গণমাধ্যমের আচরণের বিরুদ্ধে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এত দিন যে অভিযোগ করে এসেছেন শেষ পর্যন্ত সেটাই কি সত্যি হলো? ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গণমাধ্যমকে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্নের সামনেই তো ফেলে দিয়েছেন। গণমাধ্যম কি তাহলে সত্য বলে না? তারা কি আসলে দুর্নীতিগ্রস্ত? নাকি গণমাধ্যম নিজে যেটা চেয়েছে, সেটারই প্রতিফলন ঘটিয়েছে, গণমানুষের হৃদস্পন্দন বুঝতে পারেনি?
গণমাধ্যম শুধু ট্রাম্পকে একজন রগচটা, নারী নির্যাতনকারী, পাগলের প্রলাপকারী হিসেবেই চিত্রিত করেছে, তাকে যে জনগণ পছন্দ করে -সেটা বুঝতে পারেনি। গণমাধ্যম একজন সুশীলকে ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে, গণমাধ্যম যাকে কুশীল মনে করেছে, জনগণ যে সেটা আমলে নিচ্ছে না, সেটা বুঝতে পারেনি। এখানেই গণমাধ্যমের ব্যর্থতা।
গত কয়েক মাস ধরে অবিরাম গণমাধ্যম ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছে। নানা জনমত জরিপ প্রকাশ করে বলেছে, হিলারিই নির্বাচিত হবেন। শুধু তাই নয়, গণমাধ্যম ট্রাম্পকে পাগল বলতেও দ্বিধা করেনি। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির প্রায় সব সংবাদমাধ্যম ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছিল। এসব পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন আর বিশ্লেষণে বলা হতো কেন হিলারিকে ভোট দেবে জনগণ, কেন ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউজে ঢুকতে দেওয়া হবে না, কী কী কারণে ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া ঠিক না ইত্যাদি।
এমনকি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ১১৫ বছরের ঐতিহ্য ভাঙার নমুনাও তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংবাদপত্র। অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা দৈনিক দ্য অ্যারিজোনা রিপাবলিকের বয়স ১২৬। এই পত্রিকাটি শুরু থেকে সর্বশেষ ২০১২ সালের নির্বাচন পর্যন্ত রিপাবলিকান দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্তু এবার তারা রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন না দিয়ে হিলারিকে সমর্থন দিয়েছে। পত্রিকাটি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার উপযুক্ত নন। ডেমোক্রেটিক পার্টির হিলারির যোগ্যতাই বেশি। এ রকম নজির স্থাপন করেছে দ্য ইউএসএ টুডে। পত্রিকাটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকাই পালন করে আসছে প্রতিষ্ঠার পর থেকে। কিন্তু এবার তারা লিখেছে সম্পাদনা পরিষদের সব সদস্যই মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন। কারণ, ট্রাম্প যে ধরনের আচরণ করেছেন, তাতে মনে হয়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার মতো জ্ঞানবুদ্ধি তার নেই।
শুধু সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, বিশ্লেষণ বা রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের বরাত দিয়ে নানা প্রবন্ধ এবং জরিপ চালিয়ে এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ট্রাম্পের কোনো জনপ্রিয়তাই নেই। নির্বাচনের ফল এটা প্রমাণ করে দিয়েছে, সংবাদমাধ্যমের প্রচারণায় জনগণ কান দেয় না। আর জরিপেও যে সঠিক ফল উঠে আসে না, সেটা তো স্পষ্টই করে দিলো এবারের নির্বাচনের ফল।
শুরু থেকেই ট্রাম্প অভিযোগ করে আসছিলেন সংবাদপত্র তার পিছে লেগেছে। গত ১৫ আগস্ট কানেটিকাটের ফেয়ারফিল্ডে এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু অসৎ হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধেই লড়ছি না। আমি অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধেও লড়ছি।’
দেশের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে দেওয়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধেও কথা বলেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘সংবাদপত্র ও অন্যদের যা ইচ্ছে তা-ই বলার এবং লেখা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার আওতায় পড়ে না। ডাহা মিথ্যা কথা বলা বা লেখা কখনোই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না।’ এর আগে তিনি সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে মানহানির আইন চালুরও পরামর্শ দিয়েছিলেন। যেন মানুষ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে।
ট্রাম্প টুইটার বার্তায় গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছিলেন, তারা আমার সমাবেশ পুরোপুরি কভার করে না। জনসভায় লোকসমাগমের চিত্র তারা দেখায় না, মানুষের উচ্ছ্বাসও তাদের রিপোর্টিংয়ে অনুপস্থিত থাকে। ফ্লোরিডায় এক নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্প বলেছিলেন, সব জরিপেই তার জয়ের কথা উঠে এসেছে। তা সত্ত্বেও ‘দুর্নীতিগ্রস্ত কর্পোরেট গণমাধ্যম’ হিলারির পক্ষ নিয়েছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো তার পক্ষে কোনো কথা না বলে একতরফাভাবে হিলারির সাফাই গেয়েছে। ফ্লোরিডার সমাবেশে ট্রাম্প অন্তত তিনবার গণমাধ্যমকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি এতটাই রেগেছেন একপর্যায়ে গণমাধ্যমকে নরকে যাওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
এক নির্বাচনী জনসভায় ট্রাম্প বলেন, দায়িত্বে থাকাকালীন হিলারির অপকর্মের এত তথ্য দিচ্ছে উইকিলিকস, তবু গণমাধ্যম সেগুলো নিয়ে কথা বলছে না। বলছে, ট্রাম্প ২০ বছর আগে বা ৩৫ বছর আগে কী করেছে -সেটা নিয়ে।
নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি বলেছেন, … বরং গণমাধ্যম যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে তাতে ট্রাম্পকে পরাজিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই তারা এগোচ্ছে, সেটার প্রভাব নিয়েই চিন্তিত ট্রাম্প।
গত ২৬ অক্টোবর গণমাধ্যম আর জরিপকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি অভিযোগ করেছেন, দুর্নীতিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থার একটা অংশ হলো গণমাধ্যম ও জরিপকারী সংস্থা। তার প্রার্থিতার সবচেয়ে বড় ক্ষতি এরাই করছে। এ সময় তিনি গণমাধ্যমকে ‘চোর-বাটপার’ বলেও গালি দেন। তিনি বলেন গণমাধ্যম সাধারণ শ্রমজীবী শ্রেণির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। ‘অথচ এই গণমাধ্যমই জনগণের জীবন, অর্থনীতি, দেশ নিয়ন্ত্রণ করে।’
এসব কারণে ট্রাম্প গণমাধ্যমকে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া সহজতর করবেন বলেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে এখন তিনি কি আসলে গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরবেন নাকি এসবই ছিল তার নেতিবাচক প্রচারণার একটি কৌশল -সেটি জানতে বেশি দিন হয়তো অপেক্ষা করতে হবে না।
ডিবিসি নিউজ