বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারি কার্যক্রম শুরুর ১৩ কর্মদিবসের মধ্যেই ৪০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের বেশিরভাগই আগে কখনো করা হয়নি।
ভুক্তভোগীদের দেওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কার্যালয়ে গিয়ে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (আয়নাঘর) সন্ধান পেয়েছে কমিশন। এটি ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরের ভেতরেই অবস্থিত। দোতলা ওই ভবনে ২২টি সেল আছে। তবে ৫ আগস্টের পর সেখানকার অনেক তথ্যই মুছে ফেলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারির কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সভাপতি হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, সদস্য বিচারপতি মো. ফরিদ আহমদ শিবলী, মো. নূর খান, ড. নাবিলা ইদ্রিস, মো. সাজ্জাদ হোসেনসহ সংশ্লিষ্টরা।
সভাপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারি গুমের ঘটনা তদন্তে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করছে। কমিশনের কার্যপরিধি অনুযায়ী ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, শৃঙ্খলাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা এবং এধরনের যে কোনো বাহিনী বা সংস্থার কোনো সদস্য বা সরকারের সহায়তায় বা সম্মতিতে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি কর্তৃক ‘আয়না ঘর’ বা যে কোনো জ্ঞাত বা অজ্ঞাত স্থানে বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের সনাক্ত করা এবং কোনো পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিল তা নির্ধারণ করা এবং সে উদ্দেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যসহ যে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক যারা গুম হয়েছেন তাদের অভিযোগগুলো নিয়েই আমরা কাজ করেছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদেরও আমরা ডাকব। বক্তব্যের জন্য সমন দেব। অভিযুক্তরা না আসলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বেশি গুমের অভিযোগ এসেছে র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি ও সিটিটিসির বিরুদ্ধে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর আমরা ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘর পরিদর্শন করেছি। ১ অক্টোবর আমরা ডিবি ও সিটিটিসি পরিদর্শন করেছি। তবে সেখানে কোনো বন্দি আমরা পাইনি। সম্ভবত ৫ আগস্টের পর সেখানে থেকে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত কমিশনে ৪০০ জনের গুম সংক্রান্ত বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং ৭৫ জন সশরীরে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ইতোমধ্যে কমিশন ‘আয়না ঘর’, ডিবির জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল ও সিটিটিসি পরিদর্শন করেছে। এছাড়া তিনি পেনাল কোড, ১৮৬০ সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন।
৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভিযোগ জমা দেওয়ার সময় ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত এই সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা ভালো রেসপন্স পাচ্ছি। এরই মধ্যে আমরা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিটায়ার্ড আজমি, লেফটেন্টে কর্নেল হাসিব, অ্যাম্বাসেডর মারুফ জামান, হুম্মাম কাদের, সাবেক অফিসার ব্যারিস্টার সরোয়ার হোসেনসহ অনেকের অভিযোগ রেকর্ড করেছি। অনেকে ডাকযোগে পাঠিয়েছেন, অনেকে ইমেইলে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, এটি সময় সাপেক্ষ কাজ। প্রয়োজনে অভিযোগ নেওয়ার সময়সীমা আরও বাড়ানো হবে। তিন মাসে তদন্ত শেষ হবে কিনা সেটা সামনে বোঝা যাবে বলেও জানান তিনি।
কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ‘আমরা ভুক্তভোগীর পরিচয় দিয়ে তাকে আলাদা করব না। প্রতিটি অভিযোগ আমরা শুনতে চাই। কী হয়েছিল তা জানতে চাই। কীভাবে আইন না মেনে বন্দি করে রাখা হয়েছিল তা বুঝতে চাই।’
৪০০ অভিযোগের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনাই প্রথম সামনে এসেছে বলে জানান কমিশনের আরেক সদস্য ড. নাবিলা ইদ্রিস। তিনি বলেন, যারা অভিযোগ নিয়ে এসেছেন তাদেও বেশিরভাগই এর আগে কখনো গুম নিয়ে কথা বলেননি বা কোথাও অভিযোগ করেননি। অনেকের ক্ষেত্রে থানায় জিডিও (সাধারণ ডায়েরি) নেওয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন,‘আমরা সবাইকে কমিশনে আসতে আহ্বান জানাই। আমরা মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে চাই। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক অভিযোগ আসছে। কেউ আসতে না পারলে ডাকযোগে, ইমেইলে অভিযোগ পাঠাতে পারেন। আমরা সেগুলোও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখব। আমরা ফোন করে তাদের কথাগুলো শুনে নেব।’
কমিশনের সদস্য মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের ভিজিটের সময় ডিজিএফআইয়ের যে আয়নাঘর দেখেছি, তার সঙ্গে ভুক্তভোগীদের বর্ণনার মিল পেয়েছি। তবে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স (তথ্য প্রমাণ) তারা নষ্ট করেছে। বিশেষ করে দেয়ালের লেখাগুলো পেইন্ট করে মুছে দেওয়া হয়েছে। আমরা মৌখিকভাবে তাদের বলেছি এবং লিখিতভাবেও তাদের জানিয়েছি যেন যে অবস্থায় আমরা আয়নাঘর দেখে এসেছি, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার কোনো পরিবর্তন যেন না হয়।’
উল্লেখ্য, গত ২৭ আগস্ট এক গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কমিশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে ১৫ সেপ্টেম্বর সংশোধন করে গুম সংক্রান্ত কমিশন আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে।
কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্যের হাতে জোর করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য এই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে