বিদ্যালয়ের মুখ দেখলেও পড়া হয়নি হানিফের। ক্লাস ওয়ানে ভর্তির পরেই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। বাড়িতে রয়েছেন পঙ্গু বাবা, ছোট তিন ভাই আর মা। সংসারের চাকা ঘোরাতে কাজ নেয় রেস্টুরেন্টে। মাস শেষে পাওয়া বেতনের দেড় হাজার টাকার পুরোটাই তুলে দিতে হয় মায়ের হাতে। এদিকে একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করে চৌদ্দ বছরের আবু আহমদ। বাবা মারা যাওয়ার পরেই মাথার ছাদ সরে যায় নেমে আসে প্রখর রোদ্দুর। মা ও ছোট ভাই-বোনদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে নয় বছর বয়সে তাকে দু’হাতে হত্যা করতে হয় শৈশবের সব আকাঙ্ক্ষা। এমন অসংখ্য হানিফ, আবু আহমদ রয়েছে আমাদের এই নগরীতে। কেউ কাজ করে কারখানায়, কেউবা কাগজ, বোতল ও প্লাস্টিকের টুকরা কুড়িয়ে বিক্রি করে। কেবল পরিশ্রমই নয়, রয়েছে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও। প্রতিদিন রঙিন সব স্বপ্ন নিয়ে লাখো নিম্নবিত্ত মানুষ ভিড় করেন শহরে। স্বপ্ন পূরণে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের গ্রাম থেকে শহরে আসা। এমন স্বপ্নের প্রথম ধাপে পা রেখেই হোঁচট খান সহজ-সরল মানুষগুলো। নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে স্থান হয় বস্তির একটি ছোট্ট কুটিরে। তারপর ব্যস্ত শহরের স্বার্থপরতা বুঝতে বুঝতে ভাঙতে শুরু করে স্বপ্ন। অভাবের যাঁতাকলে পরে দিনমজুরের কাজ করতে হয় স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই। দু’জনের টাকা দিয়েও যখন সংসার চলে না তখন শুরু হয় সংকট। এ সংকট অর্থনৈতিক। যার সঙ্গে টাকার সম্পর্ক আছে। আর এ টাকার প্রয়োজনেই তখন পরিবারের ছোট শিশুটিকেও বাধ্য করা হয় শ্রমে। শিশুশ্রমিক হিসেবে বেড়ে ওঠার গল্পগুলো প্রায় এরকমই।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গত শুক্রবার পালিত হয়েছে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর ১২ জুন এই দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘শিশু শ্রমকে না বলুন, মানসম্মত শিক্ষাকে হ্যাঁ বলুন’।আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকরা প্রায় ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৪৭ ধরনের কাজকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে ব্যাটারিসহ বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক কারখানায় শিশুশ্রম, ট্যানারি শিল্প, যৌনকর্ম, বিড়ি ও তামাক ফ্যাক্টরি, পরিবহন খাত, ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ করা, গ্যাস ফ্যাক্টরি, লেদ মেশিন ও ওয়েল্ডিংয়ের কাজ, অটোমোবাইল কারখানা, লবণ কারখানা, রিকশা ও ভ্যানচালনা, কাঠমিস্ত্রির কাজ, জুয়েলারি শিল্পে কারিগরের কাজ, চাল ও মসলার কারখানায় কাজ, ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানার কাজ, মাদকদ্রব্য বিক্রি। এসব কাজে নিয়োজিতদের অধিকাংশই পথশিশু। শুধু একবেলা খাবার জোগাড় করতে এ পথশিশুরা দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। পথশিশুদের ৬৯ শতাংশই কোনো না কোনো শিশুশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। বছর ঘুরে বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধ দিবস আসে, চলেও যায়। শিশুশ্রম বন্ধ হয় না। বরং দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে শিশুদের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্রে যদি শিশুদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করতে না পারা যায় তাহলে তার প্রভাব ভবিষ্যত্ প্রজন্মের ওপর পড়বে। পৃথিবীব্যাপী শিশুরা বৈষম্যের শিকার। আমাদের দেশে এদের কাজের কোনো সময় নির্ধারণ নেই। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত, অর্থাত্ ঘুমানোর আগ পর্যন্ত এদের কাজ করতে হয়। এই কাজের ক্ষেত্রে কেউ বেতন পায়, কেউ বা শুধুই পেটেভাতে। অথচ স্বাধীনতা অর্জনের পর সুখী, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে তত্কালীন সরকার সর্বক্ষেত্রে সকল শিশুকে পূর্ণ মর্যাদাবান মানুষরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। যার প্রতিফলন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত রয়েছে। শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও শিশুর উপর সহিংসতা বন্ধ করে শিশুকে সুন্দর ভবিষ্যত্ গড়ে দিতে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। সৃষ্টি করা হচ্ছে সচেতনতা। গঠিত হচ্ছে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরাম। নির্যাতিত শিশু উদ্ধার ও পুনর্বাসনেও কাজ শুরু করেছে বিভিন্ন সংগঠন। প্রশাসনও তত্পর হয়ে উঠেছে। এখন এই প্রবণতাকে আরও বেগবান করে দেশকে শিশুবান্ধব করে তোলার সুযোগ হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব একযোগে ভূমিকা রাখলে শিশুদের জন্য নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব।