তিন দিনেও পেটে পড়েনি দানাপানি

তিন দিনেও পেটে দানা পানি পড়েনি। দুমাসেরও বেশি সময় ছিলেন সমুদ্রের বুকে। মালয়েশিয়ার উপকূলে উদ্ধারকৃত এক বাংলাদেশী এভাবেই জানিয়েছেন তার দুর্ভোগের কথা। ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রায় তারা নেমেছিলেন উন্নত জীবনের আশায়। এর পরিবর্তে মিলেছে অবর্ণনীয় দুর্দশা আর নির্যাতন। অনাহারে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন। অসুস্থ হয়ে যাত্রার মাঝেই প্রাণ গেছে কারও। তখন ছুড়ে ফেলা হয়েছে নৌকা থেকে। মারধর, যৌন নিপীড়ন তো আছেই। সম্প্রতি থাইল্যান্ড সরকার মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করার পর থেকে এসব নৌকা আরোহীদের কপালে যোগ হয়েছে নতুন দুর্ভোগ। পাচারকারীরা ধরা পড়ার আশঙ্কায় তাদের মাঝপথে ফেলে রেখে পালিয়ে যাচ্ছে। থাইল্যান্ড না গিয়ে নিকটবর্তী মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে ফেলে দিয়ে আসছে শরণার্থীদের। গত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সমুদ্র উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ২০০০ বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাকে। এদের মধ্যে বহু নারী ও শিশু রয়েছে। রোববার, আনুমানিক ৬০০ যাত্রীবাহী ৪টি নৌকা ইন্দোনেশিয়ার উপকূলবর্তী আচেহ প্রদেশে পৌঁছায়। গতকাল সকালে আরও ৪০০ জনকে উদ্ধার করা হয়। এদিকে মালয়েশিয়ার লঙ্কাওয়িতে তিনটি নৌকায় ১০১৮ জন পৌঁছায়। এর মধ্যে ৫৫৫ জন বাংলাদেশী আর বাকিরা রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে নারী রয়েছেন ৯৯ জন এবং শিশু ৫৪ জন। পাচারকারীরা আরোহীদের ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় আরও বিপাকে পড়ছে পাচারের শিকার ব্যক্তিরা। পরশু মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছানো শরণার্থীদের উদ্ধার করা হয় অসুস্থ ও দুর্বল অবস্থায়। বার্তাসংস্থা এপি ও রয়টার্সের খবরে এসব কথা বলা হয়েছে। লঙ্কাওয়ির উপ-পুলিশ প্রধান জামিল আহমেদ বলেন, এক বাংলাদেশী পুলিশকে জানিয়েছে যে, পাচারকারীরা তাদের নির্দেশনা দিয়ে গেছে মালয়েশিয়ার উপকূলে পৌঁছানোর পর তারা কোন দিকে যাবেন। এরপর দুটি নৌকায় তারা পালিয়ে যায়। বাংলাদেশী ওই ব্যক্তি জানিয়েছে, তারা তিনদিন ধরে কিছুই খায়নি। নৌকার আরোহী প্রত্যেকেই প্রচণ্ড দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। জামিল বলেন, আমাদের ধারণা আরও নৌকা রয়েছে। তাদেরকে অভিবাসন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। দ্বীপের চারপাশে উদ্ধার অভিযান জোরদার হওয়ায় আরও অনেক অভিবাসীকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন । এদিকে, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার স্টিভ হ্যামিল্টন বলেন, রোববার ভোরে চারটি নৌকা যখন সমুদ্রতীরের কাছাকাছি পৌঁছায় তখন নৌকাগুলো থেকে অনেক যাত্রী পানিতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরানো শুরু করে। উদ্ধারকৃতদের উত্তর আচেহ জেলার রাজধানী লোকসুকোনে একটি ক্রীড়া স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে তাদের দেখাশোনা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছেন উত্তর আচেহ এলাকার পুলিশ প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আকমাদি। এসব নৌকাযাত্রীরা দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে সমুদ্রে ছিল। তাদের অনেককে জরুরি চিকিৎসা সেবা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধারকৃতদের মধ্যে মোট ৫০ জনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আকমাদি বলেন, অসুস্থ প্রত্যেকেই অনাহারে থাকার কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধারকৃতদের মধ্যে মোহাম্মাদ কাসিম (৪৪) নামক এক বাংলাদেশীর সঙ্গে কথা বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। বগুড়া জেলার নিবাসী কাসিম জানিয়েছে,  নৌকার যাত্রীদের প্রত্যেকে ৪৪০০ রিঙ্গিত করে দিয়েছে পাচারকারীদের। তারা ভেবেছিলেন তাদের মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়া হবে। তাদের নৌকার তিনজন যাত্রা পথে মারা যায়। তাদেরকে সাগরে ফেলে দেয়া হয়। মালয়েশিয়ায় চাকরি পাওয়ার আশায় এক মাস আগে কাসিম আপনজনদের ফেলে রওনা দেন। তার সঙ্গে নৌকায় আরও ৩০-৪০ জন ছিল।  প্রথমে তাদের নৌকা থাইল্যান্ডের একটি সমুদ্রসৈকতে পৌঁছায়। সেখানে তারা ২১ দিন ছিলেন। পরে বড় আরেকটি নৌযানে তাদেরকে ওঠানো হয়। সেখানে ছিল শ’ শ’ যাত্রী। ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে যখন তাদের নামিয়ে দেয়া হয়, তখন আরোহীরা ভেবেছিলেন তারা মালয়েশিয়া পৌঁছেছেন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে প্রত্যেকে বুঝতে পেরেছেন স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তাদের। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বৃথাই প্রতারণার শিকার হয়েছেন সবাই।
লোকসুকোনের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এতো সংখ্যক শরণার্থী আগমনের জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। হঠাৎ করে এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে শ’ শ’ দুর্বল ও অসুস্থ মানুষের খাবার আর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের পরিস্থিতিও একইরকম। ইন্দোনেশিয়ার উত্তর আচেহ প্রদেশের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসের মোহাম্মদ ইয়ানি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, আমাদের বাজেটে এ খাতে কোন অর্থ নেই। একইসঙ্গে তিনি এও বলেন, আমরা এ নিয়ে পরে চিন্তা করবো। এখন এটা জরুরি পরিস্থিতি। উদ্ধারকৃত অনেকে এতো বেশি দুর্বল ছিল যে, উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি তাদের ছিল না। স্থানীয় এক সরকারি কর্মকর্তা তেগাস বলেন, আগত অভিবাসীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, বিমর্ষ, ক্লান্ত আর নিদারুণ পীড়াগ্রস্ত। লোকসুকোনে তাদেরকে যেখানে রাখা হয়েছে তা এতোগুলো মানুষকে রাখার মতো পর্যাপ্ত প্রশস্ত নয়। টয়লেটের সংখ্যাও কম। অভিবাসীদের নীল রংয়ের ত্রিপল বিছিয়ে দিয়ে ঘুমাতে দেয়া হয়েছে। কোন বালিশ বা কম্বল ছাড়া। তেগাস বলেন, আমাদের আরও বেশি সরবরাহ প্রয়োজন। তাদেরকে উন্নত স্থানে পুনর্বাসনও জরুরি। কর্তৃপক্ষকে এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম  খেতে হচ্ছে দেখে স্থানীয়রা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অনেকেই খাবার, পোশাক দিয়ে সাহায্য করছেন। অন্যরা যে যেভাবে পারছেন উপকারে আসার চেষ্টা করছেন। খাবার, পানি আনা-নেয়া করছেন তারা। ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আলাপচারিতা করার চেষ্টা করছেন তারা। তেগাস বলেন, তাদের মন ভাল করার জন্য এটা স্থানীয়দের পদ্ধতি। স্থানীয়দের উষ্ণ সহায়তায় দুর্দশা কিছুটা লাঘব হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে ভোগান্তির যে এখানেই শেষ নয়, তা হয়তো বুঝতে পারছেন শরণার্থীরা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর