ঢাকা ০৮:৪৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
দেশ ও জাতি গঠনে “দৈনিক আমার দেশ” পত্রিকার কাছে নেত্রকোণার জনগণের প্রত্যাশা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত ভুল অস্ত্রোপচার, যা ঘটেছিল প্রিয়াঙ্কা সঙ্গে সচিবালয়ে উপদেষ্টা হাসান আরিফের তৃতীয় জানাজা সম্পন্ন সাবেক সচিব ইসমাইল রিমান্ডে অবশেষে বিল পাস করে ‘শাটডাউন’ এড়াল যুক্তরাষ্ট্র চাঁদাবাজদের ধরতে অভিযান শুরু হচ্ছে: ডিএমপি কমিশনার নির্বাচনের পর নিজের নিয়মিত কাজে ফিরে যাবেন ড. ইউনূস ইয়েমেন থেকে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, আহত ১৬ জুলাই আন্দোলন বিগত বছরগুলোর অনিয়মের সমষ্টি: ফারুকী তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ‘সড়কে নৈরাজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব জড়িত

রাষ্ট্রপতির সহোদর অধ্যাপক আবদুল হাই: পরের তরে সাদা মনের মানবিক মানুষ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:১৪:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ জুলাই ২০২২
  • ২৪৬ বার

রফিকুল ইসলামঃ

‘বেঁচেও মরে যদি মানুষ দোষে, / মরেও বাঁচে যদি মানুষ ঘোষে’ – এ কথাটি খাটে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আবদুল হাইয়ের ক্ষেত্রে।

তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের প্রাণপ্রিয় অনুজ। তাছাড়া তাঁর সহকারী একান্ত সচিব শুধু নয়, ছিলেন বিশ্বস্ত সহচর ও ছায়াসাথী।

মানুষ মাত্রই জন্ম-মৃত্যুর অধীন বলে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গকে ওসিলা করে ২০২০ সালের আজকের এই দিনে (১৭ জুলাই) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) দু’সপ্তাহব্যাপী চিকিৎসাধীন থেকে সবাইকে ফেলে অমর্ত্যলোকে চলে যান তিনি। আজ তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।

হাওরবন্ধু আবদুল হাই ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে গণসংযোগ শাখার উপ-পরিচালক থাকাকালীন অবসরে গেলে ওই বছরই রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে নিযুক্ত হন। এর আগে ১৯৯৮ সালে জাতীয় সংসদের তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার এবং পরবর্তীতে স্পিকার মোঃ আবদুল হামিদের এপিএস হন।

ঋদ্ধিমান এই কর্মবীর রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব পালন ছাড়াও ছিলেন আলোকিত দেশ গড়ার বাতিঘর এবং আদর্শিক রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তেজস্বী এই অন্তপ্রাণ দেশ মা’কে ভালোবেসে যুদ্ধে লড়তে মা’কে ছেড়েছিলেন একাত্তরে। যুদ্ধশেষে মায়ের কোলে ফিরে এসেছিলেন বীরদর্পে। সিনা টান করে সেদিন দেশ মায়ের লাল সবুজের পতাকা মায়ের হাতে সঁপে ছিলেন বিজয়ের হাসিতে।

তিনি দেশ মাতৃকার প্রশ্নে কখনো কারও সাথে আপস করেননি। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন অবিচল। মানবতায় বিশেষ করে হাওরের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য যা ন্যায্য, তা অকপটে বলতেন এবং ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতেন দৃঢ়চিত্তে। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া নয়, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে কাজ করে গেছেন নিঃস্বার্থভাবে। তার সতত আদর্শিক অবস্থানটা ধরে রেখেছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

তার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং জাতি গঠনে তাঁর আত্মত্যাগ ও অবদানের কথা স্মরণ করে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী রাম নাথ কোভিন্দসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ পদস্থ অনেকেই। তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল মাতৃকোল পারিবারিক কবরস্থানে।

সচ্চরিত্র ছিল আবদুল হাইয়ের মনুষ্য জীবনের অলঙ্কার। ঋজুপ্রকৃতির নিষ্কলুষ নির্লোভ চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্যই তার প্রতি অধিক বিশ্বাসী ছিলেন বড় ভাই রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। যে কারণে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের সুবাদে সাতবারের নির্বাচিত সাংসদ কিংবদন্তি রাজনীতিক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মোঃ আবদুল হামিদ ডেপুটি স্পিকার হলে তাকে কলেজের অধ্যাপনার পাঠদান চুকিয়ে জাতীয় সংসদে কর্মসঙ্গী করেন।

রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার থাকাকালীনই চির অবহেলিত হাওরকে দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে নিরলসভাবে কাজ করার দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে পথ চলার অনুঘটক ছিলেন সহোদর আবদুল হাই।

তিনি বিশেষ করে ২০১৩ সালে মোঃ আবদুল হামিদ দু’মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর থেকে মহামান্যের জ্যেষ্ঠপুত্র কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের টানা তিনবারের নির্বাচিত সাংসদ প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের সমন্বয়ে সংসদীয় এলাকার জনসাধারণের সাথে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে সেতুবন্ধের সারথিও ছিলেন।

আবদুল হাইয়ের সমস্ত ভাবনাজুরে ছিল মা মাটি ও মানুষ। স্বমহিমায় উদ্ভাসিত তার অতুলনীয় ব্যক্তিত্বে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে কর্মনিষ্ঠতার দরুন জনপদ থেকে শুরু করে সংসদ ভবন হয়ে বঙ্গবন পর্যন্ত সকলেই ছিলেন বিমুগ্ধ। তার ছিল ভিন্ন মতাদর্শের তথা দূরের মানুষকেও কাছে টানার এমাজিং হেপনোসিস পাউয়ার বা বিস্ময়কর সম্মোহনী শক্তি।

তিনি শৈশবে বেড়ে ওঠা বিস্তীর্ণ হাওরের নির্মল অথৈ জলরাশির মতোই নিরাহঙ্কার বুকে ধারণ করতেন নিঃস্ব-হতদরিদ্র, ধনী-গরিব ও দলমত নির্বিশেষে নিমিষেই সবাইকে আপন করে নেওয়ার বিশাল এক হৃদয়। এতে জোগাতেন ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে দুর্জনের বিরুদ্ধে লড়াই করে দুর্বলের টিকে থাকার প্রেরণা ও সাহস।

এছাড়া বেঁচে থাকার প্রশ্রয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন ডেল কার্নেগীর ভাষায় শুধু নয়, পবিত্র কোরআনুল কারিমের ভাষাতেও- ‘আধিক্য সত্যের মানদণ্ড নয়।’ দেখাতেন বন্ধুর পথপাড়ির অভ্যুদয়ের গোচর বা নয়নপথ। শুনাতেন শিকল ভাঙার ও সাম্যের গান। এমনিভাবে লুঙ্গিপরা খেটে খাওয়াদেরও সংসদ ভবন এবং বঙ্গভবনে দর্শনার্থী হতে তিনি স্মরণে-করণে থাকতেন করিৎকর্মা সেজে। ফোনটিও সেবার অপেক্ষায় সর্বদা খোলা থাকত হাজারো প্রশ্ন ও সমস্যা সমাধানের উত্তরপত্র হয়ে।

আবদুল হাই ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন শেষে রাজধানীতে লোভনীয় চাকরির অপার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আলোকিত হাওর গড়তে ছুটে চলেন গ্রামে। সংসদীয় এলাকায় প্রতিষ্ঠিত শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদেরই প্রতিষ্ঠিত প্রথমে হাজী তায়েব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে অবৈতনিক এবং পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক সরকারি কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।

শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন আদর্শবান। অনন্য ও অদ্বিতীয়। তার কথাবার্তায় মানব দরদ ও দেশপ্রেম উপচে পরতো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে তিনি মনে করতেন, কেবল প্রতিভার দ্বারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায় না। দাঁড়াতে হয় জনগণের কাতারে। তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে হয়। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্ত হতে হয়। সর্বোপরি দেশ এবং দেশবাসীর স্বার্থকেই সবার ওপরে স্থান দিতে হয়।

তিনি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্র প্রসার মানেই গণস্বার্থ ও গণঅধিকারের ভিত্তি মজবুত হওয়া। গণতন্ত্রকে জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বলেই তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত ও মতাদর্শের অনুসারীদের শান্তিপূর্ণ সম্মানজনক সহাবস্থানেও বিশ্বাসী ছিলেন।

তিনি বলতেন, রাজনৈতিক দলের উপাদান তিনটি- নেতা, অনুগামী ও পরিস্থিতি। একটি আরেকটির পরিপূরক। কোনো রাজনৈতিক দলের ‘নেতা’ অন্যতম উপাদান হলেও একমাত্র নয়। নেতা ছাড়া দল চলে না বলা হলেও ‘অনুগামী’ ছাড়া দল অন্ধ। নেতা হয় ক’জনা, আমজনতাই হতে পারে দলীয় অনুগামী। এক্ষেত্রে নেতা কান্ড হলে অনুগামী সেখানে দলের শিকড়।

তিনি মনে করতেন, কোনো রকম প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে জনমত সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা গেলেও দমিয়ে রাখা যায় না। কোনো ষড়যন্ত্র ও দমননীতি কোনো শাসন ব্যবস্থাকে অমর-অক্ষয় করে রাখতে পারে না। সম্ভব না। কেননা, রাজনীতিতে জনগণই মূখ্য।

আবদুল হাই দেশকে কত ভালোবাসতেন, দেশের মানুষের জন্য, দেশের মুক্তির জন্য, তার ব্যাকুলতা কত গভীর ছিল উপরিউক্ত বক্তব্যেই তা স্পষ্ট। অভিব্যক্তিতেই শুধু নয়, কর্তব্যপরায়ণে ছিলেন প্রসন্নচিত্ত। কারও সালাম পাবার অভিলাষে না দেখার ভান ধরতেন না। আগুয়ান হয়ে নিজেই নামধরে ভরাটকণ্ঠে ডাকজুরে দিতেন। কাছে এনে পরম মমতায় কেমনে চলছে-ফিরছে ও সুখ-দুঃখসহ আদ্যোপান্তের খোঁজখবর নিতেন।

তার মতে, সাধারণ মানুষের চাওয়া বড়জোর ভালোবাসা, একটু সহানুভূতি এবং ন্যায়বিচার পাওয়া। এ সামান্যটুকুনে কার্পণ্যতা দেখানো রাজনৈতিক দৈন্যতা বৈ অন্যকিছু নয়।

সহমর্মিতায় বিশেষ করে হাওরের জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছিলেন রাজনৈতিক অভিজ্ঞান ও অকৃত্রিম দরদ দিয়ে। একটি প্রখর বাঙালি জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনাকে এগিয়ে নিয়েছেন অতুলনীয় নেতৃত্বগুণ ও স্বদেশ প্রেমের মহিমায়। অকৃত্রিম কর্তব্যনিষ্ঠার বলে বলীয়ান হয়ে সমাজের গুরুদায়িত্বকেও নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

তিনি শুধাতেন, বস্তুত পরের মঙ্গল বা হিতসাধনের জন্য প্রভূত ধনসম্পদের প্রয়োজন হয় না, এজন্য দরকার সহায়ক সদিচ্ছা ও মহৎ হৃদয়। দীক্ষাপ্রাপ্ত ঠিক যেন ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের অধিকারী অগ্রজ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদেরই প্রতিচ্ছবি।

আবদুল হাই ছিলেন পরের তরে সাদা মনের মানবিক মানুষ। ডাগর চোখের সুদর্শন সদালাপী প্রোজ্জ্বল এই ব্যক্তিত্ববান লোকটি চলনে বলনে হাস্যোজ্জ্বল বিনয়ী ও কমনীয় ছিলেন। সৌখিন হলেও সাত-পাঁচ বা নয়-ছয়ে নয় তথা জীবনসত্তার নয়, ছিলেন মানবসত্তার অধিকারী। কারও কান কথায় কান ভারি করতেন না। সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে নিরপেক্ষতার ভেঁক ধরতেন না। কারও উপকার ছাড়া অনিষ্ট চিন্তা অন্তরে পোষতেন না। সবাইকে আপনজন ভাবতেন। সবার প্রতিই তার মায়াবী সম্বোধন ছিল- ‘তুমি ত আমরারই লোক’।

সম্বোধনে ও মর্যাদায় কারোর বেলাতেই ভিন্নতা ছিল না। ‘বড় ভালো লোকটি’র সাথে সবিশেষ দেখা হয়েছিল করোনা-পূর্ব বঙ্গভবনে। আত্মমর্যাদা বোধে নাম ভাঙানো ও ক্ষমতার ধারে কাছে ঘেষার আমার বাতিক না থাকায় অনুশাসনে সেদিন বলেছিলেন, ‘অনেকেই ত রঙ বদলাইয়া দুই লাইন লেইখ্যা মুই কি হনুরে সাজে বঙ্গভবনে এসে! আর তুমি কি না রাজ্যের লেহা লেইখ্যা নিষ্ঠ-ঘনিষ্ঠজন অইয়াও এলিয়েনের লাহান হঠাৎ দেহা দেও।

আসলে এটা তার গুণেরই দিক। পারিবারিক মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিসহ সংসদ ভবন এবং বঙ্গভবনের মতো শীর্ষস্থানের বাসিন্দা হয়েও প্রচারবিমুখ নিভৃতচারী পরোপকারী এই জিঘাংশার কথা বরাবরই সবার কাছে ছিল সবকের মতো। মহামান্য রাষ্ট্রপতির এপিএস শুধু নয়, সর্বোপরি রাষ্ট্রপতির সহোদর হয়ে রাজ্যজয় করার উদ্যত দরবারি সবার মাথার ওপর ঘুরানোটা অস্বাভাবিক ছিল না যদিও তথাপি ছিল না ক্ষমতার কোনো দম্ভ। অহংবোধের লেশমাত্র ছিল না মনে।

অথচ এলাকা ধরে রাখার নামে রাজনৈতিক ধ্বজাধারী অনেককেই দেখা গেছে দাবড়িয়ে বেড়াতে। ব্যক্তিক অনুগামী তৈরির উন্মত্ততায় দেখা গেছে দলীয় অনুগামীদের মাথার ওপর ক্ষমতার কাঁঠাল ভাঙতে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের উক্তিটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘কারও চরিত্র অভীক্ষণ করতে ক্ষমতা দিয়ে দেখ।’ এক্ষেত্রে আবদুল হাই প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। যার সদাচার আর উদারতাই ছিল নীতি।

ক্লিন ইমেজ আর অকৃত্রিম দরদই ছিল আবদুল হাইয়ের ভূষণ। কোনো প্রাপ্তি ছাড়াই সরল মনে পরের তরে জীবন ধরে দেওয়ায় হাওরবাসীর হৃদয়ে বসেছিলেন স্বপ্নের বরপুত্র হয়ে। হাওরবাসীও শতজনমের চেনা মহৎপ্রাণ বন্ধুপ্রতিম প্রিয় অভিভাবকের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিরও ছিল না কোনো ঘাটতি। মূল্যায়িতও হচ্ছেন মনের মাধুরীতে। স্মরণার্হে বলা হচ্ছে- ‘হাই সা’ব আছিন সাদাসিধা-দিলদরিয়া মানুষ। ঠেকলে সহায়তা পেতে নির্ভয়ে মন খুইল্যা দুইডা কতা কওন গ্যাছে। লোকটা আর যা-ই হোক, পেডের ভিত্তে দাঁত (কুবুদ্ধিপ্রসূত) আছিন না।’

আবদুল হাই দেশের বিখ্যাত এক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার জন্ম ১৯৫৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে। পিতা হাজী তায়েব উদ্দিন এবং মাতা তমিজা খাতুন। ৫ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি অষ্টম এবং ভাইদের মধ্যে চতুর্থ।

তার অন্তর্ধানে বর্তমানে ভাই-বোনের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং মিঠামইন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ আবদুল হক নূরু ও মিঠামইন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যন আছিয়া আলম ছাড়া অন্যরা কেউ বেঁচে নেই।

বর্তমানে স্ত্রী, এক পুত্র ও দুই কন্যার মধ্যে স্ত্রী নাহিদ পারভিন তার স্বামীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ মহামান্য রাষ্ট্রতির সহকারী একান্ত সচিব পদে নিযুক্ত রয়েছেন। পুত্র প্রকৌশলী শাইখ মোহাম্মদ ফারাবী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। জ্যেষ্ঠকন্যা সুমাইয়া ফাজরিন মাশিয়াত পেশায় একজন চিকিৎসক এবং কনিষ্ঠকন্যা মিম শাহরিন অনসূয়া কানাডার মনট্রিয়াল কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।

তিনি মিঠামইন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি, বিআরডিবি’র চেয়ারম্যান, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘প্রবাহের’ সভাপতিসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় অসংখ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জনসেবা ও আধুনিক হাওর রুপায়নে তথা এলাকার উন্নয়নেও তার অবদান অনস্বীকার্য।

আবদুল হাই প্রশাসক হিসেবেও ছিলেন সততা ও ন্যায্যতার পরাকাষ্ঠায় পোড়াসোনা। একটি ক্ষুদ্র মাটির প্রদীপ সারা পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে না, দূর করতে পারে না বিশাল অমানিশার অন্ধকার। কিন্তু তার ক্ষুদ্র আলোকচ্ছটায় মানুষ দেখতে পেতো আলোর রেখা।

চেতনার প্রেক্ষিত, অমিত সাহস ও নির্দেশিকা কার্যকরভাবে পালন করার সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া লোকের অভাব হালে বড়ই প্রকট। যেজনে পাছে লোকে ভালো বলে সে-ই তো উত্তম।

আবদুল হাইয়ের মৃত্যতে সমাজ, দেশ ও জাতি একজন অকুতোভয় দেশপ্রেমিক একজন বীর সেনানী এবং প্রগতিশীল ও নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক সংগঠককে হারাল। আর হাওরবাসী হারাল মাটির প্রদীপ ‘আমরার লোকটিকে’। পরলোকেও থেকো পরম শান্তিতে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

দেশ ও জাতি গঠনে “দৈনিক আমার দেশ” পত্রিকার কাছে নেত্রকোণার জনগণের প্রত্যাশা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত

রাষ্ট্রপতির সহোদর অধ্যাপক আবদুল হাই: পরের তরে সাদা মনের মানবিক মানুষ

আপডেট টাইম : ০১:১৪:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ জুলাই ২০২২

রফিকুল ইসলামঃ

‘বেঁচেও মরে যদি মানুষ দোষে, / মরেও বাঁচে যদি মানুষ ঘোষে’ – এ কথাটি খাটে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আবদুল হাইয়ের ক্ষেত্রে।

তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের প্রাণপ্রিয় অনুজ। তাছাড়া তাঁর সহকারী একান্ত সচিব শুধু নয়, ছিলেন বিশ্বস্ত সহচর ও ছায়াসাথী।

মানুষ মাত্রই জন্ম-মৃত্যুর অধীন বলে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গকে ওসিলা করে ২০২০ সালের আজকের এই দিনে (১৭ জুলাই) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) দু’সপ্তাহব্যাপী চিকিৎসাধীন থেকে সবাইকে ফেলে অমর্ত্যলোকে চলে যান তিনি। আজ তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।

হাওরবন্ধু আবদুল হাই ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে গণসংযোগ শাখার উপ-পরিচালক থাকাকালীন অবসরে গেলে ওই বছরই রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে নিযুক্ত হন। এর আগে ১৯৯৮ সালে জাতীয় সংসদের তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার এবং পরবর্তীতে স্পিকার মোঃ আবদুল হামিদের এপিএস হন।

ঋদ্ধিমান এই কর্মবীর রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব পালন ছাড়াও ছিলেন আলোকিত দেশ গড়ার বাতিঘর এবং আদর্শিক রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তেজস্বী এই অন্তপ্রাণ দেশ মা’কে ভালোবেসে যুদ্ধে লড়তে মা’কে ছেড়েছিলেন একাত্তরে। যুদ্ধশেষে মায়ের কোলে ফিরে এসেছিলেন বীরদর্পে। সিনা টান করে সেদিন দেশ মায়ের লাল সবুজের পতাকা মায়ের হাতে সঁপে ছিলেন বিজয়ের হাসিতে।

তিনি দেশ মাতৃকার প্রশ্নে কখনো কারও সাথে আপস করেননি। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন অবিচল। মানবতায় বিশেষ করে হাওরের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য যা ন্যায্য, তা অকপটে বলতেন এবং ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতেন দৃঢ়চিত্তে। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া নয়, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে কাজ করে গেছেন নিঃস্বার্থভাবে। তার সতত আদর্শিক অবস্থানটা ধরে রেখেছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

তার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং জাতি গঠনে তাঁর আত্মত্যাগ ও অবদানের কথা স্মরণ করে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী রাম নাথ কোভিন্দসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ পদস্থ অনেকেই। তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল মাতৃকোল পারিবারিক কবরস্থানে।

সচ্চরিত্র ছিল আবদুল হাইয়ের মনুষ্য জীবনের অলঙ্কার। ঋজুপ্রকৃতির নিষ্কলুষ নির্লোভ চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্যই তার প্রতি অধিক বিশ্বাসী ছিলেন বড় ভাই রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। যে কারণে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের সুবাদে সাতবারের নির্বাচিত সাংসদ কিংবদন্তি রাজনীতিক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মোঃ আবদুল হামিদ ডেপুটি স্পিকার হলে তাকে কলেজের অধ্যাপনার পাঠদান চুকিয়ে জাতীয় সংসদে কর্মসঙ্গী করেন।

রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার থাকাকালীনই চির অবহেলিত হাওরকে দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে নিরলসভাবে কাজ করার দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে পথ চলার অনুঘটক ছিলেন সহোদর আবদুল হাই।

তিনি বিশেষ করে ২০১৩ সালে মোঃ আবদুল হামিদ দু’মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর থেকে মহামান্যের জ্যেষ্ঠপুত্র কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের টানা তিনবারের নির্বাচিত সাংসদ প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের সমন্বয়ে সংসদীয় এলাকার জনসাধারণের সাথে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে সেতুবন্ধের সারথিও ছিলেন।

আবদুল হাইয়ের সমস্ত ভাবনাজুরে ছিল মা মাটি ও মানুষ। স্বমহিমায় উদ্ভাসিত তার অতুলনীয় ব্যক্তিত্বে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে কর্মনিষ্ঠতার দরুন জনপদ থেকে শুরু করে সংসদ ভবন হয়ে বঙ্গবন পর্যন্ত সকলেই ছিলেন বিমুগ্ধ। তার ছিল ভিন্ন মতাদর্শের তথা দূরের মানুষকেও কাছে টানার এমাজিং হেপনোসিস পাউয়ার বা বিস্ময়কর সম্মোহনী শক্তি।

তিনি শৈশবে বেড়ে ওঠা বিস্তীর্ণ হাওরের নির্মল অথৈ জলরাশির মতোই নিরাহঙ্কার বুকে ধারণ করতেন নিঃস্ব-হতদরিদ্র, ধনী-গরিব ও দলমত নির্বিশেষে নিমিষেই সবাইকে আপন করে নেওয়ার বিশাল এক হৃদয়। এতে জোগাতেন ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে দুর্জনের বিরুদ্ধে লড়াই করে দুর্বলের টিকে থাকার প্রেরণা ও সাহস।

এছাড়া বেঁচে থাকার প্রশ্রয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন ডেল কার্নেগীর ভাষায় শুধু নয়, পবিত্র কোরআনুল কারিমের ভাষাতেও- ‘আধিক্য সত্যের মানদণ্ড নয়।’ দেখাতেন বন্ধুর পথপাড়ির অভ্যুদয়ের গোচর বা নয়নপথ। শুনাতেন শিকল ভাঙার ও সাম্যের গান। এমনিভাবে লুঙ্গিপরা খেটে খাওয়াদেরও সংসদ ভবন এবং বঙ্গভবনে দর্শনার্থী হতে তিনি স্মরণে-করণে থাকতেন করিৎকর্মা সেজে। ফোনটিও সেবার অপেক্ষায় সর্বদা খোলা থাকত হাজারো প্রশ্ন ও সমস্যা সমাধানের উত্তরপত্র হয়ে।

আবদুল হাই ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন শেষে রাজধানীতে লোভনীয় চাকরির অপার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আলোকিত হাওর গড়তে ছুটে চলেন গ্রামে। সংসদীয় এলাকায় প্রতিষ্ঠিত শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদেরই প্রতিষ্ঠিত প্রথমে হাজী তায়েব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে অবৈতনিক এবং পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক সরকারি কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।

শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন আদর্শবান। অনন্য ও অদ্বিতীয়। তার কথাবার্তায় মানব দরদ ও দেশপ্রেম উপচে পরতো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে তিনি মনে করতেন, কেবল প্রতিভার দ্বারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায় না। দাঁড়াতে হয় জনগণের কাতারে। তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে হয়। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্ত হতে হয়। সর্বোপরি দেশ এবং দেশবাসীর স্বার্থকেই সবার ওপরে স্থান দিতে হয়।

তিনি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্র প্রসার মানেই গণস্বার্থ ও গণঅধিকারের ভিত্তি মজবুত হওয়া। গণতন্ত্রকে জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বলেই তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত ও মতাদর্শের অনুসারীদের শান্তিপূর্ণ সম্মানজনক সহাবস্থানেও বিশ্বাসী ছিলেন।

তিনি বলতেন, রাজনৈতিক দলের উপাদান তিনটি- নেতা, অনুগামী ও পরিস্থিতি। একটি আরেকটির পরিপূরক। কোনো রাজনৈতিক দলের ‘নেতা’ অন্যতম উপাদান হলেও একমাত্র নয়। নেতা ছাড়া দল চলে না বলা হলেও ‘অনুগামী’ ছাড়া দল অন্ধ। নেতা হয় ক’জনা, আমজনতাই হতে পারে দলীয় অনুগামী। এক্ষেত্রে নেতা কান্ড হলে অনুগামী সেখানে দলের শিকড়।

তিনি মনে করতেন, কোনো রকম প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে জনমত সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা গেলেও দমিয়ে রাখা যায় না। কোনো ষড়যন্ত্র ও দমননীতি কোনো শাসন ব্যবস্থাকে অমর-অক্ষয় করে রাখতে পারে না। সম্ভব না। কেননা, রাজনীতিতে জনগণই মূখ্য।

আবদুল হাই দেশকে কত ভালোবাসতেন, দেশের মানুষের জন্য, দেশের মুক্তির জন্য, তার ব্যাকুলতা কত গভীর ছিল উপরিউক্ত বক্তব্যেই তা স্পষ্ট। অভিব্যক্তিতেই শুধু নয়, কর্তব্যপরায়ণে ছিলেন প্রসন্নচিত্ত। কারও সালাম পাবার অভিলাষে না দেখার ভান ধরতেন না। আগুয়ান হয়ে নিজেই নামধরে ভরাটকণ্ঠে ডাকজুরে দিতেন। কাছে এনে পরম মমতায় কেমনে চলছে-ফিরছে ও সুখ-দুঃখসহ আদ্যোপান্তের খোঁজখবর নিতেন।

তার মতে, সাধারণ মানুষের চাওয়া বড়জোর ভালোবাসা, একটু সহানুভূতি এবং ন্যায়বিচার পাওয়া। এ সামান্যটুকুনে কার্পণ্যতা দেখানো রাজনৈতিক দৈন্যতা বৈ অন্যকিছু নয়।

সহমর্মিতায় বিশেষ করে হাওরের জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছিলেন রাজনৈতিক অভিজ্ঞান ও অকৃত্রিম দরদ দিয়ে। একটি প্রখর বাঙালি জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনাকে এগিয়ে নিয়েছেন অতুলনীয় নেতৃত্বগুণ ও স্বদেশ প্রেমের মহিমায়। অকৃত্রিম কর্তব্যনিষ্ঠার বলে বলীয়ান হয়ে সমাজের গুরুদায়িত্বকেও নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

তিনি শুধাতেন, বস্তুত পরের মঙ্গল বা হিতসাধনের জন্য প্রভূত ধনসম্পদের প্রয়োজন হয় না, এজন্য দরকার সহায়ক সদিচ্ছা ও মহৎ হৃদয়। দীক্ষাপ্রাপ্ত ঠিক যেন ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের অধিকারী অগ্রজ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদেরই প্রতিচ্ছবি।

আবদুল হাই ছিলেন পরের তরে সাদা মনের মানবিক মানুষ। ডাগর চোখের সুদর্শন সদালাপী প্রোজ্জ্বল এই ব্যক্তিত্ববান লোকটি চলনে বলনে হাস্যোজ্জ্বল বিনয়ী ও কমনীয় ছিলেন। সৌখিন হলেও সাত-পাঁচ বা নয়-ছয়ে নয় তথা জীবনসত্তার নয়, ছিলেন মানবসত্তার অধিকারী। কারও কান কথায় কান ভারি করতেন না। সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে নিরপেক্ষতার ভেঁক ধরতেন না। কারও উপকার ছাড়া অনিষ্ট চিন্তা অন্তরে পোষতেন না। সবাইকে আপনজন ভাবতেন। সবার প্রতিই তার মায়াবী সম্বোধন ছিল- ‘তুমি ত আমরারই লোক’।

সম্বোধনে ও মর্যাদায় কারোর বেলাতেই ভিন্নতা ছিল না। ‘বড় ভালো লোকটি’র সাথে সবিশেষ দেখা হয়েছিল করোনা-পূর্ব বঙ্গভবনে। আত্মমর্যাদা বোধে নাম ভাঙানো ও ক্ষমতার ধারে কাছে ঘেষার আমার বাতিক না থাকায় অনুশাসনে সেদিন বলেছিলেন, ‘অনেকেই ত রঙ বদলাইয়া দুই লাইন লেইখ্যা মুই কি হনুরে সাজে বঙ্গভবনে এসে! আর তুমি কি না রাজ্যের লেহা লেইখ্যা নিষ্ঠ-ঘনিষ্ঠজন অইয়াও এলিয়েনের লাহান হঠাৎ দেহা দেও।

আসলে এটা তার গুণেরই দিক। পারিবারিক মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিসহ সংসদ ভবন এবং বঙ্গভবনের মতো শীর্ষস্থানের বাসিন্দা হয়েও প্রচারবিমুখ নিভৃতচারী পরোপকারী এই জিঘাংশার কথা বরাবরই সবার কাছে ছিল সবকের মতো। মহামান্য রাষ্ট্রপতির এপিএস শুধু নয়, সর্বোপরি রাষ্ট্রপতির সহোদর হয়ে রাজ্যজয় করার উদ্যত দরবারি সবার মাথার ওপর ঘুরানোটা অস্বাভাবিক ছিল না যদিও তথাপি ছিল না ক্ষমতার কোনো দম্ভ। অহংবোধের লেশমাত্র ছিল না মনে।

অথচ এলাকা ধরে রাখার নামে রাজনৈতিক ধ্বজাধারী অনেককেই দেখা গেছে দাবড়িয়ে বেড়াতে। ব্যক্তিক অনুগামী তৈরির উন্মত্ততায় দেখা গেছে দলীয় অনুগামীদের মাথার ওপর ক্ষমতার কাঁঠাল ভাঙতে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের উক্তিটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘কারও চরিত্র অভীক্ষণ করতে ক্ষমতা দিয়ে দেখ।’ এক্ষেত্রে আবদুল হাই প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। যার সদাচার আর উদারতাই ছিল নীতি।

ক্লিন ইমেজ আর অকৃত্রিম দরদই ছিল আবদুল হাইয়ের ভূষণ। কোনো প্রাপ্তি ছাড়াই সরল মনে পরের তরে জীবন ধরে দেওয়ায় হাওরবাসীর হৃদয়ে বসেছিলেন স্বপ্নের বরপুত্র হয়ে। হাওরবাসীও শতজনমের চেনা মহৎপ্রাণ বন্ধুপ্রতিম প্রিয় অভিভাবকের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিরও ছিল না কোনো ঘাটতি। মূল্যায়িতও হচ্ছেন মনের মাধুরীতে। স্মরণার্হে বলা হচ্ছে- ‘হাই সা’ব আছিন সাদাসিধা-দিলদরিয়া মানুষ। ঠেকলে সহায়তা পেতে নির্ভয়ে মন খুইল্যা দুইডা কতা কওন গ্যাছে। লোকটা আর যা-ই হোক, পেডের ভিত্তে দাঁত (কুবুদ্ধিপ্রসূত) আছিন না।’

আবদুল হাই দেশের বিখ্যাত এক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার জন্ম ১৯৫৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে। পিতা হাজী তায়েব উদ্দিন এবং মাতা তমিজা খাতুন। ৫ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি অষ্টম এবং ভাইদের মধ্যে চতুর্থ।

তার অন্তর্ধানে বর্তমানে ভাই-বোনের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং মিঠামইন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ আবদুল হক নূরু ও মিঠামইন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যন আছিয়া আলম ছাড়া অন্যরা কেউ বেঁচে নেই।

বর্তমানে স্ত্রী, এক পুত্র ও দুই কন্যার মধ্যে স্ত্রী নাহিদ পারভিন তার স্বামীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ মহামান্য রাষ্ট্রতির সহকারী একান্ত সচিব পদে নিযুক্ত রয়েছেন। পুত্র প্রকৌশলী শাইখ মোহাম্মদ ফারাবী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। জ্যেষ্ঠকন্যা সুমাইয়া ফাজরিন মাশিয়াত পেশায় একজন চিকিৎসক এবং কনিষ্ঠকন্যা মিম শাহরিন অনসূয়া কানাডার মনট্রিয়াল কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।

তিনি মিঠামইন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি, বিআরডিবি’র চেয়ারম্যান, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘প্রবাহের’ সভাপতিসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় অসংখ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জনসেবা ও আধুনিক হাওর রুপায়নে তথা এলাকার উন্নয়নেও তার অবদান অনস্বীকার্য।

আবদুল হাই প্রশাসক হিসেবেও ছিলেন সততা ও ন্যায্যতার পরাকাষ্ঠায় পোড়াসোনা। একটি ক্ষুদ্র মাটির প্রদীপ সারা পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে না, দূর করতে পারে না বিশাল অমানিশার অন্ধকার। কিন্তু তার ক্ষুদ্র আলোকচ্ছটায় মানুষ দেখতে পেতো আলোর রেখা।

চেতনার প্রেক্ষিত, অমিত সাহস ও নির্দেশিকা কার্যকরভাবে পালন করার সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া লোকের অভাব হালে বড়ই প্রকট। যেজনে পাছে লোকে ভালো বলে সে-ই তো উত্তম।

আবদুল হাইয়ের মৃত্যতে সমাজ, দেশ ও জাতি একজন অকুতোভয় দেশপ্রেমিক একজন বীর সেনানী এবং প্রগতিশীল ও নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক সংগঠককে হারাল। আর হাওরবাসী হারাল মাটির প্রদীপ ‘আমরার লোকটিকে’। পরলোকেও থেকো পরম শান্তিতে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।