মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুল্লাহ আল নোমান। দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনীতিক জীবন তার। ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম যেখানেই থাকেন কর্মীদের জন্য দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা তার দরজা। জন্ম একটি প্রগতিশীল ও রাজনীতি সচেতন পরিবারে। চট্টগ্রামের কাজেম আলী স্কুলে পড়াশোনাকালীন এক প্রতিবাদে অংশ নেয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতে খড়ি।
চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করেন নোমানসহ তার সহপাঠীরা এক রাতেই। ১৯৫৯-১৯৬০ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক, জেলা কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৬৮ সালে ১১ মাস কারাভোগ করেন এবং কারাবন্দি অবস্থায় পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রি। সামরিক আদালতে শাস্তি পাওয়ায় আত্মগোপনে যাওয়ার কারণে এমএ পড়া হয়নি। পরে ব্যারিস্টার মিল্কির আগ্রহে চট্টগ্রাম ল কলেজে ভর্তি হলেও আইনের ছাত্র হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি তার। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন ষাটের দশকে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলনে।
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ‘সে অপরাধে’ তার বিরুদ্ধে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, ১০টি বেত্রাঘাতসহ তার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেয় সামরিক আদালত। দীর্ঘসময় তাকে কাটাতে হয় আত্মগোপনে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতের ত্রিপুরা যান। সেখানে বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সহায়তাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন নোমান। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তোলেন চট্টগ্রামে। সরকারি রোষের কারণে এ সময় দিনের পর দিন তাকে থাকতে হয় আত্মগোপনে। ১৯৭২ সালের ৮ই ডিসেম্বর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তিনি। পাত্রী একই উপজেলার পাশের গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ঘরের উচ্চশিক্ষিত কন্যা। কিন্তু পরদিন ৯ই ডিসেম্বর ন্যাপের প্রথম কংগ্রেস। একদিকে রাজনীতি অন্যদিকে প্রিয়তমা স্ত্রীর বাহুডোর। দিনভর চললো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।
একটি পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন সন্ধ্যার পর। নববধূ যখন বাসর ঘরে অধীর অপেক্ষায় তখন তিনি চড়ে বসেছেন ঢাকা অভিমুখী বাসে। রাজনীতির কাছে হার মানল স্ত্রীর বাহুডোর। পরদিন পৌঁছালেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে ন্যাপের সম্মেলনে।
সম্মেলন শেষে নেতৃত্ব নির্বাচন পালা যখন এলো তখন মওলানা ভাসানী তার দিকে ইশারা করে সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফরকে বললেন- চট্টগ্রামের ওই ছেলেটিকে সামনে আসতে বলো। সে কংগ্রেসেই তিনি নির্বাচিত হলেন চারজন সাংগঠনিক সম্পাদকের একজন। জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। মওলানা ভাসানীর নির্দেশনা ও জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে যোগ দেন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে। সাংগঠনিক দক্ষতা ও শ্রমিকদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে নোমানকে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সহসভাপতির দায়িত্ব দেন জিয়াউর রহমান। শুরু হয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তার পথচলা। পরে তিনি চট্টগ্রাম জেলা সাংগঠনিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংগঠনিক কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান।
১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিপথগামী কিছু সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন জিয়াউর রহমান। হত্যাকারীরা জিয়াউর রহমানের লাশ লুকিয়ে রাখে রাঙ্গুনিয়ার একটি পাহাড়ের পাদদেশে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তৎকালীন সিনিয়র কর্মকর্তা ও পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ সেখান থেকে উদ্ধার ও উত্তোলন করেন জিয়াউর রহমানের লাশ। খবর পেয়ে দ্রুতই সেখানে ছুটে যান নোমান। পথ আগলে দেখতে চান প্রিয় নেতার মরদেহ। নোমানকে চিনতেন না সেনা কর্মকর্তা হান্নান শাহ। তাই রাগান্বিত কণ্ঠে জানতে চান- হু আর ইউ?
ধীরস্থির চরিত্রের নোমান দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, আই এ্যাম আবদুল্লাহ আল নোমান। নাম শুনেই নোমানকে চিনতে পেরে হান্নান শাহ বলেছিলেন, সময় ভালো না- সাবধানে থাকেন। জিয়ার মৃত্যুর পর একপর্যায়ে রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। চাপ এবং লোভের কাছে নতি স্বীকার করে তার দলে যোগ দিতে থাকেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। চাপ ও লোভের কাছে নতি স্বীকার করাতে না পেরে নোমানকে কারাগারে পাঠায় এরশাদ সরকার। কিন্তু জামিনে মুক্তি পেয়েই তিনি সক্রিয় হন রাজনীতিতে। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে। শ্রমিক দলের সভাপতি হিসেবে শ্রমিকদের সংগঠিত করেছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। এরশাদের পতনের পর বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান। চলতি বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর গঠিত কমিটিতেও তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যানের।
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন নোমান। দায়িত্ব পান পরিবেশ ও বন, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ নির্বাচনে জিতলেও একই বছরের সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি। ১৯৯৯ সালে তিনি ও সাদেক হোসেন খোকা একই সঙ্গে ঢাকার রাজপথে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকালে গুলিবিদ্ধ হন। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচিত হলে দায়িত্ব পান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের। বিএনপির তিন সরকারের আমলে ১০ বছরের বেশি মন্ত্রিত্ব করেছেন তিনি। কেবল রাজনীতি নয়, সাংস্কৃতিক চর্চা ও খেলাধুলায়ও সমান দক্ষ নোমান। ফুটবলের জন্যই কাজেম আলী স্কুল থেকে টিসি নিয়ে নোমানকে নিজেদের স্কুলে নিয়ে আসে রাউজান স্কুল এবং বিনা ফিতে তাকে ভর্তি করায়। তরুণ বয়সে নাটক করতেন আবদুল্লাহ আল নোমান।
তখন নারী অভিনেত্রী পাওয়া যেত না বলে নারী চরিত্রেও অভিনয় করতেন তিনি। স্কুল ও কলেজ জীবনে গল্প-কবিতাও লিখেছেন। ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নোমান। তার পিতা আহমেদ কবীর চৌধুরী সংস্কৃতি অন্ত্যপ্রাণ। এক চাচা আহমদ ছবির চৌধুরী অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সদস্য ও চট্টগ্রামের সভাপতি এবং এক চাচা কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা ছিলেন। নোমানের মেজো ভাই আবদুল্লাহ আল হারুন চট্টগ্রাম অবিভক্ত জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। পারিবারিক খেতাব চৌধুরী হলেও গণমানুষের রাজনীতি করতে গিয়ে সে খেতাব ব্যবহার করেননি আবদুল্লাহ আল নোমান।
তার স্ত্রী তাসমীন আরা নোমান একজন অধ্যাপক। ছেলে সাঈদ আল নোমান অক্সফোর্ড ও এলএসই গ্র্যাজুয়েট। সাঈদের স্ত্রী সাজিয়া আবদুল্লাহ ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক এবং বর্তমানে ইনসাইড অ্যান্ড আইডিয়াস মার্কেট অ্যানালিস্ট হিসেবে কর্মরত। ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকও তিনি। মেয়ে ডা. তাজিন নোমান উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত। মেয়ে জামাতা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. সাদিদুল হক যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে কর্মরত। এমজমিন