ঢাকা ০৩:৪৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইতিহাসই মারতে চায়নি ক্যাস্ত্রোকে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:০৬:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ নভেম্বর ২০১৬
  • ২৬১ বার

২৬ জুলাই, ১৯৫৩। ব্যর্থ মনকাডা অভিযান। ফিদেল ক্যাস্ত্রো তখন মাত্র ছাব্বিশ। মাথার দাম হাজার ডলার। হন্যে হয়ে তাকে খুঁজে বেরোচ্ছে স্বৈরশাসক বাতিস্তার সেনাবাহিনী।

পাঁচদিন বাদে আগস্টের সকাল। সমুদ্রের ধার বরাবর হেঁটে সিয়েরা মায়েস্ত্রায় যাবেন বলে ভাবছেন ফিদেল। পথে আশ্রয় নেন এক কৃষকের কুঁড়ে ঘরে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে গ্রামরক্ষী বাহিনীর ষোলোজনের একটি দল ঘিরে ফেলে সেই আস্তানা। নেতৃত্বে লেফটেন্যান্ট পেদ্রো সারিয়া। কোনো উপায় নেই দেখে ফিদেল আর তার সঙ্গীরা বেরিয়ে আসেন বাইরে। সারিয়া তখন চিৎকার করে সেনাদের বলেছেন, ‘গুলি করো না, আমি ওদের জীবিত ধরতে চাই।’

এই সারিয়ায় বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ফিদেলকে। সারিয়াও ছিলেন হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ফিদেলকে চিনতেন খুব কাছ থেকে। তাই দেরি হয়নি, মুহূর্তে চিনে ফেলেন। বাকিরা কেউ চিনতে পারেননি।

সময় নষ্ট না করে সারিয়া ঝুঁকে পড়ে ফিদেলের শরীরে তল্লাশি শুরু করেন। কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘ভুলেও ঠিক নাম বলো না, তাহলেই মরবে।’ ফিদেল বেঁচে যান, ফিদেলের মৃত্যু চায়নি ইতিহাস।

ইতোমধ্যে এক ট্রাক সেনা নিয়ে উপস্থিত কর্নেল পেরেস চাউমন্ত। তিনি বন্দিদের অধিকার চান। নিয়ে যেতে চান মনকাডা সেনাছাউনিতে। কর্নেলের ফন্দি ধরে ফেলেন সারিয়া। শান্ত গলায় অস্বীকার করেন। জানান, বন্দিরা তার, তিনিই তাদের নিয়ে যাবেন, বিচার ব্যবস্থার মুখোমুখি করবেন। লেফটেন্যান্ট তাদের নিয়ে যান সান্তিয়াগোতে। পুরে দেন জেলে। গোপনে হত্যার আর সুযোগ পাননি কর্নেল চাউমন্ত। এভাবেই একইদিনে দ্বিতীয়বারের জন্য নিশ্চিত মৃত্যুর থেকে বেঁচে যান ফিদেল ক্যাস্ত্রো।

পরে ফিদেলের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করায় সারিয়াকে কোর্ট মার্শাল করা হয়। গৃহবন্দি থাকেন বিপ্লবের বিজয় পর্যন্ত। পরে কিউবার বিপ্লবী সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেনের পদ পান। ছিলেন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান। ১৯৭২ সালে তিনি মারা যান।

ওরিয়েন্তের একটি প্রাদেশিক জেলে একেবারে আলাদা করে রাখা হয় ফিদেলকে। তখন তাকে আবার বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা হয়। কিন্তু, এবারেও তিনি বেঁচে যান। যাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়, সেই জেলরক্ষক লেফটেন্যান্ট ইয়ানেস পেলেতায়ার নির্দেশ পালনে অস্বীকার করেন। ইতিহাস আবারও জীবন দেয় ফিদেলকে।

কিন্তু এ জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ফিদেলকে ইয়ানেসকে। তাকে সেনাবাহিনী থেকে অপসারিত করা হয়। তিনি যোগ দেন আন্দোলনে। বিপ্লবের পর তিনি ছিলেন ফিদেলের দেহরক্ষী। এই ইয়ানেসই পরে হয়ে ওঠেন ফিদেলের ঘোর সমালোচক। যোগ দেন কিউবা-বিরোধী শিবিরে। এক দশকের বেশি সময় ছিলেন জেলে। ২০০০ সালে ৮৩ বছর বয়েসে মারা যান।

৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৬। সিয়েরা মায়েস্ত্রা। ১৫ ফিট ব্যাসার্ধের আখের খেত। খুবই নিচ দিয়ে আকাশে চক্কর মারছে বাতিস্তার যুদ্ধ বিমান। সঙ্গে স্পটার প্লেন, মাঝারি সাইজের অসমারিক বিমান। প্রতিটি বিমানে আটটি পয়েন্ট ফাইভ ক্যালিবারের মেশিনগান। বৃষ্টির মতো অবিরাম গুলিবর্ষণ। অবধারিত মৃত্যুর মুখোমুখি তিনি। কনুইয়ে ভর দিয়ে হাঁটু ঘষে অতি সন্তর্পণে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের ভারী শরীর। সবুজ খেতে জলপাই রঙের পোশাক মিলেমিশে একাকার। ডান হাতে বেলজিয়ামে তৈরি পয়েন্ট টুয়েন্টি টু ক্যালিবারের টেলিস্কোপিক অটোমেটিক রাইফেল। সঙ্গী দু’জন। উনিভেরসো সানচেজ আলভারেস আর ফাউনিস্তো পেরেস এরনানদেজ। আলভারেসের হাতেও একটি টেলিস্কোপিক রাইফেল। গাছগাছালি সবুজ পাতা শুকনো খড়কুটোয় লুকিয়ে তিনটি শরীর।

ফিদেল ক্যাস্ত্রো

শেষে পাহাড় বেয়ে সন্ধ্যা নামে। বন্ধ হয় এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ। ফিরে যায় বাতিস্তার বিমান। কমান্ডার ফিদেল আলেহান্দ্রো ক্যাস্ত্রো রুজকে নিয়ে বিপ্লবী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা এখন সাকুল্যে তিন। অস্ত্র মাত্র দু’টি। চারদিন আগে, ২রা ডিসেম্বর বিরাশিজনের ছোট্ট গেরিলা বাহিনী ওরিয়েন্তে প্রদেশের দক্ষিণে সমুদ্রতীরে উঠতে না উঠতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাতিস্তা বাহিনী। দলের সদস্যরা আগেই যে যেদিকে পেরেছেন ছিটকে গিয়েছেন।

ওই দু’টি রাইফেল নিয়েই নতুন করে শুরু। দু’সপ্তাহ বাদে এক কৃষকের ঘরে রাউল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা। ওদের দলে তখন পাঁচজন। বিপ্লবী বাহিনীর সংখ্যা বেড়ে এখন আট। অস্ত্র সংখ্যা সাত। আর এহেন শক্তিবৃদ্ধিতেই ফিদেলের ঘোষণা: ‘এখন আমরা জিততে পারি এই যুদ্ধে।’

কানে তখন বাজছে কিউবার স্বাধীনতা আন্দোলনের কিংবদন্তি কার্লোস ম্যানুয়েল দে সেসপিদিসের প্রত্যয়, ‘এখনও আমরা বারোজন! কিউবার স্বাধীনতার জন্য এটাই যথেষ্ট।’এই হলেন ফিদেল।

মৃত্যুঞ্জয়ী এক বিপ্লবীর মহাপ্রয়াণ

হেরেও যিনি হারেন না। অদম্য অফুরন্ত প্রাণশক্তি। দুর্দমনীয় মনোবল। অসম্ভব প্রত্যয়। নিজ লক্ষ্যে অবিচল। অকুতোভয়। একটা সময় মাত্র এই সাতটি রাইফেল দিয়েই লড়াই শুরু। পরে দেহাতী কৃষকরা তুলে দেন কিছু বন্দুক। বিপ্লবীদের বেশ কয়েকজনকে হত্যার সময় যেগুলি তারা তুলে রেখেছিলেন। এভাবেই সবমিলিয়ে বন্দুকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সতেরো। আর তা থেকেই আসে প্রথম জয়।

১ জানুয়ারি, ১৯৫৯। মনকাডা অভিযানের পাঁচবছর, পাঁচমাস, পাঁচদিন পরে সফল কিউবা বিপ্লব।

আইজেনহাওয়ার থেকে ক্লিন্টন। কিউবা বিপ্লবের পর একের পর এক মার্কিন রাষ্ট্রপতি তাকে হত্যা, কিংবা উৎখাতের চেষ্টা করে গিয়েছেন। গবেষণা মতে আইজেনহাওয়ারের সময় ৩৮বার। কেনেডি ৪২, জনসন ৭২, নিক্সন ১৮৪, কার্টার ৬৪, রেগান ১৯৭, সিনিয়র বুশ ১৬ এবং ক্লিন্টনের সময় ২১বার তাকে হত্যা চেষ্টা করা হয়।

মৃত্যুঞ্জয়ী এক বিপ্লবীর মহাপ্রয়াণ

গুরুতর হত্যার চেষ্টা হয় ২০০০ সালে, যখন ক্যাস্ত্রো গিয়েছিলেন পানামা সফরে। তার মঞ্চের নিচে রাখা হয় ৯০কেজি মারাত্মক বিস্ফোরক। ক্যাস্ত্রোর নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী শেষ মুহূর্তের তল্লাশির সময় তা উদ্ধার করে। ভেস্তে যায় ষড়যন্ত্র।

তাইতো রচিত হয়েছে ‘ফিদেল! ফিদেল! এমন এক মানুষ যাকে হারাতে পারেনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ কিউবার গণসংগীত।

কোনও একক শব্দে, কোনও একটা ক্যানভাসে ফিদেলকে ধরা সম্ভব নয়। আজীবন তিনি ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন সমাজতন্ত্র, ন্যায়বিচার, শান্তি, সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ, বিশ্ব মানবতা, কিউবা বিপ্লবের নিশান। লাতিন আমেরিকার বিপ্লবীদের বহু প্রজন্মের জনক তিনি। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের তিনি ধ্রুবতারা।

মনকাডা অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থতার জঠরে ছিল সাফল্যের বীজ। জন্ম দিয়েছিল একটি আন্দোলনের। ‘ইতিহাস আমায় ক্ষমা করবে’ প্রত্যয়ের মধ্যে ছিল মতাদর্শের প্রতি অবিচল বিশ্বাস। ইতিহাস শুধু তাকে ক্ষমাই করেনি, প্রমাণ করেছে তার বক্তব্যের সত্যতা, তার জীবনের উত্তরাধিকার।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ইতিহাসই মারতে চায়নি ক্যাস্ত্রোকে

আপডেট টাইম : ০১:০৬:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

২৬ জুলাই, ১৯৫৩। ব্যর্থ মনকাডা অভিযান। ফিদেল ক্যাস্ত্রো তখন মাত্র ছাব্বিশ। মাথার দাম হাজার ডলার। হন্যে হয়ে তাকে খুঁজে বেরোচ্ছে স্বৈরশাসক বাতিস্তার সেনাবাহিনী।

পাঁচদিন বাদে আগস্টের সকাল। সমুদ্রের ধার বরাবর হেঁটে সিয়েরা মায়েস্ত্রায় যাবেন বলে ভাবছেন ফিদেল। পথে আশ্রয় নেন এক কৃষকের কুঁড়ে ঘরে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে গ্রামরক্ষী বাহিনীর ষোলোজনের একটি দল ঘিরে ফেলে সেই আস্তানা। নেতৃত্বে লেফটেন্যান্ট পেদ্রো সারিয়া। কোনো উপায় নেই দেখে ফিদেল আর তার সঙ্গীরা বেরিয়ে আসেন বাইরে। সারিয়া তখন চিৎকার করে সেনাদের বলেছেন, ‘গুলি করো না, আমি ওদের জীবিত ধরতে চাই।’

এই সারিয়ায় বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ফিদেলকে। সারিয়াও ছিলেন হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ফিদেলকে চিনতেন খুব কাছ থেকে। তাই দেরি হয়নি, মুহূর্তে চিনে ফেলেন। বাকিরা কেউ চিনতে পারেননি।

সময় নষ্ট না করে সারিয়া ঝুঁকে পড়ে ফিদেলের শরীরে তল্লাশি শুরু করেন। কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘ভুলেও ঠিক নাম বলো না, তাহলেই মরবে।’ ফিদেল বেঁচে যান, ফিদেলের মৃত্যু চায়নি ইতিহাস।

ইতোমধ্যে এক ট্রাক সেনা নিয়ে উপস্থিত কর্নেল পেরেস চাউমন্ত। তিনি বন্দিদের অধিকার চান। নিয়ে যেতে চান মনকাডা সেনাছাউনিতে। কর্নেলের ফন্দি ধরে ফেলেন সারিয়া। শান্ত গলায় অস্বীকার করেন। জানান, বন্দিরা তার, তিনিই তাদের নিয়ে যাবেন, বিচার ব্যবস্থার মুখোমুখি করবেন। লেফটেন্যান্ট তাদের নিয়ে যান সান্তিয়াগোতে। পুরে দেন জেলে। গোপনে হত্যার আর সুযোগ পাননি কর্নেল চাউমন্ত। এভাবেই একইদিনে দ্বিতীয়বারের জন্য নিশ্চিত মৃত্যুর থেকে বেঁচে যান ফিদেল ক্যাস্ত্রো।

পরে ফিদেলের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করায় সারিয়াকে কোর্ট মার্শাল করা হয়। গৃহবন্দি থাকেন বিপ্লবের বিজয় পর্যন্ত। পরে কিউবার বিপ্লবী সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেনের পদ পান। ছিলেন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান। ১৯৭২ সালে তিনি মারা যান।

ওরিয়েন্তের একটি প্রাদেশিক জেলে একেবারে আলাদা করে রাখা হয় ফিদেলকে। তখন তাকে আবার বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা হয়। কিন্তু, এবারেও তিনি বেঁচে যান। যাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়, সেই জেলরক্ষক লেফটেন্যান্ট ইয়ানেস পেলেতায়ার নির্দেশ পালনে অস্বীকার করেন। ইতিহাস আবারও জীবন দেয় ফিদেলকে।

কিন্তু এ জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ফিদেলকে ইয়ানেসকে। তাকে সেনাবাহিনী থেকে অপসারিত করা হয়। তিনি যোগ দেন আন্দোলনে। বিপ্লবের পর তিনি ছিলেন ফিদেলের দেহরক্ষী। এই ইয়ানেসই পরে হয়ে ওঠেন ফিদেলের ঘোর সমালোচক। যোগ দেন কিউবা-বিরোধী শিবিরে। এক দশকের বেশি সময় ছিলেন জেলে। ২০০০ সালে ৮৩ বছর বয়েসে মারা যান।

৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৬। সিয়েরা মায়েস্ত্রা। ১৫ ফিট ব্যাসার্ধের আখের খেত। খুবই নিচ দিয়ে আকাশে চক্কর মারছে বাতিস্তার যুদ্ধ বিমান। সঙ্গে স্পটার প্লেন, মাঝারি সাইজের অসমারিক বিমান। প্রতিটি বিমানে আটটি পয়েন্ট ফাইভ ক্যালিবারের মেশিনগান। বৃষ্টির মতো অবিরাম গুলিবর্ষণ। অবধারিত মৃত্যুর মুখোমুখি তিনি। কনুইয়ে ভর দিয়ে হাঁটু ঘষে অতি সন্তর্পণে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের ভারী শরীর। সবুজ খেতে জলপাই রঙের পোশাক মিলেমিশে একাকার। ডান হাতে বেলজিয়ামে তৈরি পয়েন্ট টুয়েন্টি টু ক্যালিবারের টেলিস্কোপিক অটোমেটিক রাইফেল। সঙ্গী দু’জন। উনিভেরসো সানচেজ আলভারেস আর ফাউনিস্তো পেরেস এরনানদেজ। আলভারেসের হাতেও একটি টেলিস্কোপিক রাইফেল। গাছগাছালি সবুজ পাতা শুকনো খড়কুটোয় লুকিয়ে তিনটি শরীর।

ফিদেল ক্যাস্ত্রো

শেষে পাহাড় বেয়ে সন্ধ্যা নামে। বন্ধ হয় এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ। ফিরে যায় বাতিস্তার বিমান। কমান্ডার ফিদেল আলেহান্দ্রো ক্যাস্ত্রো রুজকে নিয়ে বিপ্লবী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা এখন সাকুল্যে তিন। অস্ত্র মাত্র দু’টি। চারদিন আগে, ২রা ডিসেম্বর বিরাশিজনের ছোট্ট গেরিলা বাহিনী ওরিয়েন্তে প্রদেশের দক্ষিণে সমুদ্রতীরে উঠতে না উঠতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাতিস্তা বাহিনী। দলের সদস্যরা আগেই যে যেদিকে পেরেছেন ছিটকে গিয়েছেন।

ওই দু’টি রাইফেল নিয়েই নতুন করে শুরু। দু’সপ্তাহ বাদে এক কৃষকের ঘরে রাউল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা। ওদের দলে তখন পাঁচজন। বিপ্লবী বাহিনীর সংখ্যা বেড়ে এখন আট। অস্ত্র সংখ্যা সাত। আর এহেন শক্তিবৃদ্ধিতেই ফিদেলের ঘোষণা: ‘এখন আমরা জিততে পারি এই যুদ্ধে।’

কানে তখন বাজছে কিউবার স্বাধীনতা আন্দোলনের কিংবদন্তি কার্লোস ম্যানুয়েল দে সেসপিদিসের প্রত্যয়, ‘এখনও আমরা বারোজন! কিউবার স্বাধীনতার জন্য এটাই যথেষ্ট।’এই হলেন ফিদেল।

মৃত্যুঞ্জয়ী এক বিপ্লবীর মহাপ্রয়াণ

হেরেও যিনি হারেন না। অদম্য অফুরন্ত প্রাণশক্তি। দুর্দমনীয় মনোবল। অসম্ভব প্রত্যয়। নিজ লক্ষ্যে অবিচল। অকুতোভয়। একটা সময় মাত্র এই সাতটি রাইফেল দিয়েই লড়াই শুরু। পরে দেহাতী কৃষকরা তুলে দেন কিছু বন্দুক। বিপ্লবীদের বেশ কয়েকজনকে হত্যার সময় যেগুলি তারা তুলে রেখেছিলেন। এভাবেই সবমিলিয়ে বন্দুকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সতেরো। আর তা থেকেই আসে প্রথম জয়।

১ জানুয়ারি, ১৯৫৯। মনকাডা অভিযানের পাঁচবছর, পাঁচমাস, পাঁচদিন পরে সফল কিউবা বিপ্লব।

আইজেনহাওয়ার থেকে ক্লিন্টন। কিউবা বিপ্লবের পর একের পর এক মার্কিন রাষ্ট্রপতি তাকে হত্যা, কিংবা উৎখাতের চেষ্টা করে গিয়েছেন। গবেষণা মতে আইজেনহাওয়ারের সময় ৩৮বার। কেনেডি ৪২, জনসন ৭২, নিক্সন ১৮৪, কার্টার ৬৪, রেগান ১৯৭, সিনিয়র বুশ ১৬ এবং ক্লিন্টনের সময় ২১বার তাকে হত্যা চেষ্টা করা হয়।

মৃত্যুঞ্জয়ী এক বিপ্লবীর মহাপ্রয়াণ

গুরুতর হত্যার চেষ্টা হয় ২০০০ সালে, যখন ক্যাস্ত্রো গিয়েছিলেন পানামা সফরে। তার মঞ্চের নিচে রাখা হয় ৯০কেজি মারাত্মক বিস্ফোরক। ক্যাস্ত্রোর নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী শেষ মুহূর্তের তল্লাশির সময় তা উদ্ধার করে। ভেস্তে যায় ষড়যন্ত্র।

তাইতো রচিত হয়েছে ‘ফিদেল! ফিদেল! এমন এক মানুষ যাকে হারাতে পারেনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ কিউবার গণসংগীত।

কোনও একক শব্দে, কোনও একটা ক্যানভাসে ফিদেলকে ধরা সম্ভব নয়। আজীবন তিনি ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন সমাজতন্ত্র, ন্যায়বিচার, শান্তি, সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ, বিশ্ব মানবতা, কিউবা বিপ্লবের নিশান। লাতিন আমেরিকার বিপ্লবীদের বহু প্রজন্মের জনক তিনি। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের তিনি ধ্রুবতারা।

মনকাডা অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থতার জঠরে ছিল সাফল্যের বীজ। জন্ম দিয়েছিল একটি আন্দোলনের। ‘ইতিহাস আমায় ক্ষমা করবে’ প্রত্যয়ের মধ্যে ছিল মতাদর্শের প্রতি অবিচল বিশ্বাস। ইতিহাস শুধু তাকে ক্ষমাই করেনি, প্রমাণ করেছে তার বক্তব্যের সত্যতা, তার জীবনের উত্তরাধিকার।