পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ভারতের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৫ বছরে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানব উন্নয়নের সকল সূচকে আমাদের যেমন অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে এর সাথে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আজ আমরা বিশ্বে পঞ্চম ও এশিয়া-ওশানিয়া অঞ্চলে দ্বিতীয়। ভারতের নেতারা যেমন এ অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন তেমনি একসাথে কাজের আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন।
আজ দিল্লি সফর বিষয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এ কথা জানান। গত ৭ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান। এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেতো রেংলি এবং ভুটানের রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুয়েন্টসিল তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন।
ড. হাছান জানান, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের বদলে ‘নন-লেথাল উইপন’ ব্যবহার, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা ইস্যু, নিরাপত্তাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বিশেষত: ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তি নবায়ন, তিস্তার পানিবন্টন, মানুষে-মানুষে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা ইস্যুসহ নানা সহযোগিতার ক্ষেত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
সফরের প্রথম দিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কও, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে এবং শেষ দিনে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, উপ-রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকর এবং রাজ্যসভার লিডার অব দ্য হাউস এবং বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযুষ গয়ালের সাথে বৈঠকের বিষয়ে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান।
পাশাপাশি, সফরের দ্বিতীয় দিন দিল্লির রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, নয়াদিল্লির বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের এক দশক’ শীর্ষক একক বক্তৃতা দান, প্রেসক্লাব অব ইন্ডিয়া এবং ‘ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাব অব সাউথ এশিয়া’তে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
দিল্লি থেকে ঢাকায় ফেরার পথে কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন আয়োজিত অভ্যর্থনায় সেখানে উপস্থিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকবর্গ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপের কথাও জানান ড. হাছান।
ভারতের রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ ৯ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে দেশটির রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণপত্র পাঠানোর কাজ চলছে। রমজানের আগে ভারতকে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ, ১ লাখ টন চিনি পাঠানোর অনুরোধ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সংবাদ সম্মেলনে জানান, ৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযুষ গয়ালের সঙ্গে বৈঠকে রমজানের আগে ভারতকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ এবং ১ লাখ মেট্রিক টন চিনি রপ্তানি করতে অনুরোধ করেছি। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী সেটা ভালোভাবে নিয়েছেন। এর আগে তারা ২০ হাজার মেট্রক টন পেঁয়াজ এবং ১০ হাজার মেট্রিক টন চিনি রপ্তানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
ড. হাছান বলেন, আমরা অনেক ভোগ্যপণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে, পেঁয়াজ, চিনি, ডাল এসব এবং মসলা কিছু জাতীয় কিছু পণ্য। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি তাকে বলেছি, এসব ভোগ্য পণ্যে যেন বিশেষ কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যাতে কমপক্ষে আমরা তাদের থেকে এ সব পণ্য সঠিক মূল্যে এবং আমাদের প্রয়োজনে ইমপোর্ট করতে পারি।
মিয়ানমার ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত জানালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার থেকে তাদের সেনাদের ফিরিয়ে নিতে জাহাজ আসার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জাহাজটি কখন ভিড়বে সেটি টেকনিক্যাল পার্ট। আমরা সম্মত তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। এটা খুব সহসা হবে।’
মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি ও তাদের সাথে কিছু সেনা যারা এসেছে, তারা রোহিঙ্গা গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট কিনা সেটি তদন্ত করার দাবি উঠেছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আপাতত তাদের ফেরত পাঠানো নিয়েই কাজ করছি। কারণ, সেটিই আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার এবং মিয়ানমারও তাদের নিয়ে যেতে চায়। আমরা সেটি নিয়েই কাজ করছি।’
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মি দখল করেছে, বান্দরবানের মিয়ানমার সীমান্তে তারা টহল দিচ্ছে সেটি দেশের নিরাপত্তা নিয়ে সংকট তৈরি করবে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী হাছান বলেন, মিয়ানমারে যেটি ঘটছে সেটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাদের নিরাপত্তা চৌকি কে পাহারা দিচ্ছে সেটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাদের অভ্যন্তরীণ গন্ডগোলের কারণে এখানে নিরাপত্তা বিঘিœত হোক সেটি আমরা কখনো চাই না। আমাদের এখানে তাদের শেল এসেছে পড়েছে, দুইজন নিহত হয়েছে। সেটি নিয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে আমরা কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি।
রাখাইনের রাজধানী সিত্তে থেকে বাংলাদেশ কনসুলেটের কূটনীতিকদের সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান তিনি।
বিএনপি বলেছে, মিয়ানমার ইস্যুতে সরকার তথ্য গোপন করছে -এ নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিএনপি তো বক্তব্য দিয়ে তাদের দলের অস্তিত্ব জানান দিতে চায়। এখানে মিয়ানমারের যতোজন সদস্য আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে সে বিষয়ে আমরা সময়ে সময়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করেছি। এখানে লুকোচুরি করার প্রশ্নই আসে না। তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি খুব সহসা তাদের ফেরত পাঠাতে পারব।
তিনি বলেন, বিএনপি এসব বক্তব্য ও নানা কর্মসূচি দিয়ে তাদের হতাশা কাটানোর চেষ্টা করছে। আমরা চাই তারা গণতান্ত্রিক কর্মসূচির মধ্যে থাকবে। সরকারের কর্মকান্ডের প্রতিবাদ তারা করতেই পারে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে তাদের অগ্নিসন্ত্রাস আর করতে দেয়া হবে না।
‘নাফ নদীর তীরে অনেক রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে, তাদের জন্য বর্ডার খুলে দেওয় হবে কিনা’- এমন প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন রেখে
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ইতোমধ্যে আমাদের দেশে রোহিঙ্গা আছে ১.২ মিলিয়ন। এখন রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। যেমন পরিবেশগত সমস্যা, নিরাপত্তাজনিত সমস্যা, মাদকজনিত সমস্যাসহ অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের পক্ষে কি আরো রোহিঙ্গা আশ্রয় দেওয়া সম্ভব? আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিয়েই সংঘাত চলছে তা নয়। তাদের মধ্যে নানা জাতিগোষ্ঠী আছে। তাদের মধ্যে নানা সমস্যা চলছে। সেই সংঘাতের উত্তাপের কারণে আমাদের দেশে আমরা নানা ধরনের সমস্যায় পড়ব সেটি কি সঙ্গত?
মিয়ানমার ইস্যুতে ভারত সফরে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারে এখন যে সংঘাত চলছে সেই সংঘাতের কারণে আমাদের অঞ্চলে যে সংকট তৈরি হয়েছে, নিরাপত্তা সংকট তৈরি হয়েছে সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে যেসব রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করা হয়েছে তাদের নাগরিক অধিকার দিয়ে সেখানে ফেরত নেওয়ার বিষয়ে ভারতের সহায়তা কামনা করেছি।
মিয়ানমার ইস্যুতে ভারত-বাংলাদেশ কিভাবে একসাথে কাজ করবে -এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী হাছান বলেন, আমরা তাদের সাথে বর্ডার শেয়ার করি। সুতরাং মিয়ানমারে যদি কোন পরিস্থিতির উদ্বেগ ঘটে তাহলে সেটি আমাদের দেশকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা উদ্বিগ্ন করে তাদেরকেও সেইভাবে উদ্বিগ্ন করে। সুতরাং দুই দেশেরই যেহেতু উদ্বেগ প্রতিবেশীকে নিয়ে তাই আমাদের একসাথে কাজ করার অনেক বিষয় তো রয়েছে।