ঢাকা ০৩:১০ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কৃচ্ছতা ও শুদ্ধতার সওগাত

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:৩৩:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ জুন ২০১৫
  • ৭৫৬ বার

রমজানে ইবাদত, জিকির, তেলাওয়াত, কৃচ্ছতা সাধন ও আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্যের স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কেবলমাত্র পানাহার ও পাপাচার ত্যাগ করলেই রোজা পালন হয় না। সেই সঙ্গে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে সর্বপ্রকার অন্যায় ও পাপ কাজ হতে বিরত থাকতে হবে এবং অন্তরকে করতে হয় পরিচ্ছন্ন, তবেই রোজা মুমিনের জীবনে নিয়ে আসবে অফুরন্ত রহমত ও বরকত।

এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোজা রাখে সে যেন কোনো রকম অশ্লীলতা ও হৈ-হুল্লোড় না করে। সমাজের কোনো সদস্য যদি তাকে গালাগাল করে বা তার সঙ্গে ঝগড়া করে সে যেন বলে- আমি রোজাদার।’ – বোখারি ও মুসলিম

রোজা ধৈর্য, সংযম, নৈতিক উৎকর্ষ ও মানবীয় মূল্যবোধের জন্ম দেয়। শিষ্টাচারের মাধ্যমে নৈতিক চরিত্র গঠন রমজানের সিয়াম সাধনার একটি মৌলিক শিক্ষা। রমজান মাস আসলে মহানবী (সা.) সমাজের অভাবগ্রস্থ ও বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিজকে উজাড় করে দিতেন। অন্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থ ও খাবার সরবরাহ করতেন অধিকমাত্রায়। এক মাস সিয়াম সাধনার ফলে সমাজের সদস্যদের উপকার ও কল্যাণের যে প্রশিক্ষণ রোজাদার পায়, তা বাকী ১১ মাস তার জীবনকে প্রণোদিত ও প্রভাবিত করে।

মহানবী (সা.) বলেন, জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া কর; সহমর্মিতা প্রদর্শন কর, আসমানের মালিক তোমার প্রতি দয়া পরবশ হবেন। এখানে জাতি, ধর্র্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি দয়া ও ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে।

সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করে থাকে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আল জাওযি (রহ.) বলেন, ‘মানুষের আত্মিক ও দৈহিক শক্তি সংরক্ষণে রোজা অত্যন্ত কার্যকর। এক দিকে তা মানুষের পাশবিক চাহিদার প্রাবল্য থেকে মুক্ত করে তার দৈহিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করে; অপরদিকে তা নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আত্মিক সুস্থতা সাধন করে।’

মাসব্যাপী রোজার মাধ্যমে মানুষের জৈবিক চাহিদা ও পাশব প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে যায়, মনুষ্যত্ব ও রূহানিয়াত সজীব ও জাগ্রত হয়। রিপুর তাড়নামুক্ত হয়ে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত বিবেক ও প্রজ্ঞার সদ্ব্যবহার করে সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ সৎকর্মের প্রতি ধাবিত হওয়ার প্রণোদনা লাভ করে এবং অসদুপায়ে সম্পদ পুঞ্জিভূত করার মানসিকতা লোভ পায়।

শুদ্ধতার এ অমোঘ মাসটিতে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করার সুযোগ অবারিত হয়। সিয়ামের অর্থ হচ্ছে তাকওয়ার অনুশীলন আর তাকওয়ার অনুশীলনই অপরাধমুক্ত ও কণ্যাণধর্মী সমাজ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। রমজান মানুষের মধ্যে মানবিকতাবোধের উন্মেষ ঘটায়। মহানবী (সা.)-এর ভাষায় ‘সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যরে মাস মাহে রমজান।’ -বায়হাকি

কেননা ধনী ও বিত্তশালীরা সারাদিন রোজা রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জঠর জ্বালার দহন-বেদনা বুঝতে সক্ষম হন, ফলে তাদের মাঝে সমাজের বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয়। রমজান মাসে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থ মানুষের কল্যাণের অর্থ ব্যয় করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে আয়েশা! অভাবগ্রস্থ মানুষতে ফেরত দিও না। একটি খেজুরকে টুকরো টুকরো করে হলেও দান কর। দরিদ্র মানুষকে ভালোবাস এবং কাছে টান। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তোমাকে কাছে টানবেন।’ সমাজের প্রতিটি সদস্য সিয়াম সাধনার ফলে অর্জিত সহমর্মিতা ও মানব কল্যাণের শিক্ষা বাকী জীবন যদি অনুশীলন করতে পারে তাহলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব।

রমজান মাস আসলে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অত্যধিক মুনাফা লাভের আশায়। ফলে অনেক রোজাদার ক্ষতি ও বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন। মহানবী (সা.) বলেন, মজুদদার অভিশপ্ত; আমদানী রপ্তানী করে যারা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পোঁছায়, আল্লাহতায়ালা তাদের পর্যাপ্ত রিজিক প্রদান করেন। এছাড়া এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী রমজান মাসে খাদ্যদ্রব্যে ব্যাপকভাবে ভেজাল মেশায়। ক্যামিক্যালযুক্ত খাবার গ্রহণ করে রোজাদাররা নানাবিধ দুরারোগ্য শারীরিক জটিলতার শিকার হন। এগুলো অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায় কাজ আইন ও ধর্মের দৃষ্টিতে। এগুলো থেকে বিরত থাকা দরকার।

ইসলাম মানব কল্যাণের ধর্ম, শান্তি, সহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধর্ম। পশুসত্তাকে অবদমিত করে মানবসত্তাকে জাগ্রত করার জন্য ইসলামের নির্দেশ রয়েছে। খোদাভীতি, সৎ ও ন্যায়কাজে একে অপরের সহযোগিতার ফলে সমাজে মানবতা ব্যাপ্তি লাভ করে। মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, ‘সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা কর না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা কঠোর শাস্তিদাতা।’ -সূরা আল মায়েদা : ০২

এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ দেখায় না, আল্লাহ তার প্রতি দয়া-অনুগ্রহ দেখান না।’ -মিশকাত, হাদিস নং ৪৯৪৭

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। একে অপরের সাহায্য ও নির্ভরশীলতা ছাড়া জীবন পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না। মানুষের জীবনের সঙ্গে হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-বিষাদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুর্বল ও অসহায় মানুষের প্রতি ক্ষমতাশালী ও বিত্তবানদের সহানুভূতির হাত সম্প্রসারণ হচ্ছে মানবতা। পরের কল্যাণ ও সুখের জন্য নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে বিসর্জন যারা দিতে পারেন তারা মানবতাবাদী, মানবহিতৈষি। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ন্যায়-সঙ্গত অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার রক্ষার নামই মানবতা। ইসলামি বিধান মতে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। মুসলিম-অমুসলিম, সাদা-কালো, ধনী-নির্ধন, উঁচু-নিচু সকল ধরণের মানুষ আল্লাহর বান্দা। সমগ্র মানব জাতি একই পরিবারভুক্ত। মহানবী (সা.) আরো বলেন, ‘গোটা সৃষ্টি (মাখলুক) আল্লাহতায়ালার পরিবারভূক্ত। সুতরাং সৃষ্টিকুলের মধ্যে আল্লাহতায়ালার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়, যে আল্লাহর পরিবারের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে।’ -মিশকাত, হাদিস নং ৪৯৯৯

রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো সদকাতুল ফিতর। প্রতিটি রোজাদারের জন্য নির্ধারিত পরিমাণে গম অথবা কিশমিশ অথবা খেজুর অথবা পনির অথবা এর বিনিময়ে নগদ অর্থ গরীব, দুঃখী ও অভাবক্লিষ্ট মানুষকে দান করা ওয়াজিব তথা বাধ্যতামূলক। এতে করে রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো আল্লাহ মার্জনা করেন, অন্যদিকে সমাজের অসহায় মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়।

সম্পদশালী ও বিত্তবান যে কোনো মানুষের ওপর জাকাত বাধ্যতামূলক (ফরজ)। জাকাত বছরের যে কোনো সময় প্রদান করলে আদায় হয়ে যায় তবে রমজান মাসে দান করলে তার সওয়াব বহুগুণ বেশি। জাকাতের অর্থ দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত উন্নত খাবার গ্রহণ ও নতুন জামা-কাপড় ক্রয় করে ঈদের আনন্দে শরিক হওয়ার সুযোগ লাভ করেন।

অতিভোজন বা ভোজন বিলাসিতা স্নায়ুকোষে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং দেহযন্ত্রকে আলস করে দেয়। রোজা দেহের জন্য প্রতিষেধকের কাজ করে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে রোজা তথা উপবাসব্রতের কারণে দেহভ্যন্তরে এন্টি বায়োটিক এক বিরাট শক্তি সৃষ্টি হয় যার মাধ্যমে বহু ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও জীবাণু মারা পড়ে। এক মাসের সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্যে দিনের বেলা যখন পানাহার বন্ধ থাকে, তখন পাকস্থলী ও অন্ত্রের ঝিল্লি দেহযন্ত্র থেকে জীর্ণ পদার্থগুলোকে বের করে দেয়। সারা বছর জৈব রসজাত যে বিষ দেহে জমা হয়, সিয়ামের আগুনে তা পুড়ে নিঃশেষে রক্ত বিশুদ্ধ হয়, বিষমুক্ত হয়। একজন রোজাদার রমজান মাসে তার প্রতিটি অঙ্গ বিশেষত হাত, পা, চোখ, মুখ, উদরকে অবৈধ, গর্হিত কাজ ও আল্লাহর নাফরমানী হতে বিরত রেখে সংযমী হয়। দেহের ওপর রোজার প্রভাব সুদুরপ্রসারী। ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৈহিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার শিক্ষা দেয় মাহে রমজান।

রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা প্রভৃতি অন্যায় আচরণ পরিহার করে অতি মানবীয় জীবনের দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভ করে থাকে। রোজাদারের অন্তরে মানবকল্যাণের চেতনা জাগ্রত হয়। অতএব মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা আল্লাহপাকের এক অপূর্ব নিয়ামত, যা অফুরন্ত কল্যাণের পথ উন্মোচিত করে। মহান আল্লাহ সংযমের সঙ্গে মমত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে সমাজের কল্যাণে অবদান রাখার তওফিক দান করুন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

কৃচ্ছতা ও শুদ্ধতার সওগাত

আপডেট টাইম : ০৪:৩৩:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ জুন ২০১৫

রমজানে ইবাদত, জিকির, তেলাওয়াত, কৃচ্ছতা সাধন ও আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্যের স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কেবলমাত্র পানাহার ও পাপাচার ত্যাগ করলেই রোজা পালন হয় না। সেই সঙ্গে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে সর্বপ্রকার অন্যায় ও পাপ কাজ হতে বিরত থাকতে হবে এবং অন্তরকে করতে হয় পরিচ্ছন্ন, তবেই রোজা মুমিনের জীবনে নিয়ে আসবে অফুরন্ত রহমত ও বরকত।

এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোজা রাখে সে যেন কোনো রকম অশ্লীলতা ও হৈ-হুল্লোড় না করে। সমাজের কোনো সদস্য যদি তাকে গালাগাল করে বা তার সঙ্গে ঝগড়া করে সে যেন বলে- আমি রোজাদার।’ – বোখারি ও মুসলিম

রোজা ধৈর্য, সংযম, নৈতিক উৎকর্ষ ও মানবীয় মূল্যবোধের জন্ম দেয়। শিষ্টাচারের মাধ্যমে নৈতিক চরিত্র গঠন রমজানের সিয়াম সাধনার একটি মৌলিক শিক্ষা। রমজান মাস আসলে মহানবী (সা.) সমাজের অভাবগ্রস্থ ও বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিজকে উজাড় করে দিতেন। অন্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থ ও খাবার সরবরাহ করতেন অধিকমাত্রায়। এক মাস সিয়াম সাধনার ফলে সমাজের সদস্যদের উপকার ও কল্যাণের যে প্রশিক্ষণ রোজাদার পায়, তা বাকী ১১ মাস তার জীবনকে প্রণোদিত ও প্রভাবিত করে।

মহানবী (সা.) বলেন, জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া কর; সহমর্মিতা প্রদর্শন কর, আসমানের মালিক তোমার প্রতি দয়া পরবশ হবেন। এখানে জাতি, ধর্র্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি দয়া ও ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে।

সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করে থাকে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আল জাওযি (রহ.) বলেন, ‘মানুষের আত্মিক ও দৈহিক শক্তি সংরক্ষণে রোজা অত্যন্ত কার্যকর। এক দিকে তা মানুষের পাশবিক চাহিদার প্রাবল্য থেকে মুক্ত করে তার দৈহিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করে; অপরদিকে তা নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আত্মিক সুস্থতা সাধন করে।’

মাসব্যাপী রোজার মাধ্যমে মানুষের জৈবিক চাহিদা ও পাশব প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে যায়, মনুষ্যত্ব ও রূহানিয়াত সজীব ও জাগ্রত হয়। রিপুর তাড়নামুক্ত হয়ে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত বিবেক ও প্রজ্ঞার সদ্ব্যবহার করে সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ সৎকর্মের প্রতি ধাবিত হওয়ার প্রণোদনা লাভ করে এবং অসদুপায়ে সম্পদ পুঞ্জিভূত করার মানসিকতা লোভ পায়।

শুদ্ধতার এ অমোঘ মাসটিতে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করার সুযোগ অবারিত হয়। সিয়ামের অর্থ হচ্ছে তাকওয়ার অনুশীলন আর তাকওয়ার অনুশীলনই অপরাধমুক্ত ও কণ্যাণধর্মী সমাজ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। রমজান মানুষের মধ্যে মানবিকতাবোধের উন্মেষ ঘটায়। মহানবী (সা.)-এর ভাষায় ‘সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যরে মাস মাহে রমজান।’ -বায়হাকি

কেননা ধনী ও বিত্তশালীরা সারাদিন রোজা রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জঠর জ্বালার দহন-বেদনা বুঝতে সক্ষম হন, ফলে তাদের মাঝে সমাজের বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয়। রমজান মাসে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থ মানুষের কল্যাণের অর্থ ব্যয় করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে আয়েশা! অভাবগ্রস্থ মানুষতে ফেরত দিও না। একটি খেজুরকে টুকরো টুকরো করে হলেও দান কর। দরিদ্র মানুষকে ভালোবাস এবং কাছে টান। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তোমাকে কাছে টানবেন।’ সমাজের প্রতিটি সদস্য সিয়াম সাধনার ফলে অর্জিত সহমর্মিতা ও মানব কল্যাণের শিক্ষা বাকী জীবন যদি অনুশীলন করতে পারে তাহলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব।

রমজান মাস আসলে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অত্যধিক মুনাফা লাভের আশায়। ফলে অনেক রোজাদার ক্ষতি ও বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন। মহানবী (সা.) বলেন, মজুদদার অভিশপ্ত; আমদানী রপ্তানী করে যারা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পোঁছায়, আল্লাহতায়ালা তাদের পর্যাপ্ত রিজিক প্রদান করেন। এছাড়া এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী রমজান মাসে খাদ্যদ্রব্যে ব্যাপকভাবে ভেজাল মেশায়। ক্যামিক্যালযুক্ত খাবার গ্রহণ করে রোজাদাররা নানাবিধ দুরারোগ্য শারীরিক জটিলতার শিকার হন। এগুলো অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায় কাজ আইন ও ধর্মের দৃষ্টিতে। এগুলো থেকে বিরত থাকা দরকার।

ইসলাম মানব কল্যাণের ধর্ম, শান্তি, সহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধর্ম। পশুসত্তাকে অবদমিত করে মানবসত্তাকে জাগ্রত করার জন্য ইসলামের নির্দেশ রয়েছে। খোদাভীতি, সৎ ও ন্যায়কাজে একে অপরের সহযোগিতার ফলে সমাজে মানবতা ব্যাপ্তি লাভ করে। মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, ‘সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা কর না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা কঠোর শাস্তিদাতা।’ -সূরা আল মায়েদা : ০২

এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ দেখায় না, আল্লাহ তার প্রতি দয়া-অনুগ্রহ দেখান না।’ -মিশকাত, হাদিস নং ৪৯৪৭

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। একে অপরের সাহায্য ও নির্ভরশীলতা ছাড়া জীবন পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না। মানুষের জীবনের সঙ্গে হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-বিষাদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুর্বল ও অসহায় মানুষের প্রতি ক্ষমতাশালী ও বিত্তবানদের সহানুভূতির হাত সম্প্রসারণ হচ্ছে মানবতা। পরের কল্যাণ ও সুখের জন্য নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে বিসর্জন যারা দিতে পারেন তারা মানবতাবাদী, মানবহিতৈষি। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ন্যায়-সঙ্গত অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার রক্ষার নামই মানবতা। ইসলামি বিধান মতে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। মুসলিম-অমুসলিম, সাদা-কালো, ধনী-নির্ধন, উঁচু-নিচু সকল ধরণের মানুষ আল্লাহর বান্দা। সমগ্র মানব জাতি একই পরিবারভুক্ত। মহানবী (সা.) আরো বলেন, ‘গোটা সৃষ্টি (মাখলুক) আল্লাহতায়ালার পরিবারভূক্ত। সুতরাং সৃষ্টিকুলের মধ্যে আল্লাহতায়ালার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়, যে আল্লাহর পরিবারের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে।’ -মিশকাত, হাদিস নং ৪৯৯৯

রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো সদকাতুল ফিতর। প্রতিটি রোজাদারের জন্য নির্ধারিত পরিমাণে গম অথবা কিশমিশ অথবা খেজুর অথবা পনির অথবা এর বিনিময়ে নগদ অর্থ গরীব, দুঃখী ও অভাবক্লিষ্ট মানুষকে দান করা ওয়াজিব তথা বাধ্যতামূলক। এতে করে রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো আল্লাহ মার্জনা করেন, অন্যদিকে সমাজের অসহায় মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়।

সম্পদশালী ও বিত্তবান যে কোনো মানুষের ওপর জাকাত বাধ্যতামূলক (ফরজ)। জাকাত বছরের যে কোনো সময় প্রদান করলে আদায় হয়ে যায় তবে রমজান মাসে দান করলে তার সওয়াব বহুগুণ বেশি। জাকাতের অর্থ দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত উন্নত খাবার গ্রহণ ও নতুন জামা-কাপড় ক্রয় করে ঈদের আনন্দে শরিক হওয়ার সুযোগ লাভ করেন।

অতিভোজন বা ভোজন বিলাসিতা স্নায়ুকোষে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং দেহযন্ত্রকে আলস করে দেয়। রোজা দেহের জন্য প্রতিষেধকের কাজ করে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে রোজা তথা উপবাসব্রতের কারণে দেহভ্যন্তরে এন্টি বায়োটিক এক বিরাট শক্তি সৃষ্টি হয় যার মাধ্যমে বহু ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও জীবাণু মারা পড়ে। এক মাসের সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্যে দিনের বেলা যখন পানাহার বন্ধ থাকে, তখন পাকস্থলী ও অন্ত্রের ঝিল্লি দেহযন্ত্র থেকে জীর্ণ পদার্থগুলোকে বের করে দেয়। সারা বছর জৈব রসজাত যে বিষ দেহে জমা হয়, সিয়ামের আগুনে তা পুড়ে নিঃশেষে রক্ত বিশুদ্ধ হয়, বিষমুক্ত হয়। একজন রোজাদার রমজান মাসে তার প্রতিটি অঙ্গ বিশেষত হাত, পা, চোখ, মুখ, উদরকে অবৈধ, গর্হিত কাজ ও আল্লাহর নাফরমানী হতে বিরত রেখে সংযমী হয়। দেহের ওপর রোজার প্রভাব সুদুরপ্রসারী। ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৈহিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার শিক্ষা দেয় মাহে রমজান।

রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা প্রভৃতি অন্যায় আচরণ পরিহার করে অতি মানবীয় জীবনের দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভ করে থাকে। রোজাদারের অন্তরে মানবকল্যাণের চেতনা জাগ্রত হয়। অতএব মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা আল্লাহপাকের এক অপূর্ব নিয়ামত, যা অফুরন্ত কল্যাণের পথ উন্মোচিত করে। মহান আল্লাহ সংযমের সঙ্গে মমত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে সমাজের কল্যাণে অবদান রাখার তওফিক দান করুন।