‘সুখী কিশোরগঞ্জে’র বিভিন্ন উদ্যোগের একটি সেবামূলক উদ্যোগ হলো এ মেহমানখানা। সুখী কিশোরগঞ্জের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী লুৎফুল্লাহ হুসাইন জানালেন, সুখী কিশোরগঞ্জ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি গ্রুপ। তাঁর এ উদ্যোগে পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি বন্ধু ও ফেসবুকের অন্যরাও যুক্ত হচ্ছেন। রাজধানীর গ্রিনরোডে কমফোর্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাছে এ মেহমানখানায় ৯ মাসে প্রায় ৭০০ মেহমান থাকার সুযোগ পেয়েছেন। গত বছরের অক্টোবরে যাত্রা শুরু করেছিল এ মেহমানখানা। বিদেশে যাবেন, অথচ মধ্যরাতে ফ্লাইট—এমন কেউ থাকলে তিনিও মেহমানখানায় থাকার সুযোগ পাচ্ছেন।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মেহমান খানায় গিয়ে দেখা গেল, চারটি ঘরে চৌকি ও তোশক বিছানো। আসবাবের বাহুল্য নেই। যে মেহমানেরা ছিলেন, তাঁরা চলে গেছেন। শুক্রবার যাঁদের চাকরির ইন্টারভিউ আছে, তেমন কয়েকজন পথে আছেন। তাঁদের জন্য পরিষ্কার চাদর ও বালিশের কভার রেডি করে রাখা।
চারটি ঘরের একটি ঘরে নারীরা স্বজনের সঙ্গে থাকার সুযোগ পান। এ ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া বাথরুম আছে। অন্য ঘরগুলোতে পুরুষ মেহমানেরা থাকেন।
মেহমানখানায় যাঁরা আসেন, হয় তাঁরা এ গ্রুপের সদস্য বা পরিচিত কেউ থেকেছেন তাঁর কাছ থেকে খবর পেয়ে এসেছেন। এভাবেই এর পরিচিতি বাড়ছে। আর উদ্যোগটি এখন আর শুধু একটি উদ্যোগের মধ্যে আটকে নেই, অনেকেই নিজেদের এলাকার জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন। রাজধানীর শ্যামলীসহ বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের মেহমানখানা গড়ে উঠছে।
লুৎফুল্লাহ হুসাইন এ উদ্যোগের শুরুর গল্পটা বললেন। জানালেন, করোনার সময় তাঁর বাবা অসুস্থ হয়ে ঢাকায় আসেন চিকিৎসার জন্য। পাঁচ বোন ও তাঁরা দুই ভাই মিলে বাবার চিকিৎসার জন্য একটি তহবিল গঠন করেন। তবে বাবার চিকিৎসার পর দেখা যায়, বেশ কিছু টাকা খরচ হয়নি। ভাইবোনেরা এ টাকা আর ফেরত নিতে চাইলেন না।
সেবামূলক কিছু একটা করতে বলেন। এর পর থেকেই সুখী কিশোরগঞ্জের আওতায় একটার পর একটা উদ্যোগের শুরু। একজন স্থপতিও এ উদ্যোগে যুক্ত হয়েছিলেন, তিনি করোনায় মারা গেছেন। এখন একজন থেকে আরেকজন—এভাবে এ উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিভিন্ন ব্যক্তি আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসছেন।
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজদের ভালো লাগার কথা জানান মেহমানদের অনেকেই
লুৎফুল্লাহ হুসাইন জানালেন, বাবার চিকিৎসার পর বেঁচে যাওয়া টাকায় করোনার সময় ২০ থেকে ২২টি পরিবারের প্রাথমিকভাবে দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব হয়। তারপর তিনি ফেসবুকে এ বিষয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। অন্য কেউ এ কাজে আগ্রহী আছেন কি না, তা জানতে চান। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সংযোগকারী হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। সমস্যার মধ্যে আছে এমন পরিবারের সদস্যের নম্বর দিয়ে দিলে সাহায্য করতে চাওয়া ব্যক্তি নিজেই যোগাযোগ করে সাহায্য পাঠিয়ে দেওয়া শুরু করেন। তখন লুৎফুল্লাহ হুসাইন ফেসবুকেই ‘আমি, তুমি, সে’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন। এভাবে প্রায় সাড়ে ৩০০ পরিবারের তথ্য রাখা সম্ভব হয়েছিল।
লুৎফুল্লাহ হুসাইন হাসতে হাসতে বললেন, ‘একদিন একজন “আমি, তুমি, সে” প্ল্যাটফর্মের কথা জানিয়ে আমি কোনো পরিবারকে সাহায্য করতে চাই কি না, জানতে চান। তিনি জানতেন না, আমি এ উদ্যোগের উদ্যোক্তা। ভালো লাগাটা এখানেই।’
এরপর কিশোরগঞ্জে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি, কিশোরগঞ্জ অক্সিজেন সাপোর্ট ব্যাংক, গ্রামের মানুষদের করোনার টিকা নিতে সুরক্ষা অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দেওয়াসহ একের পর এক উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করছেন। এখন স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ না পেলে অস্থির হয়ে যান। স্বেচ্ছাসেবকদের পরিবারের সদস্যরাও বিভিন্ন উদ্যোগে যুক্ত হচ্ছেন। এসব উদ্যোগ নিতে নিতেই মেহমানখানার কথা মাথায় আসে।
তরুণ তানভীর রহমান মেহমানখানার ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মেহমানেরা আসার আগে থেকেই তাঁর দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। যাঁরা আসতে চান, তাঁরা প্রথমে তানভীর রহমানের মুঠোফোনে (০১৭১ ৪৭৭০১৮৯) ফোন করেন। তারপর যিনি আসতে চান, তাঁকে জাতীয় পরিচয়পত্র, কোনো একজনের রেফারেন্স, রেফারেন্স দেওয়া ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফোন নম্বর পাঠাতে বলেন। যে ব্যক্তির রেফারেন্স দেওয়া, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে সব তথ্য ঠিক থাকলে মেহমান হিসেবে যিনি থাকতে চাচ্ছেন, তাঁকে মুঠোফোনে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বার্তা পাঠান তানভীর। তারপর মেহমান ঢাকায় এসে সেই বার্তা দেখালে তাঁকে স্বাগত জানান। মেহমানেরা আসার পর তাঁদের দেখভালও করতে হয় তানভীর আহমেদকে। তানভীর রহমান তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কিশোরগঞ্জ মেহমানখানায় আপনাদের রিসিভ (স্বাগত) করার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।’
মেহমানেরা মেহমানখানা থেকে চলে যাওয়ার সময় মন্তব্য খাতায় নিজেদের অনুভূতিগুলো লিখে যান। বেশির ভাগই তানভীর রহমানের প্রশংসা করার পাশাপাশি লিখেছেন, ঢাকায় মেহমানখানায় এসে তাঁদের মনে হয়েছে, তাঁরা নিজেদের বাড়িতেই আছেন। কিশোরগঞ্জের বাইরে আর একটুকরা কিশোরগঞ্জ—এভাবেও অনেকে নিজেদের অনুভূতি লিখেছেন। মেহমানেরা নিজেদের ফেসবুকেও মেহমানখানায় থাকার সময়ের গল্পগুলো লিখছেন।
মেহমানখানার গল্প বলতে গিয়ে লুৎফুল্লাহ হুসাইন বললেন, যেহেতু একই এলাকার মানুষ, তাই এখানে আসার পর আলাপে-আলাপে কোনো না কোনো সূত্রে আত্মীয়তার সম্পর্ক বের হয়ে যায়। অথবা এলাকার টান বলেও আত্মীয়তা না থাকলেও একজনের রক্ত লাগবে শুনে পাশের কক্ষের কোনো একজন হয়তো তাঁর সঙ্গে রক্ত দিতে চলে যান। নারীদের থাকার জন্য আপাতত একটি ঘর আছে। নারীর সঙ্গে স্বামী ও সন্তান বা ভাই—এমন আরেকটি পরিবার এলে নারী ও শিশুদের জন্য কক্ষ ছেড়ে দিয়ে দেখা যায়, আরেক পরিবারের পুরুষ সদস্যরা অন্য কক্ষে গিয়ে থাকেন। যেহেতু রান্নাঘর ও বাসনপত্র আছে, কোনো পরিবার রান্না করলে দুই পরিবারের সদস্যরাই তা খান। এভাবেই মিলেমিশে থাকেন তাঁরা।
লুৎফুল্লাহ হুসাইন বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থেই মেহমানদের বিভিন্ন তথ্য যাচাই–বাছাই করা হয়। মেহমানখানার বিষয়ে স্থানীয় থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে থানা থেকেও জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন তথ্য নেওয়ার কথা বলে দিয়েছে। চাকরিপ্রার্থী বা চিকিৎসার জন্য আসা ব্যক্তির সঙ্গে অন্য যে সদস্যরা আসবেন, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কসহ বিভিন্ন তথ্য জেনে নেওয়া হয়। রোগী ও চাকরিপ্রার্থীর ক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশনের ছবি, চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড, ছবিসহ বিভিন্ন তথ্য দেখেই মেহমানদের স্বাগত জানানো হচ্ছে। গত ৯ মাসে প্রায় ৭০০ জন মেহমান মেহমানখানায় থেকেছেন। তিন রাত সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে থাকতে পারবেন, তবে ক্যানসার রোগী বা জটিল সমস্যায় আসা ব্যক্তিদের তিন রাতের পরও থাকতে হলে আবার একটি আবেদন করতে হয়। সে ক্ষেত্রে পাঁচ রাত থাকতে পারেন তাঁরা।
লুৎফুল্লাহ হুসাইন জানালেন, মেহমানখানার জন্য কেউ বাড়িভাড়া দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। তাই বাড়ি পেতেই লেগে যায় কয়েক মাস। বর্তমান বাড়ির মালিক বেশ কম দামেই বাড়িটি ভাড়া দিয়েছেন। আগামী ছয় মাস মেহমানখানার খরচ কে কে দিতে ইচ্ছুক, এমন ২৫ জন দাতার নাম জানতে চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর ২৫ জন দাতাই পাওয়া গেছে, যাঁরা মাসে দুই হাজার করে টাকা দেবেন। তাই আগামী ছয় মাসের খরচের জন্য আর কোনো চিন্তা নেই।
মেহমানখানার বাসাভাড়া, ব্যবস্থাপক, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বেতনসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ মাসে গড়ে ৪০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। দাতাদের কে কত টাকা দিচ্ছেন, তাঁর নামসহ গ্রুপে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেউ নাম প্রকাশ করতে না চাইলে তাঁর নামের আংশিক অংশ, ফোনের শেষ তিনটি সংখ্যা জানিয়ে দেওয়া হয়। কারও নাম বাদ গেলে তিনি আবার গ্রুপে জানান। টাকাপয়সার হিসাব রাখার জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আছেন, যাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই।
লুৎফুল্লাহ হুসাইন বললেন, ‘কয়েক বছর পর হয়তো এ উদ্যোগে আর তেমনভাবে সময় দিতে পারব না, তবে এমন সিস্টেম করছি, যাতে যে–ই দায়িত্ব নিক, তাঁর কোনো সমস্যা না হয়। স্বচ্ছতাও থাকে।’
‘সুখী কিশোরগঞ্জ’ এর নামকরণ প্রসঙ্গে লুৎফুল্লাহ হুসাইন বললেন, লেখক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের এক নাটকে সুখী নীলগঞ্জ নামের একটি প্রজেক্ট দেখানো হয়েছিল। সেখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই এ নামকরণ।
মেহমানখানাসহ বিভিন্ন উদ্যোগগুলো বাণিজ্যিক উদ্যোগ নয়, তাহলে কেন করছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে লুৎফুল্লাহ হুসাইন বললেন, ‘এ উদ্যোগগুলো থেকে নিজেও সুখী হতে পারছি। শান্তি পাচ্ছি। ফেসবুককে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে চাচ্ছি। একইভাবে যাঁরা দান করছেন, তার ফলাফল চোখের সামনে দেখতে পারছেন। আমরা চাই, এভাবেই একদিন শুধু সুখী কিশোরগঞ্জ নয়, সুখী বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।’