ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ত্রিবেনী ইউনিয়নের ত্রিবেনী শ্মশানঘাট এলাকায় ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। নিহতরা চরমপন্থী দলের সদস্য বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
ঘটনাস্থল থেকে রাতেই ৬ রাউন্ড গুলি ও ২টি পালসার গাড়িসহ মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতদের মাথায় গুলির চিহ্ন রয়েছে।
নিহতরা হলেন, ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দীনের ছেলে হানিফ আলী (৫৬), শ্রীরামপুর গ্রামের উম্মাদ আলীর ছেলে লিটন (৩৫) ও কুষ্টিয়া দৌলতপুর এলাকার আরজেদ আলীর ছেলে রাইসুল ইসলাম রাজু (২৫)।
নিহত হানিফ আলী নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক কমান্ডার। তার বিরুদ্ধে ১৩টি হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে রাতেই হত্যার দায় স্বীকার করে রাতেই স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে একটি বিবৃতি পাঠানো হয়। জাসদ গণবাহিনীর কালু পরিচয় দিয়ে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এতদ্বারা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা ,কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনাবাসীর উদ্দেশ্যে জানানো যাইতেছে যে, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারি, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিণাকুন্ডু নিবাসী মো. হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। তাদের লাশ রামচন্দ্রপুর ও পিয়ারপুর ক্যানালের পাশে রাখা আছে। অত্র অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো, অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। কালু জাসদ গণবাহিনী।’
ত্রিবেনী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম জানান, রাত ৮টার পরে তারা মাঠের দিকে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পান। তবে ভয়ে আর কেউ ঘর থেকে বের হননি। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিছু সময় পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনটি মরদেহ ও দুইটি মোটরসাইকেল পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর তারা পুলিশে খবর দেন।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, দীর্ঘদিন ধরে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) ও জাসদ গণবাহিনী নামে দুইটি চরমপন্থী দলের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। শুক্রবার রাতে রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে যায় প্রতিপক্ষরা। জাসদ গণবাহিনীর শীর্ষ নেতা কালুর নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছেন পুলিশ ও স্থানীয়রা। কালু নিজেও এই হত্যার কথা মুটোফোনে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে স্বীকার করেন। কালুর বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুর গ্রামে। নিহত হানিফ বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৪টি হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে।
নিহত হানিফ আলী সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি ছিলেন। হরিণাকুন্ডু উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামের আব্দুর রহমান হত্যা মামলায় তার ফাঁসির আদেশ হয়। পরে তিনি সাধারণ ক্ষমা নিয়ে বাইরে আসেন। বাইরে এসেও তিনি বাহিনীর পরিচালনা করতেন।
শৈলকুপা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান বলেন, ‘প্রথমে আমাদের সোর্সের মাধ্যমে খবর পাই যে ওই এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এরপর ঘটনাস্থলে তিনজনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। মরদেহের পাশেদুইটি মোটরসাইকেল ছিল। নিহতরা চরমপন্থী ছিল। সন্ত্রাসীদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও আধিপত্য নিয়ে এই খুনোখুনির ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
নিহত হানিফ আলি সম্পর্কে যা জানা গেল
প্রায় ৫৫ বছর বয়সী হানিফ আলী ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দিনের ছেলে। হানিফ আলী দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধ (লাল পতাকার) আঞ্চলিক কমান্ডার। নব্বইয়ের দশেকে হত্যা ও ডাকাতির মাধ্যমে এলাকায় অপরাধজগতে একক আধিপত্ত বিস্তার করেন। হানিফের নামে হরিণাকুন্ডু, ঝিনাইদহ সদর, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ১৪টি হত্যা, অপহরণ ও ডাকাতির মামলা আছে। গত ৭-৮ বছর ধরে হরিণাকুন্ডুর নারায়নকান্দি কায়েতপাড়া বাওড় দখল করে মৎস্য চাষ করে আসছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে জেল থেকে বের হন হানিফ। পরে ২০১৮ সালে ওই বাওড়ের মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়াকে জবাই করে হত্যা করে বাওড়ের দখল নেন হানিফ। সম্প্রতি বাওড় দখলকে কেন্দ্র করে এলাকার কয়েকটি নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠনের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। এ কারণেই প্রতিপক্ষ জাসদ গণবাহিনী তাকে হত্যা করেছে বলে ধারণা এলাকাবাসীর। আর ওইসব মামলার মধ্যে উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামের আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার অপরাধে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। ওই ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা করে মাথা নিয়ে ফুটবল খেলেছিল বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। চরমপন্থী হানিফের এক ভাই হরিণাকুন্ডু উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আরেক ভাই উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা সেচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান সহসভাপতি। হানিফ নিজে হরিণাকুন্ডু উপজেলা মৎসজীবী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন।
উল্লেখ্য, গত ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর একই স্থানে পাঁচজনকে হত্যা করে ফেলে রাখার ঘটনা ঘটে।