ঢাকা ১০:৫৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুপুরের পর আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় রিমাল

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৩৩:০৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ মে ২০২৪
  • ৪৮ বার
বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। এটি আজ সকালের মধ্যেই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে এর প্রথম অংশটি খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় দুপুরের পরই এবং মূল অংশ সন্ধ্যার পর আঘাত হানতে পারে। এ সময় ঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় ১৫ জেলা স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে দেশজুড়েই।

ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে রয়েছে পাহাড়ধসের আশঙ্কাও। ঝুঁকি বিবেচনায় পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজারকে ৬ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

গতকাল রাতে ঘূর্ণিঝড় রিমালের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি ১৬ থেকে ১৭ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে।

আজ ভোর থেকেই ঘূর্ণিঝড় রিমাল প্রাথমিকভাবে আঘাত হানতে শুরু করবে। ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রমের সময় বাতাসের গতিবেগ ১১০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এ সময় ৩ থেকে ১০ ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে উপকূল। আজ সকালে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি করা হতে পারে।
প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে। এ জন্য পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধস হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ গতকাল রাত ১টায় কালের কণ্ঠকে বলেন, উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব রবিবার সকাল থেকেই শুরু হবে। ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ দুপুরের পর থেকে শুরু করে লম্বা সময় ধরে রাত পর্যন্ত স্থলভাগ অতিক্রম করতে পারে।

আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের সামনের অংশ উপকূলে পৌঁছাতে পারে রবিবার দুপুরের পরই।

তবে এর মূল অংশ স্থলভাগে আঘাত করতে পারে সন্ধ্যার পরে।’আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান গতকাল বিকেলে বলেন, ‘এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ ও বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার খেপুপাড়ার মধ্য দিয়ে আজ রাত নাগাদ স্থলভাগ অতিক্রম করতে পারে।’

এর আগে গতকাল বিকেলে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় দেশের ছয় জেলায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। জেলাগুলো হলো সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা। তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় মন্ত্রণালয়ের সব প্রস্তুতি রয়েছে। ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও উপকূলে চার হাজার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে।

আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তি, উপকূলীয় ১৫ জেলায় জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা

এদিকে ঘূর্ণিঝড়টির সর্বশেষ অবস্থান ও বাতাসের গতিবেগ জানিয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল রাত ৮টায় আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছিল, গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’-এ পরিণত হয়ে এ সময় উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছিল। সন্ধ্যা ৬টায় এটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪০৫ কিলোমিটার এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরো উত্তর দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নিম্নাঞ্চল এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। দেশের আট বিভাগেই ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে।

এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তরও (আইএমডি) গতকাল বিকেল ৫টায় জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি আজ রবিবার সকালের মধ্যে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে এবং রাত ১২টার মধ্যে বাংলাদেশ ও সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। উপকূলে আঘাতের সময় ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার, যা দমকা হাওয়ার বেগে ১৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে।

কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ে পিএইচডি গবেষণারত বাংলাদেশি মোস্তফা কামাল পলাশ জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমাল তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা জেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার উপকূলীয় এলাকায় আঘাত করার প্রবল আশঙ্কা (৯০ শতাংশের বেশি) দেখা যাচ্ছে।

পলাশ বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ আজ সকাল ৬টার পর থেকে দুপুর ৩টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম শুরু করতে পারে। এর কেন্দ্র বিকেল ৩টার পর থেকে রাত ১২টার মধ্যে এবং পেছনের অংশ রাত ১২টার পর থেকে সোমবার সকাল ৬টার মধ্যে উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

সরাসরি ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে রয়েছে যেসব অঞ্চল

ঘূর্ণিঝড়টি ধ্বংসাত্মক হতে পারে—এই আশঙ্কা প্রকাশ করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার পর আগামীকাল সকাল নাগাদ এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে এটি স্থলভাগ অতিক্রম করলে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার থাকবে, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়া আকারে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এর সঙ্গে থাকবে বৃষ্টিপাত ও জলোচ্ছ্বাস। সুতরাং যেসব এলাকার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রম করবে, তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বেই। এসব অঞ্চলের মানুষজনকে অবশ্যই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে।’

দেশের কোন জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ও জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা বেশি, জানতে চাইলে আজিজুর রহমান বলেন, ‘খুলনার সুন্দরবন থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সব উপকূলীয় জেলা এর আওতায় পড়বে। সুতরাং এখানে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা ও নোয়াখালী—এসব জেলা ঘূর্ণিঝড়ের আওতায় পড়বে।’

বড় অংশই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাবে

গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলে আঘাতের আশঙ্কাই বেশি ছিল। তবে এর বড় অংশই বাংলাদেশের উপকূলের ওপর দিয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের বেশির ভাগ অংশ বাংলাদেশ পাবে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ৩০ শতাংশ যদি ভারত পায়, বাংলাদেশ পাবে ৭০ শতাংশ।

পাহাড়ধসের আশঙ্কাও রয়েছে

আজিজুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সারা দেশে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। ২৪ ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে সারা দেশে এক রকম বৃষ্টি হবে না। উপকূলীয় এলাকার বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালী—এসব জেলায় বৃষ্টি বেশি হবে। উপকূলের এসব এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় ৩০০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টি হতে পারে। চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার অঞ্চলে এ ধরনের বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ধসের ঝুঁকি থাকবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, রবিবার দুপুর থেকে বৃষ্টি শুরু হবে। সারা দেশেই কমবেশি বৃষ্টি হবে। পরদিন সোমবারও বৃষ্টি হবে। ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করে যাওয়ার পর স্থল নিম্নচাপ হিসেবে যদি ছয়-সাত ঘণ্টাও থাকে তাহলে দেখা যাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে।

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে গতকাল রাতে নিজস্ব সতর্কতা সংকেত অ্যালার্ট-৩ জারি করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে বন্দরের বহির্নোঙরে থাকা জাহাজ (মাদার ভেসেল) থেকে পণ্য খালাস ও জেটিতে পণ্য ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, রাত ১০টায় অ্যালার্ট-৩ জারি করা হলে লাইটার জাহাজগুলোকে কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট সেতুর উত্তরের নিরাপদ স্থানে চলে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ‘অ্যালার্ট-৪’ জারি করা হলে বন্দরের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

এদিকে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে জাতীয় গ্রিডে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহ কমে গেছে। এর প্রভাবে গ্যাসের চাপ কমে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

মোংলা বন্দরেও বন্ধ পণ্য ওঠানামা

মোংলা প্রতিনিধি জানান, মোংলা সমুদ্রবন্দরে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ কারণে মোংলা বন্দরে জারি করা হয়েছে নিজস্ব অ্যালার্ট  নম্বর-৩। এতে বন্দরে অবস্থানরত সব ধরনের বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্য ওঠানামার কাজসহ অপারেশনাল কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমান গতকাল রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

দুপুরের পর আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় রিমাল

আপডেট টাইম : ১০:৩৩:০৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ মে ২০২৪
বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। এটি আজ সকালের মধ্যেই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে এর প্রথম অংশটি খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় দুপুরের পরই এবং মূল অংশ সন্ধ্যার পর আঘাত হানতে পারে। এ সময় ঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় ১৫ জেলা স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে দেশজুড়েই।

ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে রয়েছে পাহাড়ধসের আশঙ্কাও। ঝুঁকি বিবেচনায় পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজারকে ৬ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

গতকাল রাতে ঘূর্ণিঝড় রিমালের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি ১৬ থেকে ১৭ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে।

আজ ভোর থেকেই ঘূর্ণিঝড় রিমাল প্রাথমিকভাবে আঘাত হানতে শুরু করবে। ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রমের সময় বাতাসের গতিবেগ ১১০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এ সময় ৩ থেকে ১০ ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে উপকূল। আজ সকালে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি করা হতে পারে।
প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে। এ জন্য পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধস হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ গতকাল রাত ১টায় কালের কণ্ঠকে বলেন, উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব রবিবার সকাল থেকেই শুরু হবে। ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ দুপুরের পর থেকে শুরু করে লম্বা সময় ধরে রাত পর্যন্ত স্থলভাগ অতিক্রম করতে পারে।

আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের সামনের অংশ উপকূলে পৌঁছাতে পারে রবিবার দুপুরের পরই।

তবে এর মূল অংশ স্থলভাগে আঘাত করতে পারে সন্ধ্যার পরে।’আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান গতকাল বিকেলে বলেন, ‘এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ ও বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার খেপুপাড়ার মধ্য দিয়ে আজ রাত নাগাদ স্থলভাগ অতিক্রম করতে পারে।’

এর আগে গতকাল বিকেলে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় দেশের ছয় জেলায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। জেলাগুলো হলো সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা। তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় মন্ত্রণালয়ের সব প্রস্তুতি রয়েছে। ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও উপকূলে চার হাজার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে।

আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তি, উপকূলীয় ১৫ জেলায় জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা

এদিকে ঘূর্ণিঝড়টির সর্বশেষ অবস্থান ও বাতাসের গতিবেগ জানিয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল রাত ৮টায় আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছিল, গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’-এ পরিণত হয়ে এ সময় উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছিল। সন্ধ্যা ৬টায় এটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪০৫ কিলোমিটার এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরো উত্তর দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নিম্নাঞ্চল এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। দেশের আট বিভাগেই ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে।

এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তরও (আইএমডি) গতকাল বিকেল ৫টায় জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি আজ রবিবার সকালের মধ্যে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে এবং রাত ১২টার মধ্যে বাংলাদেশ ও সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। উপকূলে আঘাতের সময় ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার, যা দমকা হাওয়ার বেগে ১৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে।

কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ে পিএইচডি গবেষণারত বাংলাদেশি মোস্তফা কামাল পলাশ জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমাল তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা জেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার উপকূলীয় এলাকায় আঘাত করার প্রবল আশঙ্কা (৯০ শতাংশের বেশি) দেখা যাচ্ছে।

পলাশ বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ আজ সকাল ৬টার পর থেকে দুপুর ৩টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম শুরু করতে পারে। এর কেন্দ্র বিকেল ৩টার পর থেকে রাত ১২টার মধ্যে এবং পেছনের অংশ রাত ১২টার পর থেকে সোমবার সকাল ৬টার মধ্যে উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

সরাসরি ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে রয়েছে যেসব অঞ্চল

ঘূর্ণিঝড়টি ধ্বংসাত্মক হতে পারে—এই আশঙ্কা প্রকাশ করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার পর আগামীকাল সকাল নাগাদ এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে এটি স্থলভাগ অতিক্রম করলে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার থাকবে, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়া আকারে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এর সঙ্গে থাকবে বৃষ্টিপাত ও জলোচ্ছ্বাস। সুতরাং যেসব এলাকার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রম করবে, তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বেই। এসব অঞ্চলের মানুষজনকে অবশ্যই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে।’

দেশের কোন জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ও জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা বেশি, জানতে চাইলে আজিজুর রহমান বলেন, ‘খুলনার সুন্দরবন থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সব উপকূলীয় জেলা এর আওতায় পড়বে। সুতরাং এখানে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা ও নোয়াখালী—এসব জেলা ঘূর্ণিঝড়ের আওতায় পড়বে।’

বড় অংশই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাবে

গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলে আঘাতের আশঙ্কাই বেশি ছিল। তবে এর বড় অংশই বাংলাদেশের উপকূলের ওপর দিয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের বেশির ভাগ অংশ বাংলাদেশ পাবে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ৩০ শতাংশ যদি ভারত পায়, বাংলাদেশ পাবে ৭০ শতাংশ।

পাহাড়ধসের আশঙ্কাও রয়েছে

আজিজুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সারা দেশে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। ২৪ ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে সারা দেশে এক রকম বৃষ্টি হবে না। উপকূলীয় এলাকার বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালী—এসব জেলায় বৃষ্টি বেশি হবে। উপকূলের এসব এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় ৩০০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টি হতে পারে। চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার অঞ্চলে এ ধরনের বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ধসের ঝুঁকি থাকবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, রবিবার দুপুর থেকে বৃষ্টি শুরু হবে। সারা দেশেই কমবেশি বৃষ্টি হবে। পরদিন সোমবারও বৃষ্টি হবে। ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করে যাওয়ার পর স্থল নিম্নচাপ হিসেবে যদি ছয়-সাত ঘণ্টাও থাকে তাহলে দেখা যাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে।

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে গতকাল রাতে নিজস্ব সতর্কতা সংকেত অ্যালার্ট-৩ জারি করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে বন্দরের বহির্নোঙরে থাকা জাহাজ (মাদার ভেসেল) থেকে পণ্য খালাস ও জেটিতে পণ্য ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, রাত ১০টায় অ্যালার্ট-৩ জারি করা হলে লাইটার জাহাজগুলোকে কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট সেতুর উত্তরের নিরাপদ স্থানে চলে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ‘অ্যালার্ট-৪’ জারি করা হলে বন্দরের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

এদিকে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে জাতীয় গ্রিডে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহ কমে গেছে। এর প্রভাবে গ্যাসের চাপ কমে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

মোংলা বন্দরেও বন্ধ পণ্য ওঠানামা

মোংলা প্রতিনিধি জানান, মোংলা সমুদ্রবন্দরে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ কারণে মোংলা বন্দরে জারি করা হয়েছে নিজস্ব অ্যালার্ট  নম্বর-৩। এতে বন্দরে অবস্থানরত সব ধরনের বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্য ওঠানামার কাজসহ অপারেশনাল কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমান গতকাল রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।