একটি আদর্শ সমাজের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা। যে সমাজে মানুষের জীবন, সম্মান ও সম্পদের নিরাপত্তা থাকে না, তা আদর্শ সমাজ নয়। সে সমাজে কেউই সুখে-স্বস্তিতে বাস করতে পারে না। নিরাপত্তা আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ নিআমত। আল্লাহ তাআলার সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া বান্দা কখনোই নিজ প্রচেষ্টায় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। অতএব রাষ্ট্র ও সমাজে যেন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হয়, আল্লাহ তাআলার কাছে সকলে মিলে তা প্রার্থনা করা আবশ্যক।
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে মক্কা মুকাররমায় আসেন, তখন সেখানে কোনো জনবসতি ছিল না। জনমানবহীন মরুময় এ ভূমিতে তিনি বসতির গোড়াপত্তন করেন। সে সময় আল্লাহ তাআলার কাছে সর্বাগ্রে দুআ করেছিলেন, আল্লাহ যেন সে পুণ্যময় ভূমিকে সর্ববিচারে নিরাপদ করে দেন। কুরআন কারীমের বর্ণনায় তিনি এভাবে দুআ করেছিলেন : হে আমার প্রতিপালক! এটাকে এক নিরাপদ নগর বানিয়ে দিন এবং এর বাসিন্দাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান আনবে, তাদেরকে বিভিন্ন রকম ফলের রিযিক দান করুন। (সূরা বাকারা : ১২৬)।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে : হে আমার প্রতিপালক! এ নগরকে শান্তিপূর্ণ বানিয়ে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা করা থেকে রক্ষা করুন। (সূরা ইবরাহীম : ৩৫)। রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা মুকাররমা থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় আসেন, তখন মদীনায় বহুজাতিক লোকের বসবাস ছিল। এ বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর লোকেরা যেন একত্রে নিরাপদে বসবাস করতে পারে, পরস্পরে যেন হানাহানি লেগে না থাকে, সে লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) সকলের সন্তুষ্টি অনুযায়ী একটি চুক্তি করেন। যেটি মদীনা সনদ নামে পরিচিত। সে চুক্তির ধারাগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কতটা জোরদারভাবে মদীনার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন।
সেখানে মুসলিম-অমুসলিম সকলেরই সমান নিরাপত্তা অধিকার ছিল। কারো বিপক্ষে কারো অন্যায় পদক্ষেপ ওঠানোর কোনোই সুযোগ ছিল না। সেই চুক্তিতে উল্লেখিত ছিল, কোনো মুসলমান যদি কাউকে নিরাপত্তা দেয় (নিরাপত্তাপ্রাপ্ত যেই হোক,) সে নিরাপত্তা রক্ষা করা সকলের জন্য জরুরি। সেই চুক্তির ভাষ্য মোতাবেক যারা শর্তগুলো মেনে চলবে, তারা সকলেই তাদের প্রাপ্য অধিকার পাবে। আর যে অন্যায় ও অপরাধ করবে, সে যে-ই হোক, তার বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা অনুযায়ী বিচার হবে
সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) দশম হিজরীতে বিদায় হজ্বের খুতবায় জগদ্বাসীর উদ্দেশে এক অমোঘ বিধান হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন : তোমাদের পরস্পরের জীবন, সম্পদ ও সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম ও সম্মানিত, যেমন হারাম ও সম্মানিত আজকের এই দিনটি, এই শহর ও এই মাসটি। (সহীহ বুখারী : ১৭৩৯, ৬০৪৩)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) পবিত্র মুক্কা মুকাররমায় যিলহজ্ব মাসে আরাফার দিন এ খুতবা দেন। মক্কা মুকাররমা, যিলহজ্ব মাস এবং আরাফার দিনের সম্মান ও মর্যাদা সর্বজনবিদিত। এর যে কোনোটিরই অমর্যাদা করা হারাম। এগুলোর সঙ্গে তুলনা করে তিনি প্রত্যেক মুমিন-মুসলিমের জীবন, সম্মান ও সম্পদকেও পরস্পরের জন্য হারাম করেছেন।
যে কোনো মুসলমানের জান-মাল-ইযযতের মর্যাদা রক্ষা করা এবং এর অনিষ্ট সাধন না করা প্রত্যেকের জন্যই আবশ্যক। তাঁর এ শাশ্বত বাণী কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল এলাকার সব মুমিনের জন্যই এক চিরন্তন বিধান। এই একটিমাত্র হুকুমও যদি বাস্তবায়ন করা হয়, নিশ্চিতভাবেই মুসলিম সমাজের সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তার সুবাতাস বইতে থাকবে।
শাসকদের দায়িত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হলো, জনগণের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া। ইসলামে ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাপত্তার গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম প্রত্যেকেরই জান-মাল-ইযযতের সমান নিরাপত্তার বিধান আরোপ করেছে। কারো দ্বারা যেন অন্য কারো জীবন, সম্মান ও সম্পদের বিন্দুবিসর্গ ক্ষতিও না হয়, সেজন্য ইসলামী শরীয়তে অত্যন্ত কঠোর নীতিমালা রয়েছে। যারা এসবের কোনো এক ক্ষেত্রে অন্যের সামান্যতম ক্ষতিও করবে, আখেরাতে তাদের ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। কুরআন কারীমের অনেক আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদিস এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে।