বোরো মৌসুমে ব্রি-২৮ ও ২৯ ধান চাষে কৃষকর মাথায় হাত

বোরো মৌসুমে ব্রি-২৮ ও ২৯ জাতের ধান চাষে কৃষকের মাথায় হাত। কারণ সম্প্রতি ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ধান তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে। বিভিন্ন রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে। যদিও উচ্চফলনশীল এবং আগাম উঠে যাওয়ার কারণে হাওরাঞ্চলে ব্রি ২৮ জাতের ধান বেশ জনপ্রিয়। আর যেসব এলাকায় বোরোর পর রোপা আমন কিংবা এক ফসলি হিসেবে শুধু বোরো চাষ হয়, সেসব জমির জন্য ব্রি ২৯ জাতটি জনপ্রিয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত জাত দুটি দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় প্রায় তিন দশক ধরে বড় অবদান রাখছে। আরো অনেক ধান স্বীকৃতি পেলেও এ দুটি জাতের মতো কোনো ধানের জাতই দীর্ঘমেয়াদে টিকতে পারেনি।  কিন্তু গত বছর হাওরের কিছু এলাকায় এ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। এবার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি। হাওরাঞ্চলের পাশাপাশি তুলনামূলক নিচু জেলাগুলোর কৃষকও চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি ২৮ ধান চাষ করে বেশ বিপাকে পড়েছে। চিটা হয়ে যাওয়ায় অনেকে এবার ধানের আশাই ছেড়ে দিয়েছে। কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি- কয়েক বছর ধরেই ব্রি ২৮ ও ২৯ ধান চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কয়েক বছর ধরে ব্রি-২৮ ও ২৯  জাতের ধান চাষ করে কৃষকরা ভালো ফলন পেয়ে আসছে। পাশাপাশি বন্যা আসার আগেই ফসল ঘরে তুলতে পারছে। হাওরের কৃষক অশাল বন্যার আতঙ্কে থাকে। সেজন্যই হাওরের কৃষকরা আগাম জাতের ধানের দিকে ঝোঁকেন। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি দেশীয় জাতের ধানই ভরসা। কিন্তু সেগুলোর ফলন তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষক উচ্চফলনশীল জাতেই বিকল্প খোঁজেন। তুলনামূলকভাবে আগে ওঠায় তাদের কাছে ব্রি ২৮ই বেশি জনপ্রিয়। সূত্র জানায়, চলতি বছর মোট ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে হাওরভুক্ত সাত জেলায় ৯ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। আর কয়েক সপ্তাহ পরই ওসব অঞ্চলে ধান কাঁটার উৎসব শুরু হবে। কিন্তু হাওরে এবার ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৪৪২ হেক্টর জমির ব্রি ২৮ ধান। ব্রি ২৯ জাতের ধানেও এবার রোগটি ছড়িয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জে ৭৭ হেক্টর, নেত্রকোনায় ৬৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৪৫, সিলেটে ১০, মৌলভীবাজারে ৪৮, হবিগঞ্জে ৮৯ ও সুনামগঞ্জে ১০ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দাবি হাওরের সাত জেলার ৩৬৭ হেক্টর জমির ব্লাস্ট এরইমধ্যে দমন করা হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, খাদ্যে উদ্ধৃত্ত জেলা নেত্রকোনায় এবার ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। তার মধ্যে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। কিন্তু ব্রি ২৮ ধান লাগিয়ে ভাটির ওই জেলার কৃষকরা বিপাকে পড়েছে। জেলার হাওর উপজেলা মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী ও কলমাকান্দার কিছু এলাকায় ধানে চিটা হয়েছে। অধিক ফলনের আশায় অতিরিক্ত ইউরিয়া সার প্রয়োগ ও আবহাওয়াজনিত কারণেই এ বছর ব্রি ২৮ ধানে নেক ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। ধান পাকা পর্যন্ত জেলায় মোট ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা হয়েছে ৭৩ হেক্টর জমি। যদিও বোরো মৌসুমের শুরুতেই এ ধান আবাদ না করে কৃষকদের ব্রি ৮৮ ও ব্রি ৯৬ রোপণের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। আর সুনামগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৪২টি হাওরের জমিতে এবার ব্রি ২৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে তাহিরপুর, মধ্যনগর, শাল্লাসহ অনেক এলাকার জমির ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে লোকসানের মুখে দিশেহারা কৃষক। কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী হাওরবেষ্টিত ওই জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। যদিও ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ হাজার ২৭২ হেক্টর জমিতে ব্রি ২৮ জাতের ধান চাষ হয়েছে। তাহিরপুর উপজেলায় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯ জাতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে বেশ হতাশ কৃষক। মধ্যনগর উপজেলায়ও একই অবস্থা। চিটা ও ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত ফসল পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু হাওরাঞ্চলেই নয়, দেশের অন্যান্য জেলায়ও ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগ আক্রমণ করেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত জমির পরিমাণ। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার বারবাড়িয়া ও রাওনা ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি এলাকায় এ রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক। এদিকে কৃষকদের অভিযোগ, ব্রি ২৮ ধান আবাদ না করতে যে রকম প্রচার-প্রচারণার দরকার, কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তেমন প্রচার হয়নি। ফলে কৃষক বারবার একই ভুল করে লোকসানের মুখে পড়ছে। যদিও ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯ খুবই জনপ্রিয় জাতের ধান। এ ধান চাষ হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া সম্ভব নয়। তবে অন্য জাতের ধানও বাজারে এসেছে। বোরো ধানের জমিতে অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহার, দিনে গরম ও রাতে ঠাণ্ডা এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। তবে শুরুতেই এর প্রতিষেধক দিলে প্রতিরোধ করা যায়। অন্যদিকে ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯ ধান জাত দুটি উদ্ভাবনে জড়িত ড. প্রণব কুমার সাহা রায় জানান, এ দুটি জাত অনেক আগের। ধীরে ধীরে পুরনো জাতে রোগ ধরে যায়। নতুন জাত এলে পুরনোগুলো এভাবেই কমে যাবে। এভাবেই একটি জাতের সম্প্রসারণ হয়। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য ব্রি ২৮ ও ২৯ অবদান রেখেছে। আগে এ দুই জাতে ব্লাস্ট বা অন্যান্য রোগ কম ধরতো। রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা ভালো ছিল, কিন্তু এবার হাওরাঞ্চলে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটা সাধারণত আবহাওয়াগত কারণে আক্রান্ত হয়। এ ভ্যারাইটিগুলো ব্লাস্ট রেজিস্ট্যান্স ছিল না। তবে নতুন নতুন ধানের জাত আসছে। সেগুলো ২৮ ও ২৯-এর জায়গা দখল করে নেবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর