ঢাকা ০৩:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাদকাসক্তি নিরসনে ইসলামের পদক্ষেপ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:২২:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ জুন ২০১৫
  • ৪৩৯ বার

মাদকাসক্তি বর্তমান সভ্য সমাজব্যবস্থায় চরম অশান্তির কারণ। মাদকাসক্তির প্রভাবে জাতির বিবেক ক্ষতবিক্ষত। এটি একবিংশ শতাব্দীর মারাত্মক অভিশাপ। মাদকাসক্তির কুফল বা প্রভাব জীবনের বহু দিক ও বিভাগকে আক্রান্ত করছে। এতে মানুষের নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করছে।

মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। মাদকাসক্তি সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ হওয়ায় সমাধানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধর্মে ও শাস্ত্রে মাদকতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলামেও প্রথম থেকে মাদকদ্রব্য ব্যবহার কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। বিভিন্ন নীতিশাস্ত্র ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে মাদকাসক্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। এ ছাড়া পুনর্বাসন, প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমেও মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাদকাসক্তি নিরসনের কিছু উপায়—

প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা : মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিরুপায় ও অসহায়। তাকে উদ্ধার বা মুক্তির জন্য দরকার প্রথমত সঙ্গদান অতঃপর চিকিৎসা। মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদক গ্রহণের পূর্বে একটি মূল্যবোধ লালন করে থাকে। কোনো দেব দুর্বিপাকে সে মূল্যবোধ হারিয়ে যায়। মূল্যবোধহীন অবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য মাদকের প্রতি আসক্ত হয়। এমতাবস্থায় কাউকে মাদকাসক্তি থেকে উদ্ধার করতে হলে প্রথমে মাদকবেষ্টিত পরিবেশ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। অতঃপর চিকিৎসামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে—

১. চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করা।
২. নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলা।
৩. সঙ্কটকালীন চিকিৎসা করা।
৪. ডোজ কমানো এবং ওভারডোজের মোকাবেলা করা।
৫. প্রত্যাহারজনিত উপসর্গের চিকিৎসা করা।
৬. মাদকমুক্ত করা।
৭. মনোচিকিৎসায় মানসিকতার উন্নতি ঘটানো।
৮. বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠন ও সংস্থার সহযোগিতা গ্রহণ করা।

পুনর্বাসনমূলক পদক্ষেপ : মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে আনা কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। এ ধরনের ব্যক্তিকে মাদকমুক্ত রাখতে তাকে যথার্থভাবে কর্মে পুনর্বাসন করতে হবে। এ জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে—

১. মাদকাসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা শেষে পারিবারিক পরিবেশে পুনর্বাসন করতে হবে। আদর-যত্ন-স্নেহ, ভালবাসা দিয়ে পরিবারকে আপন করে তুলতে হবে।

২. চিকিৎসাকেন্দ্রকে পারিবারিক পরিবেশের আদলে গড়ে তুলতে হবে।

৩. মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আকস্মিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

৪. মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাধীন রেখে মাদকের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ফলাফল অবহিত করতে হবে এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান করতে হবে।

৫. কোনো না কোনো কারণ ছাড়া কেউ মাদকের প্রতি আসক্ত হয় না। সুতরাং প্রত্যেকের যথার্থ কারণ নিরূপণ করে তাদের হারানো চাকরি, পেশা বা ব্যবসায়ে পুনর্বাসন করলে তারা মাদকমুক্ত জীবন ফিরে পাবে।

৬. কর্মহীন, বেকার, অলস লোকরাই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। তাদের অবসরকে কর্মে বিনিয়োগ করতে পারলে কর্মব্যস্ততার কারণে তারা সুস্থ থাকতে পারে। এ জন্য পরিকল্পিত উপায়ে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে কর্মে নিয়োগ করে ব্যস্ততা বাড়ানো প্রয়োজন।

৭. বর্তমান বহু বেসরকারি সেবা সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদের মাদকাসক্তমুক্ত সমাজ গঠনের দায়িত্ব প্রদান করলে প্রভূত কল্যাণ লাভ করা যেতে পারে।

মাদকাসক্তি নিরসনে ইসলামের পদক্ষেপ : আইয়্যামে জাহেলিয়াতে আরব দেশের মানুষের নিকট মদপান ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়, প্রিয় ও সম্ভ্রান্ত অভ্যাস। কিন্তু সে সময়েও কিছু পূত-পবিত্র চরিত্রের লোক ছিলেন যারা মদপান দূরের কথা মদকে ছুয়েও দেখতেন না। ইসলাম আগমনের পূর্বেই পুনর্বাসন এ সব লোকেরা মদপানকে সংযম ও পবিত্রতার পরিপন্থী বলে মনে করতেন।

ইসলাম আগমনের পর আরবদের চিরায়ত সামাজিক এ বদ অভ্যাসকে পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন করে দেয়া হয়। ইসলাম মদপানকে তিন ধাপে হারাম ঘোষণা করেছে।

ক. একবার হযরত উমর (রা.) আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন, “হে আল্লাহ! মদ সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট নির্দেশ দান করুন।” এর পর মদ সম্পর্কে প্রাথমিক নির্দেশ অবতীর্ণ হয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে— “লোকেরা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলে দাও, এতদু’ভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বেশি।”

খ. মদপান নিষিদ্ধ হওয়ার দ্বিতীয় দফা নির্দেশ আসে মুসলমানদের এবাদতে মনোযোগী হওয়ার ঘটনা থেকে। যখন মদপান বৈধ কিন্তু এর প্রভাবে এবাদতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ায় ঈমানদারদের অনেকেই এটি বর্জনের মানসিক প্রস্তুতিতে ছিলেন এমন সময় দ্বিতীয় দফা নির্দেশ দেয়া হয়।

প্রেক্ষাপটটি ছিল জনৈক সাহাবা মুসলমানদের এক যিয়াফতের দাওয়াত দেন। প্রথানুসারে খাওয়া-দাওয়ার পর ভরপুর মদপান করা হয়। তখন মাগরিবের নামাযের সময়। সকলে মিলে নামাজের প্রস্তুতি নিলেন এবং একজনকে ইমাম নিয়োগ করে নামাজ শুরু করলেন। কিন্তু উক্ত ইমাম নেশাগ্রস্ত হওয়ায় কিরাতে মারাত্মক ভুল পাঠ করলেন, যা ছিল মূল অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। তখন সচেতন মুসলমানরা বলতে লাগলেন, যে বস্তু আমাদের ও নামাজের মধ্যে বিঘ্ন ঘটায় তা কোনোমতেই উত্তম হতে পারে না। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে মদপান নিষিদ্ধের দ্বিতীয় দফা আয়াত নাযিল হয়।

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন নামাজের ধারেকাছেও যেয়ো না, যতক্ষণ না বুঝতে সক্ষম হও, যা কিছু তোমরা বলছ।”

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর যখন নামাজের সময় হতো, তখন মহানবী (সা.)-এর একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করতেন যে, “কোনো নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি নামাজে অংশগ্রহণ করবে না।”

গ. মাদক বা মদপান চূড়ান্তভাবে হারাম হওয়ার ব্যাপারেও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা বিদ্যমান ছিল। চূড়ান্তভাবে মদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে হযরত সা’দ (রা.) উল্লেখ করেছেন, একদা জনৈক আনসার তার বাড়িতে একটি ভোজের আয়োজন করে। উক্ত ভোজে আনসার ও মুহাজির উভয় শ্রেণীর সাহাবি আমন্ত্রিত ছিল, আমরা সেদিন ভোজ শেষে মদপান করলাম। যথারীতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। অতঃপর পরস্পরের নিকট দম্ভোক্তি করলাম। তখন জনৈক আমন্ত্রিত ব্যক্তি উটের একটি হাড় দিয়ে আমার নাকে আঘাত করল। এতে আমার নাক জখম হয়ে গেল। ঘটনাটি ছিল মদ একেবারে হারাম হওয়ার পূর্বে। এর কিছুদিন পরই আল্লাহ চূড়ান্তভাবে মদ হারাম হওয়ার ঘোষণা দেন। যেমন আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, বলিদানের বেদি এবং ভাগ্য নির্ধারণ সারসমূহ, এ সব শয়তানের অপবিত্র কার্য ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদের বিরত রাখতে চায়। অতএব তোমরা কি এখনো নিবৃত্ত হবে না?”

এ আয়াত দুটি নাযিল হওয়ার পর পরিষ্কারভাবে মদপান একেবারেই হারাম হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও মদের ভয়াবহতা ও ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় মদের ব্যবসায়, বেচাকেনা, মদের উৎপাদন, বণ্টনে বিরত ও বহন চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ অভিসম্পাত করেন মদের প্রতি এবং এমন প্রত্যেকের প্রতি যে তা পান করে, যে তা অন্যকে পান করায়, যে তা বিক্রি করে, যে তা ক্রয় করে, যে তা নিংড়ায়, যে নিংড়িয়ে তা উৎপাদন করে, যে তা বহন করে এবং যার নিকটে তা বহন করে। অপর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল মদ, মৃতপশু, শূকর এবং মূর্তি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।”

একবার হযরত ওমর (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মিম্বরে উঠে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “হে লোক সকল! মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আঙুর, খেজুর, মধু, গম ও যব এই পাঁচ প্রকার বস্তু দ্বারা মদ তৈরি হয়। মদ বলা হয় ওই বস্তুকে যা পান করলে মানুষের জ্ঞান লোপ পায়।” হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে অপর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “যার অধিক পরিমাণ ব্যবহারে নেশা হয়, তার সামান্য পরিমাণও হারাম।”

ইসলামের দৃষ্টিতে মাদকদ্রব্য সেবনের শাস্তি : মাদকদ্রব্য সেবন ইসলামে একেবারেই অবৈধ। হিজরি চতুর্থ সনে মাদকদ্রব্য সেবন চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ হয়। রাসূল (সা.)-এর যুগে মাদকাসক্ত কেন নিষিদ্ধ হয়? রাসূল (সা.)-এর যুগে মাদকাসক্তের কোনো নির্দিষ্ট শাস্তি প্রচলিত ছিল না। তবে কোনো কোনো বর্ণনায় এই অন্যায় ও বদ অভ্যাসের কারণে চল্লিশ দোররা পর্যন্ত শাস্তি দেয়া হতো বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত ওমর (রা.) তাঁর খিলাফতকালে মাদকাসাক্তদের শাস্তিস্বরূপ আশি দোররা নির্ধারণ করেছিলেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

মাদকাসক্তি নিরসনে ইসলামের পদক্ষেপ

আপডেট টাইম : ০৩:২২:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ জুন ২০১৫

মাদকাসক্তি বর্তমান সভ্য সমাজব্যবস্থায় চরম অশান্তির কারণ। মাদকাসক্তির প্রভাবে জাতির বিবেক ক্ষতবিক্ষত। এটি একবিংশ শতাব্দীর মারাত্মক অভিশাপ। মাদকাসক্তির কুফল বা প্রভাব জীবনের বহু দিক ও বিভাগকে আক্রান্ত করছে। এতে মানুষের নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করছে।

মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। মাদকাসক্তি সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ হওয়ায় সমাধানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধর্মে ও শাস্ত্রে মাদকতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলামেও প্রথম থেকে মাদকদ্রব্য ব্যবহার কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। বিভিন্ন নীতিশাস্ত্র ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে মাদকাসক্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। এ ছাড়া পুনর্বাসন, প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমেও মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাদকাসক্তি নিরসনের কিছু উপায়—

প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা : মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিরুপায় ও অসহায়। তাকে উদ্ধার বা মুক্তির জন্য দরকার প্রথমত সঙ্গদান অতঃপর চিকিৎসা। মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদক গ্রহণের পূর্বে একটি মূল্যবোধ লালন করে থাকে। কোনো দেব দুর্বিপাকে সে মূল্যবোধ হারিয়ে যায়। মূল্যবোধহীন অবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য মাদকের প্রতি আসক্ত হয়। এমতাবস্থায় কাউকে মাদকাসক্তি থেকে উদ্ধার করতে হলে প্রথমে মাদকবেষ্টিত পরিবেশ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। অতঃপর চিকিৎসামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে—

১. চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করা।
২. নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলা।
৩. সঙ্কটকালীন চিকিৎসা করা।
৪. ডোজ কমানো এবং ওভারডোজের মোকাবেলা করা।
৫. প্রত্যাহারজনিত উপসর্গের চিকিৎসা করা।
৬. মাদকমুক্ত করা।
৭. মনোচিকিৎসায় মানসিকতার উন্নতি ঘটানো।
৮. বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠন ও সংস্থার সহযোগিতা গ্রহণ করা।

পুনর্বাসনমূলক পদক্ষেপ : মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে আনা কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। এ ধরনের ব্যক্তিকে মাদকমুক্ত রাখতে তাকে যথার্থভাবে কর্মে পুনর্বাসন করতে হবে। এ জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে—

১. মাদকাসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা শেষে পারিবারিক পরিবেশে পুনর্বাসন করতে হবে। আদর-যত্ন-স্নেহ, ভালবাসা দিয়ে পরিবারকে আপন করে তুলতে হবে।

২. চিকিৎসাকেন্দ্রকে পারিবারিক পরিবেশের আদলে গড়ে তুলতে হবে।

৩. মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আকস্মিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

৪. মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাধীন রেখে মাদকের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ফলাফল অবহিত করতে হবে এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান করতে হবে।

৫. কোনো না কোনো কারণ ছাড়া কেউ মাদকের প্রতি আসক্ত হয় না। সুতরাং প্রত্যেকের যথার্থ কারণ নিরূপণ করে তাদের হারানো চাকরি, পেশা বা ব্যবসায়ে পুনর্বাসন করলে তারা মাদকমুক্ত জীবন ফিরে পাবে।

৬. কর্মহীন, বেকার, অলস লোকরাই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। তাদের অবসরকে কর্মে বিনিয়োগ করতে পারলে কর্মব্যস্ততার কারণে তারা সুস্থ থাকতে পারে। এ জন্য পরিকল্পিত উপায়ে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে কর্মে নিয়োগ করে ব্যস্ততা বাড়ানো প্রয়োজন।

৭. বর্তমান বহু বেসরকারি সেবা সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদের মাদকাসক্তমুক্ত সমাজ গঠনের দায়িত্ব প্রদান করলে প্রভূত কল্যাণ লাভ করা যেতে পারে।

মাদকাসক্তি নিরসনে ইসলামের পদক্ষেপ : আইয়্যামে জাহেলিয়াতে আরব দেশের মানুষের নিকট মদপান ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়, প্রিয় ও সম্ভ্রান্ত অভ্যাস। কিন্তু সে সময়েও কিছু পূত-পবিত্র চরিত্রের লোক ছিলেন যারা মদপান দূরের কথা মদকে ছুয়েও দেখতেন না। ইসলাম আগমনের পূর্বেই পুনর্বাসন এ সব লোকেরা মদপানকে সংযম ও পবিত্রতার পরিপন্থী বলে মনে করতেন।

ইসলাম আগমনের পর আরবদের চিরায়ত সামাজিক এ বদ অভ্যাসকে পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন করে দেয়া হয়। ইসলাম মদপানকে তিন ধাপে হারাম ঘোষণা করেছে।

ক. একবার হযরত উমর (রা.) আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন, “হে আল্লাহ! মদ সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট নির্দেশ দান করুন।” এর পর মদ সম্পর্কে প্রাথমিক নির্দেশ অবতীর্ণ হয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে— “লোকেরা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলে দাও, এতদু’ভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বেশি।”

খ. মদপান নিষিদ্ধ হওয়ার দ্বিতীয় দফা নির্দেশ আসে মুসলমানদের এবাদতে মনোযোগী হওয়ার ঘটনা থেকে। যখন মদপান বৈধ কিন্তু এর প্রভাবে এবাদতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ায় ঈমানদারদের অনেকেই এটি বর্জনের মানসিক প্রস্তুতিতে ছিলেন এমন সময় দ্বিতীয় দফা নির্দেশ দেয়া হয়।

প্রেক্ষাপটটি ছিল জনৈক সাহাবা মুসলমানদের এক যিয়াফতের দাওয়াত দেন। প্রথানুসারে খাওয়া-দাওয়ার পর ভরপুর মদপান করা হয়। তখন মাগরিবের নামাযের সময়। সকলে মিলে নামাজের প্রস্তুতি নিলেন এবং একজনকে ইমাম নিয়োগ করে নামাজ শুরু করলেন। কিন্তু উক্ত ইমাম নেশাগ্রস্ত হওয়ায় কিরাতে মারাত্মক ভুল পাঠ করলেন, যা ছিল মূল অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। তখন সচেতন মুসলমানরা বলতে লাগলেন, যে বস্তু আমাদের ও নামাজের মধ্যে বিঘ্ন ঘটায় তা কোনোমতেই উত্তম হতে পারে না। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে মদপান নিষিদ্ধের দ্বিতীয় দফা আয়াত নাযিল হয়।

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন নামাজের ধারেকাছেও যেয়ো না, যতক্ষণ না বুঝতে সক্ষম হও, যা কিছু তোমরা বলছ।”

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর যখন নামাজের সময় হতো, তখন মহানবী (সা.)-এর একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করতেন যে, “কোনো নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি নামাজে অংশগ্রহণ করবে না।”

গ. মাদক বা মদপান চূড়ান্তভাবে হারাম হওয়ার ব্যাপারেও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা বিদ্যমান ছিল। চূড়ান্তভাবে মদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে হযরত সা’দ (রা.) উল্লেখ করেছেন, একদা জনৈক আনসার তার বাড়িতে একটি ভোজের আয়োজন করে। উক্ত ভোজে আনসার ও মুহাজির উভয় শ্রেণীর সাহাবি আমন্ত্রিত ছিল, আমরা সেদিন ভোজ শেষে মদপান করলাম। যথারীতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। অতঃপর পরস্পরের নিকট দম্ভোক্তি করলাম। তখন জনৈক আমন্ত্রিত ব্যক্তি উটের একটি হাড় দিয়ে আমার নাকে আঘাত করল। এতে আমার নাক জখম হয়ে গেল। ঘটনাটি ছিল মদ একেবারে হারাম হওয়ার পূর্বে। এর কিছুদিন পরই আল্লাহ চূড়ান্তভাবে মদ হারাম হওয়ার ঘোষণা দেন। যেমন আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, বলিদানের বেদি এবং ভাগ্য নির্ধারণ সারসমূহ, এ সব শয়তানের অপবিত্র কার্য ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদের বিরত রাখতে চায়। অতএব তোমরা কি এখনো নিবৃত্ত হবে না?”

এ আয়াত দুটি নাযিল হওয়ার পর পরিষ্কারভাবে মদপান একেবারেই হারাম হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও মদের ভয়াবহতা ও ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় মদের ব্যবসায়, বেচাকেনা, মদের উৎপাদন, বণ্টনে বিরত ও বহন চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ অভিসম্পাত করেন মদের প্রতি এবং এমন প্রত্যেকের প্রতি যে তা পান করে, যে তা অন্যকে পান করায়, যে তা বিক্রি করে, যে তা ক্রয় করে, যে তা নিংড়ায়, যে নিংড়িয়ে তা উৎপাদন করে, যে তা বহন করে এবং যার নিকটে তা বহন করে। অপর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল মদ, মৃতপশু, শূকর এবং মূর্তি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।”

একবার হযরত ওমর (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মিম্বরে উঠে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “হে লোক সকল! মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আঙুর, খেজুর, মধু, গম ও যব এই পাঁচ প্রকার বস্তু দ্বারা মদ তৈরি হয়। মদ বলা হয় ওই বস্তুকে যা পান করলে মানুষের জ্ঞান লোপ পায়।” হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে অপর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “যার অধিক পরিমাণ ব্যবহারে নেশা হয়, তার সামান্য পরিমাণও হারাম।”

ইসলামের দৃষ্টিতে মাদকদ্রব্য সেবনের শাস্তি : মাদকদ্রব্য সেবন ইসলামে একেবারেই অবৈধ। হিজরি চতুর্থ সনে মাদকদ্রব্য সেবন চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ হয়। রাসূল (সা.)-এর যুগে মাদকাসক্ত কেন নিষিদ্ধ হয়? রাসূল (সা.)-এর যুগে মাদকাসক্তের কোনো নির্দিষ্ট শাস্তি প্রচলিত ছিল না। তবে কোনো কোনো বর্ণনায় এই অন্যায় ও বদ অভ্যাসের কারণে চল্লিশ দোররা পর্যন্ত শাস্তি দেয়া হতো বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত ওমর (রা.) তাঁর খিলাফতকালে মাদকাসাক্তদের শাস্তিস্বরূপ আশি দোররা নির্ধারণ করেছিলেন।