বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টা অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো হয়েছে
কয়েক দিন ধরে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা বেশি থাকলেও সেখানে ট্রেনের গতি কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়নি। অথচ চট্টগ্রামে তুলনামূলক তাপমাত্রা কম থাকলেও এই অঞ্চলে তাপ বাড়লে ট্রেনের গতি কমাতে বলা হয়েছে।
বর্তমানে দেশের ৪৩ জেলায় রেলপথ রয়েছে। এর ৩৯টিতেই রয়েছে রেললাইনে সমস্যা। রেলের মান নষ্ট হওয়া, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, মাটি সরে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এখানে স্পষ্ট যে রেলের পূর্বাঞ্চলে তাপের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলে ততটা জোর দেওয়া হয়নি। রেলের নথি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় পূর্বাঞ্চলে রেলের মান বেশি খারাপ এবং বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু তাপের কারণেই ট্রেনের গতি কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যখন তাপ কম থাকবে তখন ট্রেন স্বাভাবিক গতিতেই চলবে। এই নির্দেশনার সঙ্গে রেলপথ ঝুঁকিতে আছে কি না সেটার কোনো সম্পর্ক নেই।’
তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার একমাত্র কারণ মানতে রাজি নন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামছুল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রেল সম্প্রসারিত হতে বাধাপ্রাপ্ত হলেও বেঁকে যেতে পারে। এ জন্য সঠিক ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।’
কেন রেল বেঁকে যায়
ট্রেন যে রেললাইনের ওপর দিয়ে চলাচল করে, সেই লাইনের একটি লোহার পাত সর্বোচ্চ ১৪ মিটার বা ৪২ ফুট দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে। লোহার পাত জোড়া দিয়ে সমান্তরাল রেললাইন বসানো হয় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। জোড়াগুলোর জায়গায় সামান্য ফাঁকা রাখা হয়। শীতে রেললাইন সংকুচিত হয়। আবার গরমে হয় সম্প্রসারিত। সম্প্রসারিত হতে হতে ওই ফাঁকা জায়গা বন্ধ হলে রেললাইন বেঁকে যায়। এটিকে কারিগরি ভাষায় বাক্লিং বলা হয়।
রেললাইন বেঁকে যাওয়ার জন্য যে পরিমাণ তাপের প্রয়োজন সেটি বাংলাদেশে তেমন হয় না। রেল বেঁকে যেতে হলে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি প্রয়োজন। যদিও নিয়মিত তাপের চেয়ে রেলের তাপ ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি হতে পারে। সে ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হতে হবে।
ট্রেনের গতি কমানোর নির্দেশ
ঝুঁকি বিবেচনায় অতিরিক্ত তাপমাত্রা হলে দুর্বল রেললাইনে গতি কমিয়ে ট্রেন চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দেশে কাগজে-কলমে ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৬৫ কিলোমিটার। জায়গাভেদে গতি কমিয়ে ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
গত বছরের ২৭ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দাড়িয়াপুর এলাকায় মালবাহী ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে লাইন ৫০০ মিটার বেঁকে যায়। ২৮ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় মালবাহী ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়। ২৯ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আবারও রেললাইন বেঁকে যায়।
গত বছরের মে মাসে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার দাড়িয়াপুর এলাকায় প্রায় ৭০০ মিটার রেললাইন একাধিকবার আংশিক বেঁকে গিয়েছিল। তখন অতিরিক্ত তাপকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
যদিও তখন দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে রেললাইনগুলো সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, লাইনে ফিটিংস ছিল না, নাট-বল্টু খোলা ছিল, কাঠের স্লিপার পর্যাপ্ত ছিল না, লাইনে পাথর ও মাটির স্বল্পতা ছিল।
রেলওয়ের সূত্র বলছে, তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলে ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। আর ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে হলে রেললাইন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলছেন, রেললাইনের ওপর ৪৫-৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহনীয় হিসেবে ধরা হয়। এর বেশি গরম হলে রেললাইন বেঁকে গিয়ে দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে গতি কমিয়ে ট্রেন চলাচলের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
রেলের মান দুর্বল
২০১৪ সালের পর থেকে দেশে নতুন রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে। তবে এর পরিমাণও কম। ব্রড গেজ রেললাইনে প্রতি মিটারে ৯০ পাউন্ড এবং মিটার গেজ লাইনে প্রতি মিটারে ৭৫ পাউন্ড ওজন থাকার কথা। কিন্তু বিদ্যমান লাইনে এমন ওজন থাকছে কি না সেটিও দেখার বিষয়। এমন কারণেও রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে।
যদিও বৈশ্বিক আদর্শ বিবেচনায়, প্রতি মিটার রেলের ওজন ৬০ কেজি হতে হবে। এতে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে গতি কমানোর ইঙ্গিত
রেলের মান ও লাইনের অবস্থা যাচাই করতে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে গত বছর একটি সমীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, দেশে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার রেললাইন ও রেলপথের অবস্থা খারাপ।
রেলের কার্য ব্যবস্থাপনা পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে বিভক্ত। সারা দেশে এখন রেলপথ আছে তিন হাজার ৯৩ কিলোমিটার। আর রেললাইন আছে চার হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার। অথচ দেশের স্বাধীনতার আগমুহূর্তে ১৯৬৯-৭০ সালেও ব্যবহারযোগ্য রেললাইন ছিল চার হাজার ৪৪৮ কিলোমিটার।
সমীক্ষা মতে, পূর্বাঞ্চলের ১৬ জেলায় সমস্যা বেশি। এই অংশে ১৫০ কিলোমিটার রেললাইন পুরোপুরি নতুন করে করতে হবে। ৪০০ কিলোমিটার পথে রেল পরিবর্তন করতে হবে। প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথে স্লিপারসহ অন্য সরঞ্জাম পরিবর্তন করতে হবে। পূর্বাঞ্চলের রেলপথে পাঁচ লাখ কিউবিক মিটার পাথরের ঘাটতি আছে।
রেলের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পূর্বাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও ঢাকায় রেলপথে এসব সমস্যা রয়েছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, ছাগলনাইয়া, ফেনী, চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা সদর, লাকসাম, চাঁদপুর সদর, ব্রাহ্মণপাড়া, বুড়িচং, কসবা, আখাউড়া, আশুগঞ্জ, ভৈরব বাজার, নরসিংদী, টঙ্গী, ঢাকা সিটি করপোরেশন, কুলাউড়া, সিলেট সদর, ছাতক, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন, জামালপুর সদর ও গৌরীপুর এলাকায় জটিলতা বেশি।
এদিকে রেলের পশ্চিমাঞ্চলে জেলা বিবেচনায় রাজশাহী, ঢাকা, রংপুর ও খুলনা বিভাগের ২৩ জেলায় সমস্যা বেশি রয়েছে। এসব জায়গার মধ্যে যেখানে যেখানে রেললাইনের অবস্থা ভালো নয় সেখানেই শুধু তাপের কারণে গতি কমানোর কথা বলা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঝুঁকি বিবেচনায় গতি কমানোর সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানাই। তবে আমাদের ৭০ শতাংশ রেলের আয়ুষ্কাল শেষ। নতুন উন্নত রেলের তাপ সহনীয় ক্ষমতা বেশি থাকে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রেললাইনে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। শীতেও কিন্তু ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে।’
লাইনচ্যুতির কারণে ৮৩% দুর্ঘটনা
দিনে দিনে রেলপথে দুর্ঘটনা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে চলন্ত ট্রেনের বগির লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা। এক বছরের ব্যবধানে রেলপথে এমন ঘটনা বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। রেলওয়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ট্রেন দুর্ঘটনার ৮৩ শতাংশই বগিগুলো লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে ঘটছে।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৩১টি। একই সঙ্গে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে ২০।
দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গত চার বছরের দুর্ঘটনার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ে মোট ৮৭২টি দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৯ জন মারা গেছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত ৫০২ জন।