হাওর ও জলাভূমিতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। অনুমতি ছাড়া পানির প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত করে কেউ অবকাঠামো বানালে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হবে। সঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। অথবা উভয় দণ্ডও হতে পারে।
হাওর ও জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইনের খসড়ায় এসব কথা বলা হয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, দেশে ‘হাওর ও জলাভূমি আদালত’ নামে এক বা একাধিক আদালত থাকবে। এসব আদালত শুধু হাওর ও জলাভূমি-সংক্রান্ত অপরাধ আমলে নিয়ে বিচারকাজ করবেন। যেকোনো অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ৫ এপ্রিল আইনটির ওপর মতামত দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠিয়েছে। আইনটি নিয়ে অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করবে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। ৬টি অধ্যায় ও ২৯টি ধারা যুক্ত করে খসড়া আইনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর। ২০১৬ সালে বোর্ড থেকে অধিদপ্তরে রূপান্তর হওয়া বিভাগটি একটি গেজেট দিয়ে চলছে। গত সাত বছরে কোনো আইন হয়নি। মূলত হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর পরিচালনার জন্য আইনটি করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে আইনের কোনো অভাব নেই। ঘাটতি হচ্ছে প্রয়োগের। দেশে নতুন নতুন আইন হচ্ছে। কিন্তু অপরাধীদের বিচার হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলো মূলত হাওর ও জলাভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ করে। তারা যদি অপরাধ করে, তাহলে কারাদণ্ড দেওয়া হবে কাকে। অর্থদণ্ড পরিশোধ করবে কে—এসব প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই আইন চূড়ান্ত করার আগে এসব বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।
খসড়া আইনের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়, হাওর ও জলাভূমি এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার আগে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। ছাড়পত্র ছাড়া হাওরে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে, এমন কাজ করা যাবে না। এটি করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।
খসড়া আইনে বলা হয়, হাওর ও জলাভূমি থেকে পানি সরানো যাবে না, যাতে হাওর ও জলাভূমি শুকিয়ে যায়। পানি সরানোর কারণে সেখানকার প্রতিবেশ ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হবে। অথবা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। হাওর ও জলাভূমিতে এমন কোনো দ্রব্য, বর্জ্য ফেলা যাবে না, যেটি হাওরের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি করলে একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আইনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, হাওর রক্ষায় দেশে কোনো আইন নেই। একটি গেজেটের মাধ্যমে অধিদপ্তরটি চলছে। একটি আইনের খসড়া তৈরি করে সবার মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। সবার মতামত নিয়ে শিগগিরই তা চূড়ান্ত করা হবে। হাওরে সরকারি সংস্থাগুলোই স্থাপনা নির্মাণ করে, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আইন মানার দায়িত্ব সবার।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ—সাতটি জেলা মিলে হাওরাঞ্চল। এখানে ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে রয়েছে ৪২৩টি হাওর। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জে রয়েছে বিশাল আকারের ১২২টি হাওর। তবে দেশে জলাভূমির সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
হাওরাঞ্চলের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চৈত্র-বৈশাখ, এ সময়ে মাছ ধরতে স্থানীয় ব্যক্তিরা শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে ছোট হাওর ও জলাভূমি থেকে পানি সরিয়ে নেন। এতে জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থানীয় ব্যক্তিরা যাতে পানি না সরান, সে জন্য আইনে পাঁচ বছরের দণ্ড ও অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।
খসড়া আইনে বলা হয়, হাওর ও জলাভূমিতে শিল্পকারখানার অপরিশোধিত তরল বা কঠিন বর্জ্য ফেললে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। অনধিক ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, কঠিন বর্জ্য হাওরে ফেলার কারণে পানি দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল এবং জলজ বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাওরের পানিদূষণ ঠেকানো জরুরি।
অনুমোদিত বালুমহাল বা পাথরমহাল ছাড়া হাওর ও জলাভূমি থেকে বালু ও পাথর তোলা যাবে না। এটি করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। অথবা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। হাওর ও জলাভূমির অবৈধ দখল, ভরাট ও অনুমোদন ছাড়া খনন করা যাবে না। এটি করলেও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষিত হাওর ও জলাভূমি এলাকায় শব্দদূষণকারী যান্ত্রিক জলযান চালানো যাবে না। এটি করলে এক বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হবে।
হাওরে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, কালভার্ট, স্লুইসগেট ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের অভিযোগ পুরোনো। পানি উন্নয়ন বোর্ড হাওরের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ করছে। রাস্তাঘাট ও স্লুইসগেট বানাচ্ছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর হাওরের বিভিন্ন স্থানে সেতু বানাচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব সেতু, রাস্তাঘাট ও বাঁধের কারণে হাওরে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা এসব অপরিকল্পিত স্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করেছেন।
ব্যক্তিগতভাবেও অবৈধভাবে হাওরে ঘরবাড়ি বানানো হচ্ছে। টাঙ্গুয়ার হাওর একটি সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে ঘরবাড়ি বানানো হচ্ছে। এতে সেখানে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আইনটি করা হচ্ছে।
হাওর ও জলাভূমি রক্ষায় আইন তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, নদী রক্ষায় এমন আইন হয়েছিল। কিন্তু নদীর দখল-দূষণ থেমে নেই। দেশে অনেক আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। হাওর রক্ষায় সরকার নতুন আইন করতে যাচ্ছে। উদ্যোগটি ভালো। তবে আইনের প্রয়োগ হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়। তিনি বলেন, আইনটি ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা করতে হবে। হাওরের ‘স্বাভাবিক পানির প্রবাহ’ বলতে কী বোঝায়, তা ঠিক করতে হবে। এসব না করলে আইনের ফাঁকফোকর বের করার সুযোগ থাকবে।