ইহজাগতিক শাস্তি তিন ধরনের
ইসলামী শরিয়ত জাগতিক যেসব শাস্তির নির্দেশ দিয়েছে, তা তিন ধরনের :
১. কিছু অপরাধের শাস্তি ইসলাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। তবে তা কার্যকর করার দায়িত্ব অপরাধীর নিজের ওপর ন্যস্ত করেছে।
ইহজাগতিক শাস্তি তিন ধরনের
ইসলামী শরিয়ত জাগতিক যেসব শাস্তির নির্দেশ দিয়েছে, তা তিন ধরনের :
১. কিছু অপরাধের শাস্তি ইসলাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। তবে তা কার্যকর করার দায়িত্ব অপরাধীর নিজের ওপর ন্যস্ত করেছে।
ইসলামী শরিয়ত কিসাস ছাড়াও সাত ধরনের অপরাধের শাস্তি (হদ) নির্ধারণ করে দিয়েছে। যথা :
ক) ব্যভিচার বা তত্সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিধান।
গ) বিবাহিত নারী-পুরুষের ব্যভিচারে রজম (প্রস্তারাঘাত করে হত্যা)-এর শাস্তি। (বুখারি, হাদিস : ৬৮২৯; মুসলিম, হাদিস : ৪৩১০; তিরমিজি, হাদিস : ১৪৫৪)
ঘ) যথোপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে চোরের হাত কাটা। (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৩৮)
ঙ) ডাকাতি, সন্ত্রাস কিংবা সমাজে নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীকে শূলে চড়িয়ে হত্যা, নতুবা বিপরীত দিকের হাত-পা কেটে দেওয়া অথবা দেশান্তর করা। (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৩৩)
চ) মদপানকারীকে ৮০ বেত্রাঘাত করা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৩৪৬; আবু দাউদ, হাদিস : ৪৪৭৯)
ছ) ইসলাম ধর্ম ত্যাগকারী মুরতাদের শাস্তি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৮৭৮)
আইন প্রয়োগের অধিকার কার
ইসলামী শরিয়ত আইন প্রয়োগের ক্ষমতা সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেয়নি। এমনকি কোনো মসজিদের ইমাম, মুফতি ও সমাজপতিদের ওপর আইন প্রয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করেনি। কোনো মানুষ অপরাধ করলে তার বিচার রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার মাধ্যমেই হবে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘জাকাত, হদ (নির্ধারিত শাস্তি), ফাই (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) ও জুমা সুলতানের (রাষ্ট্রের) দায়িত্ব।’ (আহকামুল কোরআন লিল জাসসাস, পৃষ্ঠা ১৩১)
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, স্বাধীন মানুষের ওপর রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা তাঁর নিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ আইন প্রয়োগ করতে পারবে না। কেননা নবী করিম (সা.)-এর যুগে তাঁর অনুমতি ছাড়া এবং মুসলিম খলিফাদের শাসনামলে তাঁদের অনুমতি ছাড়া কোনো হদ জারি করা হয়নি। (আল-উম্ম : ৬/১৫৪)
ফাতাওয়া হিন্দিয়াতে এসেছে : ইসলামী শরিয়তের শাস্তি আরোপের শর্ত ও স্তম্ভ হলো, রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে শাস্তি প্রয়োগ করা। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ২/১৪৩)
ইসলামী আইন বিশ্বকোষে এসেছে : সব ইসলামী আইনজ্ঞ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে যিনি আইন প্রয়োগের ক্ষমতা রাখেন, তিনি হলেন রাষ্ট্রপ্রধান বা তাঁর প্রতিনিধি…। (আল-মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল-কুয়েতিয়্যাহ : ৫/২৮০)
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অপরাধ
ইসলামী শরিয়তের সুস্পষ্ট বিধান অনুসারে, সাধারণ মানুষের জন্য আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অতএব, প্রচলিত গণপিটুনির কারণ যা-ই হোক না কেন, ইসলামী শরিয়তে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এমন অপরাধে জড়িত সবাই আইনের আওতায় আসবে। ওমর (রা.)-এর শাসনামলে দেখা যায়, একজন নিরপরাধ বালককে হত্যা করার কারণে ওমর (রা.) সাত ব্যক্তিকে কিসাসের শাস্তি দিয়েছেন। তাদের বাড়ি ছিল ইয়েমেনের সানাআয়। এ বিষয়ে ওমর (রা.) বলেছিলেন, ‘যদি সানাআর সব মানুষ মিলে হত্যা করত তাহলে আমি সানাআর সব মানুষের ওপর কিসাসের হুকুম বাস্তবায়ন করতাম। অর্থাৎ সানাআর সব অধিবাসীকে হত্যা করতাম।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৮৯৬; নাসবুর রায়াহ : ৬/৩৬০; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস : ১৫৭০)
আইন প্রয়োগে বিশেষ সতর্কতা
ইসলামী শরিয়ত অপরাধের শাস্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দিয়ে শেষ করেনি; এর সঙ্গে সন্দেহাতীতভাবে তা প্রমাণিত হওয়ারও শর্ত দিয়েছে। সুতরাং কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে অভিযোগ পেলে তা প্রমাণের আগে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, রাষ্ট্রও তাকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাখে না। ইসলামী দণ্ডবিধির একটি মূলনীতি হলো, ‘সন্দেহ হদ বা শাস্তি রহিত করে।’ (কাওয়াইদুল ফিকহ)
পাশাপাশি অপরাধের চেয়ে যেন শাস্তি বেশি হয়ে না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা তাদের শাস্তি দিতে চাও তাহলে সেই পরিমাণ শাস্তি দাও, যতটুকু অন্যায় তোমাদের সঙ্গে করেছে…।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৬)
পরিশেষে ইসলামী শরিয়ত আইন প্রয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করেছে। তাই সাধারণ মানুষের জন্য আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই। আর এটাও সত্য যে রাষ্ট্রে যথাযথ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সাধারণ মানুষের আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।