ঢাকা ০৭:২৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
সংবাদ প্রকাশের পরও গুরুত্ব দেয়নি এলজিইডি, ব্রীজের এ্যাপ্রোচ এখন নদীতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে মিললো বিশাল সুখবর শরতে কাশফুলের রাজ্যে টানা ৪ দিনের ছুটিতে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় মধ্যরাত থেকে ২২ দিন ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ বাফুফে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেন যারা শেখ হাসিনার ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ নিয়ে যা বললেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এমন দেশ গড়তে চাই, সব সম্প্রদায়ের সমান অধিকারের বাংলাদেশ : প্রধান উপদেষ্টা- জ্বালানি সংকট দূর করতে বাপেক্স আরও ১৫০ কূপ খনন করবে: জ্বালানি উপদেষ্টা ইংল্যান্ড আমাদের সঙ্গে ৮০০ করে, বাংলাদেশও হারায়

মেট্রোরেলের কোম্পানি চলে আপন খুশিতে, পাত্তা পায় না কর্তৃপক্ষ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:০৭:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ১১ বার

রাজধানীতে জনপ্রিয় গণপরিবহন মেট্রোরেল এবং এর যাত্রীদের বিমা করা হয়নি দেড় বছরেও। তৃতীয় পক্ষ থেকে এখনো নিরাপত্তা সনদ নেয়নি মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। রাজধানীর গণপরিবহনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এসব বিষয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও সাড়া বা যথাযথ কাগজপত্র পায়নি।

ডিএমটিসিএল চলছে নিজের মতো। এ ছাড়া বাধ্যবাধকতা থাকলেও ডিটিসিএ থেকে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল স্টেশন পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণ পরিকল্পনার অনুমোদন নেয়নি ডিএমটিসিএল। ডিএমটিসিএল ও ডিটিসিএর একাধিক সভার কার্যবিবরণী এবং এ দুই সংস্থার মধ্যে চালাচালি হওয়া চিঠি থেকে এসব জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারিগরি কারণে জানমালের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে, এর বিধান জরুরি। বিমা করা থাকলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে দুটি স্টেশন ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ নিয়ে সরকারকে ভাবতে হতো না।

ডিএমটিসিএল বলছে, থার্ড পার্টি যাত্রীবিমা করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষাধীন রয়েছে। তৃতীয় পক্ষ থেকে নিরাপত্তা সনদ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা মেট্রোরেল আইনে নেই।

যানজটের রাজধানীতে চলাচলে দুর্ভোগ কমাতে ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাণিজ্যিকভাবে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হয় মেট্রোরেল। পরে ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশ চালু হয়। ডিএমটিসিএল বলছে, ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-৬-এ প্রতিদিন গড়ে পৌনে ৩ লাখ মানুষ যাতায়াত করছেন। এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। বর্তমানে মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশের কাজ চলছে। সম্প্রতি নির্মাণব্যয় বাড়িয়ে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা করা হয়েছে।

মেট্রোরেল আইন-২০১৫ এবং মেট্রোরেল বিধিমালা-২০১৬ অনুসারে ডিটিসিএ হলো মেট্রোরেলের কর্তৃপক্ষ এবং ডিএমটিসিএল হলো লাইসেন্সি (লাইসেন্স গ্রহীতা) ও অপারেটর অর্থাৎ মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানি। ডিটিসিএর অন্যতম দায়িত্ব হলো মেট্রোরেলের যাত্রীসেবার মান, সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ তদারকি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি। ডিটিসিএ সূত্র বলছে, এসব নিয়ে ডিটিসিএকে গ্রাহ্য করেনি ডিএমটিসিএল। ডিএমটিসিএলের শীর্ষ কর্মকর্তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ছত্রচ্ছায়ায় মেট্রোরেল পরিচালনায় একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

ডিটিসিএর একটি চিঠি থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ২১ আগস্ট বাণিজ্যিক চলাচল শুরুর আগে ডিএমটিসিএলের নেওয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাসংক্রান্তবিষয়ক সভায় মেট্রোরেলের বিমা করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে ২০২৩ সাল থেকে ডিটিসিএ একাধিক চিঠি পাঠালেও ডিএমটিসিএল এখনো এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়নি। বিমা না থাকার কারণে গত ২৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ভাঙচুর হওয়া মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশন দুটি মেরামত করতে সরকারকে টাকা দিতে হবে। বিমা করা থাকলে এই টাকা দিত বিমা কোম্পানি। ফলে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হতো।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বলেন, কারিগরি কারণে যদি জানমালের কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে তার ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেবে, তার একটা বিধান অবশ্যই জরুরি ছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লিখিত প্রশ্নের জবাবে গতকাল রোববার ডিএমটিসিএল আজকের পত্রিকাকে বলেছে, তৃতীয় পক্ষের যাত্রীবিমা করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষাধীন রয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিককে হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন প্রশ্ন পাঠানো হলে গতকাল এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়।

মেট্রোরেল বিধিমালা অনুসারে ডিএমটিসিএল বরাবর প্রতি তিন মাস অন্তর নিরাপত্তা প্রতিবেদন ডিটিসিএতে জমা দিতে হবে। কিন্তু ডিএমটিসিএল প্রায় দেড় বছরে একবারও দেয়নি। ডিটিসিএ সূত্র বলছে, মেট্রোরেল পরিচালনার বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনকেডিএম ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তাদের কাছে নিরাপত্তা সনদের জন্য বারবার তাগাদা দিয়েছে।

ডিএমটিসিএলের একটি চিঠি থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ৬ মার্চ সংস্থাটি নিরাপত্তা সনদ দিতে ডিটিসিএ বরাবর আবেদন করেছিল। কিন্তু ডিটিসিএ জানায়, মেট্রোরেল আইন এবং মেট্রোরেল বিধিমালা অনুযায়ী তারা এ ধরনের সনদ দিতে পারে না। পরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় গঠিত একটি কমিটির সুপারিশে এমআরটি লাইন-৬-এর উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের বিভিন্ন সাব-সিস্টেমের কারিগরি বিষয়ে অনুমোদন দেয় ডিটিসিএ। কিন্তু তখন ডিএমটিসিএল কোনো ‘সিস্টেম সেফটি সার্টিফিকেট’ দেয়নি বলে জানায় ডিটিসিএ।

ডিএমটিসিএলকে নিরাপত্তা সনদ নিতে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে (তৃতীয় পক্ষ) নিয়োগের মতামত দিয়েছিল ডিটিসিএ। তবে তা করা হয়নি।

এ বিষয়ে লিখিত প্রশ্নের জবাবে ডিএমটিসিএল বলেছে, সর্বশেষ নিরাপত্তা প্রতিবেদন তৈরি প্রক্রিয়াধীন। সিস্টেম সেফটি সার্টিফিকেট ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর ও ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সিস্টেম সেফটি সনদ নেওয়ার বিষয়টি মেট্রোরেল আইনে নেই।

ডিএমটিসিএল ও ডিটিসিএর সভার কার্যবিবরণী ও চিঠি থেকে জানা যায়, মেট্রোরেল বিধিমালা, ২০১৬-এর বিধি ২৪ অনুযায়ী, ডিএমটিসিএলকে মেট্রোরেল নির্মাণের সার্বিক পরিকল্পনা ও নকশা ডিটিসিএতে অনুমোদনের জন্য আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এমআরটি লাইন-৬-এর নির্মাণের আবেদনে পরিকল্পনার কপি যথাযথভাবে পাওয়া যায়নি। এ-সংক্রান্ত চিঠির তথ্যও সঠিকভাবে দেয়নি। নথিপত্রে দেখা গেছে, এমআরটি লাইন-৬-এর উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ সচিবালয় স্টেশনগুলোর লে-আউট ড্রয়িং জমা দেয়নি ডিএমটিসিএল। এ কারণে কয়েকটি স্টেশনের নামার জায়গা পাওয়া যায়নি ও ফুটপাতে পথচারীদের হাঁটার জায়গা বন্ধ বা সংকুচিত হয়েছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানি সরাসরি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিত। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেও পাত্তা দেয়নি। অনেক সিদ্ধান্ত ডিটিসিএ থেকে অনুমোদন নেওয়ার কথা থাকলে নেওয়া হয়নি। অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। যাত্রীসেবা দিলেও কোম্পানি হিসেবে কারিগরি অনেক বিষয় আড়াল করেছে ডিএমটিসিএল।

ডিটিসিএ সূত্র বলেছে, ডিটিসিএ ২০২০ সাল থেকে ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্যান্ডার্ড নিতে ডিএমটিসিএল বরাবর একাধিকবার চিঠি দিলেও শুরুতে সাড়া পায়নি। পরে বাধ্য হয়ে ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্যান্ডার্ড অনুমোদন করে। ডিটিসিএতে এর আবেদন পাঠানো হয়েছিল ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর। ছয় মাস পরপর এর মেয়াদ বাড়াতে হয়। কিন্তু এরপর তা বাড়ানোর আবেদন করেনি ডিএমটিসিএল।

এ বিষয়ে ডিএমটিসিএল বলেছে, ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্যান্ডার্ড বলবৎ আছে। বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে ডিটিসিএতে পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) নীলিমা আখতার আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাঁরা একটা দল গঠন করবেন। যারা শিগগির ধাপে ধাপে ডিএমটিসিএলের বিষয়গুলো দেখবে।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, ডিএমটিসিএল পরিচালনায় থাকা অনেকের রেলভিত্তিক সেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। ডিএমটিসিএলে শুরু থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়মের তথ্য উঠেছে।

ডিএমটিসিএলের প্রথম কমিটির পরিচালক ছিলেন ড. শামসুল হক। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা এটি পরিচালনার জন্য অন্তত ২০ বছরের রেলওয়ের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সংবাদ প্রকাশের পরও গুরুত্ব দেয়নি এলজিইডি, ব্রীজের এ্যাপ্রোচ এখন নদীতে

মেট্রোরেলের কোম্পানি চলে আপন খুশিতে, পাত্তা পায় না কর্তৃপক্ষ

আপডেট টাইম : ১১:০৭:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজধানীতে জনপ্রিয় গণপরিবহন মেট্রোরেল এবং এর যাত্রীদের বিমা করা হয়নি দেড় বছরেও। তৃতীয় পক্ষ থেকে এখনো নিরাপত্তা সনদ নেয়নি মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। রাজধানীর গণপরিবহনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এসব বিষয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও সাড়া বা যথাযথ কাগজপত্র পায়নি।

ডিএমটিসিএল চলছে নিজের মতো। এ ছাড়া বাধ্যবাধকতা থাকলেও ডিটিসিএ থেকে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল স্টেশন পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণ পরিকল্পনার অনুমোদন নেয়নি ডিএমটিসিএল। ডিএমটিসিএল ও ডিটিসিএর একাধিক সভার কার্যবিবরণী এবং এ দুই সংস্থার মধ্যে চালাচালি হওয়া চিঠি থেকে এসব জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারিগরি কারণে জানমালের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে, এর বিধান জরুরি। বিমা করা থাকলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে দুটি স্টেশন ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ নিয়ে সরকারকে ভাবতে হতো না।

ডিএমটিসিএল বলছে, থার্ড পার্টি যাত্রীবিমা করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষাধীন রয়েছে। তৃতীয় পক্ষ থেকে নিরাপত্তা সনদ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা মেট্রোরেল আইনে নেই।

যানজটের রাজধানীতে চলাচলে দুর্ভোগ কমাতে ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাণিজ্যিকভাবে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হয় মেট্রোরেল। পরে ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশ চালু হয়। ডিএমটিসিএল বলছে, ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-৬-এ প্রতিদিন গড়ে পৌনে ৩ লাখ মানুষ যাতায়াত করছেন। এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। বর্তমানে মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশের কাজ চলছে। সম্প্রতি নির্মাণব্যয় বাড়িয়ে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা করা হয়েছে।

মেট্রোরেল আইন-২০১৫ এবং মেট্রোরেল বিধিমালা-২০১৬ অনুসারে ডিটিসিএ হলো মেট্রোরেলের কর্তৃপক্ষ এবং ডিএমটিসিএল হলো লাইসেন্সি (লাইসেন্স গ্রহীতা) ও অপারেটর অর্থাৎ মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানি। ডিটিসিএর অন্যতম দায়িত্ব হলো মেট্রোরেলের যাত্রীসেবার মান, সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ তদারকি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি। ডিটিসিএ সূত্র বলছে, এসব নিয়ে ডিটিসিএকে গ্রাহ্য করেনি ডিএমটিসিএল। ডিএমটিসিএলের শীর্ষ কর্মকর্তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ছত্রচ্ছায়ায় মেট্রোরেল পরিচালনায় একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

ডিটিসিএর একটি চিঠি থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ২১ আগস্ট বাণিজ্যিক চলাচল শুরুর আগে ডিএমটিসিএলের নেওয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাসংক্রান্তবিষয়ক সভায় মেট্রোরেলের বিমা করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে ২০২৩ সাল থেকে ডিটিসিএ একাধিক চিঠি পাঠালেও ডিএমটিসিএল এখনো এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়নি। বিমা না থাকার কারণে গত ২৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ভাঙচুর হওয়া মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশন দুটি মেরামত করতে সরকারকে টাকা দিতে হবে। বিমা করা থাকলে এই টাকা দিত বিমা কোম্পানি। ফলে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হতো।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বলেন, কারিগরি কারণে যদি জানমালের কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে তার ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেবে, তার একটা বিধান অবশ্যই জরুরি ছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লিখিত প্রশ্নের জবাবে গতকাল রোববার ডিএমটিসিএল আজকের পত্রিকাকে বলেছে, তৃতীয় পক্ষের যাত্রীবিমা করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষাধীন রয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিককে হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন প্রশ্ন পাঠানো হলে গতকাল এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়।

মেট্রোরেল বিধিমালা অনুসারে ডিএমটিসিএল বরাবর প্রতি তিন মাস অন্তর নিরাপত্তা প্রতিবেদন ডিটিসিএতে জমা দিতে হবে। কিন্তু ডিএমটিসিএল প্রায় দেড় বছরে একবারও দেয়নি। ডিটিসিএ সূত্র বলছে, মেট্রোরেল পরিচালনার বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনকেডিএম ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তাদের কাছে নিরাপত্তা সনদের জন্য বারবার তাগাদা দিয়েছে।

ডিএমটিসিএলের একটি চিঠি থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ৬ মার্চ সংস্থাটি নিরাপত্তা সনদ দিতে ডিটিসিএ বরাবর আবেদন করেছিল। কিন্তু ডিটিসিএ জানায়, মেট্রোরেল আইন এবং মেট্রোরেল বিধিমালা অনুযায়ী তারা এ ধরনের সনদ দিতে পারে না। পরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় গঠিত একটি কমিটির সুপারিশে এমআরটি লাইন-৬-এর উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের বিভিন্ন সাব-সিস্টেমের কারিগরি বিষয়ে অনুমোদন দেয় ডিটিসিএ। কিন্তু তখন ডিএমটিসিএল কোনো ‘সিস্টেম সেফটি সার্টিফিকেট’ দেয়নি বলে জানায় ডিটিসিএ।

ডিএমটিসিএলকে নিরাপত্তা সনদ নিতে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে (তৃতীয় পক্ষ) নিয়োগের মতামত দিয়েছিল ডিটিসিএ। তবে তা করা হয়নি।

এ বিষয়ে লিখিত প্রশ্নের জবাবে ডিএমটিসিএল বলেছে, সর্বশেষ নিরাপত্তা প্রতিবেদন তৈরি প্রক্রিয়াধীন। সিস্টেম সেফটি সার্টিফিকেট ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর ও ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সিস্টেম সেফটি সনদ নেওয়ার বিষয়টি মেট্রোরেল আইনে নেই।

ডিএমটিসিএল ও ডিটিসিএর সভার কার্যবিবরণী ও চিঠি থেকে জানা যায়, মেট্রোরেল বিধিমালা, ২০১৬-এর বিধি ২৪ অনুযায়ী, ডিএমটিসিএলকে মেট্রোরেল নির্মাণের সার্বিক পরিকল্পনা ও নকশা ডিটিসিএতে অনুমোদনের জন্য আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এমআরটি লাইন-৬-এর নির্মাণের আবেদনে পরিকল্পনার কপি যথাযথভাবে পাওয়া যায়নি। এ-সংক্রান্ত চিঠির তথ্যও সঠিকভাবে দেয়নি। নথিপত্রে দেখা গেছে, এমআরটি লাইন-৬-এর উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ সচিবালয় স্টেশনগুলোর লে-আউট ড্রয়িং জমা দেয়নি ডিএমটিসিএল। এ কারণে কয়েকটি স্টেশনের নামার জায়গা পাওয়া যায়নি ও ফুটপাতে পথচারীদের হাঁটার জায়গা বন্ধ বা সংকুচিত হয়েছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানি সরাসরি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিত। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেও পাত্তা দেয়নি। অনেক সিদ্ধান্ত ডিটিসিএ থেকে অনুমোদন নেওয়ার কথা থাকলে নেওয়া হয়নি। অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। যাত্রীসেবা দিলেও কোম্পানি হিসেবে কারিগরি অনেক বিষয় আড়াল করেছে ডিএমটিসিএল।

ডিটিসিএ সূত্র বলেছে, ডিটিসিএ ২০২০ সাল থেকে ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্যান্ডার্ড নিতে ডিএমটিসিএল বরাবর একাধিকবার চিঠি দিলেও শুরুতে সাড়া পায়নি। পরে বাধ্য হয়ে ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্যান্ডার্ড অনুমোদন করে। ডিটিসিএতে এর আবেদন পাঠানো হয়েছিল ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর। ছয় মাস পরপর এর মেয়াদ বাড়াতে হয়। কিন্তু এরপর তা বাড়ানোর আবেদন করেনি ডিএমটিসিএল।

এ বিষয়ে ডিএমটিসিএল বলেছে, ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্যান্ডার্ড বলবৎ আছে। বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে ডিটিসিএতে পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) নীলিমা আখতার আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাঁরা একটা দল গঠন করবেন। যারা শিগগির ধাপে ধাপে ডিএমটিসিএলের বিষয়গুলো দেখবে।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, ডিএমটিসিএল পরিচালনায় থাকা অনেকের রেলভিত্তিক সেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। ডিএমটিসিএলে শুরু থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়মের তথ্য উঠেছে।

ডিএমটিসিএলের প্রথম কমিটির পরিচালক ছিলেন ড. শামসুল হক। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা এটি পরিচালনার জন্য অন্তত ২০ বছরের রেলওয়ের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল।