নন? এই শেষ প্রশ্নটিই অমোঘ।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন, তারা বাঙালি, রিফিউজি-মনে করে এসেছে মিয়ানমারের সামরিক ও আধা-সামরিক সরকার, আর এখন মনে করছে সু চি-র সরকার। ফলে মানবাধিকারের বিশ্ববন্দিত প্রতিমা সু চি’র হৃদয়ের উষ্ণতার বাইরে রোহিঙ্গারা। তারা বেওয়ারিশ।

অন্য সরকার কী করেছে, কী করেনি, সে প্রশ্ন থাক। কিন্তু সু চি-র সরকার থাকাকালীন এমন মানবতা-বিরোধী কাজ হয়েই চলেছে, আর তিনি মৌনী! সু চি-র আজীবন লড়াই ছিল মানবাধিকারের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য। অন্তত বিশ্ববাসী তা-ই জেনে এসেছিল। আমরাও তাই জেনেছি। জেনেছি বলেই তাকে প্রণাম করেছি। শ্রদ্ধায় ভক্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে তার মুক্তির জন্য

ঢাকার রাজপথে স্লোগান দিয়েছি।

তার নোবেল জয়ে আনন্দিত হয়েছি। মিষ্টিমুখ করেছি। তার সেই লড়াই যে কেবল বাছাই সংখ্যগরিষ্ঠদের জন্য, এমনটা তো আমরা জানতাম না। অথচ তিনি যে কেবল রোহিঙ্গাদের উপর গণ-অত্যাচারের সামনে নীরব থেকেছেন তা-ই নয়, যে কয়েকটি মন্তব্য করেছেন তাতে স্পষ্ট যে, তিনি রোহিঙ্গাদের সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারবাসীর কাছে, এমনকী তার দলের লোকজনের কাছেও অপ্রিয় হতে চান না।

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজেতা সু চি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা তো বাঙালি। ওরা আদৌ এ দেশের নাগরিক কি না দেখতে হবে।’ আরও বলেছেন, ‘ওদের প্রতি যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা আইনসঙ্গত।’ দেখতে হবে? হে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী অং সাং সুচি, দেখতে হবে? আপনি কি এত দিন তা হলে বেছে বেছে মানবাধিকারের লড়াই লড়ছিলেন? মানবাধিকারের প্রথম কথাই তো হল, যে কোনো পরিচয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রতিটি মানুষ, কেবল মানুষ হিসেবেই কিছু মৌলিক অধিকার পাওয়ার যোগ্য! ভেদাভেদ বিচার করে তো মানবাধিকারের হয় না! এ আপনি কী বললেন!

আর আইন? এই গণ-অত্যাচার যদি মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী হয়, তা হলে তো সবার আগে আপনার উচিত আইন-অমান্য আন্দোলন করা। গান্ধীজি ব্রিটিশ রাজের আইন অমান্য করেছিলেন, কারণ তার মতে আইনটাই অন্যায় ছিল। গোড়ায় নাড়া দিয়েছিলেন গান্ধীজি। কিন্তু আপনি পারলেন না কেন? তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন হারানোর ঝুঁকি আছে, তাই? হয়তো আমরাই বুঝতে পারিনি, প্রথম থেকেই আপনি লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে।

নির্বাচনের আগে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার সম্পর্কে নীরব থাকার সময় আপনি যা বলেছিলেন তার অর্থ-রোহিঙ্গাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ দেখতে গেলে গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে। আপনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘুদের সমস্যা ভাল করে বিচার করে দেখবেন এবং সুরাহা করতে পারবেন। এখন আপনি ক্ষমতায়। রোহিঙ্গাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ দেখার সময়, অবকাশ, মন ও সাহস-কোনোটাই আপনি জুটিয়ে উঠতে পারেননি। বরং স্বর আরও নামিয়েছেন। বলেছেন, ‘মিয়ানমারের মতো দেশে অন্যায়-অত্যাচার এত তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’ রোহিঙ্গা প্রশ্নে এই নীরবতা এবং নিষ্ক্রিয়তাই তবে আপনার ধর্ম? বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিনি নীরব ছিলেন ক্ষমতা না পাওয়ার ভয়ে, এখন তিনি ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আবার নিষ্ক্রিয়?
তা হলে আপনি কেমন নেত্রী! নোবেল শান্তি কমিটি আপনাকে বলেছিলেন, ‘ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা’। কিন্তু বাস্তবে আপনি ক্ষমতাশীলের হাতের পুতুল হয়ে ক্ষমতাহীনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়লেন! অথচ সারা বিশ্ব আপনাকে বন্দনা করে এসেছে নিপীড়িত মানুষের প্রতিভূ হিসেবে। আশায় থেকেছে, যে দিন আপনি ক্ষমতায় আসবেন, মানুষের দুঃখদুর্দশা কমতে আরম্ভ করবে। কিন্তু সেই মানুষের মধ্যে যে তার স্বদেশের সংখ্যালঘুদের স্থান হবে না, এমন কথা তো ছিল না!

মায়া হয় সু চি-র জন্য। সত্যিকারের নেত্রী হওয়ার সুযোগ ছেড়ে, হলেন স্রেফ এক রাজনীতিবিদ? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়ে গণতন্ত্রের সঙ্গেই দ্বিচারিতা করলেন? সংখ্যালঘুদের দূরে ঠেলে দিয়ে সংখ্যাগুরুদের তুষ্ট করে শাসন বজায় রাখাটা কট্টর সংখ্যাগুরুবাদকে আঁকড়ে ধরলেন!

হে একদা আমার প্রাণের নেত্রী সু চি, এ পরীক্ষায় আপনি ডাহা ফেল করেছেন। আপনার জীবনগাথায় ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক’-এই গৌরবময় তথ্যের পরের লাইনেই লেখা থাকবে, মিয়ানমারে আপনার আমলে মানবাধিকার ভয়াবহ ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছিল। আসলে নোবেল শান্তি পুরস্কারের ভার খুব বেশি। সে ভার বহন করার সামর্থ্য আপনার নেই। এটাই সত্য। এ সত্য বড় কষ্টের- আস্থা ভেঙে যাওয়ার কষ্ট।
অতি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আপনার প্রতি আস্থা ও সম্মান ধরে রাখা গেল না। ক্ষমা করবেন। আজ বড় বেশি আফসোস হয়, আপনার মত ভুল মানুষকে মহান নেত্রী ভেবে একদিন অন্তরের সবটুকু অর্ঘ্য নিবেদন করেছিলাম বলে!

পুনশ্চ: সর্বশেষ খবর হলো, আন্তর্জাতিক চাপের কারণে অং সাং সুচি দেশটির রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আসিয়ানের এক অনির্ধারিত বৈঠক ডেকেছেন। আগামী ১৯ ডিসেম্বর ইয়াঙ্গুনে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে এই বৈঠক হবে। এই বৈঠকে তিনি নিশ্চয়ই আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন! বাংলাদেশের উচিত এই সম্মেলনে দৃঢ় ভূমিকা পালন করা। আসিয়ানভুক্ত অন্য সব দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগী ভূমিকা পালন করা।

মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগে ভূমিকা পালন করা। কারণ রোহিঙ্গারা আমাদের দেশের অর্থনীতি, সমাজিক স্থিতি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানকারী প্রায় ৮ লক্ষ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। শুধু আসিয়ানই নয়, জাতিসংঘ, ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে জনমত গঠনের মাধ্যমে মায়ানমারের বিরুদ্ধে সুকঠিন চাপ সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে নেমে পড়া ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।-চ্যানেল আই

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর