হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যায় মিশ্র অবস্থা বিরাজ করছে- কোথাও পানি কমছে, আবার কোথাও কোথাও পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
সিলেট বিভাগীয় প্রশাসন জানিয়েছে, চারটি জেলার ৩৩টি উপজেলায় বন্যা দুর্গতদের চিকিৎসার জন্য ৩শ টিরও বেশি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে এবং ২৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, নগদ ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং ১৩০৭ মেট্রিক টন খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। বন্যায় ৭৪ হাজার হেক্টর জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে এবং ৪০ হাজার পুকুর ও হেচারির মাছ ভেসে গিয়ে আনুমানিক ১৪২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, কোষ্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনী প্রধান এসএম শফিউদ্দিন সুনামগঞ্জে আসছেন উদ্ধার কার্যক্রম ও ত্রাণ বিতরণ তদারকী করতে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী, পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে জেলায় এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ১৮৯টি গবাদিপশুর মৃত্যু হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক ড. মো জাকির হোসেন জানান, পুরো জেলায় গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
হবিগঞ্জে আরো ৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত
সেখানে নতুন করে আরো ৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে ৭টি উপজেলার ৫১টি ইউনিয়ন এখন বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। উপজেলাগুলো হচ্ছে বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, লাখাই, হবিগঞ্জ সদর, বাহুবল ও মাধবপুর । জেলা ত্রান ও পুনবার্সন কার্যালয় সূত্র জানায়, বন্যা কবলিত এলাকায় ২২৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১৭ হাজার ৩৪৭ বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছেন। ২৩ হাজার ২শ ৩৫টি পরিবার পানি বন্দি রয়েছে। ৭৯হাজার ৭শ ২০জন লোক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও বেসরকারি হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা দ্বিগুন। জেলা প্রশাসন এ পর্যন্ত বন্যা কবলিত এলাকায় ২০০ মেট্রিক টন চাল, ১০ লক্ষ টাকা নগদ এবং ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরন করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বুধবার দুপুরে আজমিরীগঞ্জে কালনী-কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ১৪৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
জৈন্তাপুরে নদীতে ভেসে উঠল আরো একটি লাশ
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার সারী নদীর কামরাঙ্গী স্কুল ঘাটে গতকাল সকালে ভেসে ওঠে তিনদিন আগে নিখোঁজ বিলাল (৪০) নামে এক ব্যক্তির লাশ। তিনি চারিকাট ইউপির দক্ষিণ কামরাঙ্গীখেল গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহিব মিয়ার ছেলে।
কমলগঞ্জে ত্রাণ বিতরণ মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের নির্দেশে গতকাল পতনঊষার ইউনিয়নের গোপীনগর, রাধাগোবিন্দপুর, কান্দিগাঁও, মির্জাপুর, মাইজগাঁও এলাকার বন্যাকবলিতদের মাঝে ৪ মেট্টিক টন চাল ও ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
ঈশ্বরদীতে পদ্মায় পানি বাড়ছে, শুরু হয়েছে ভাঙন সেখানে পদ্মা নদীতে পানি বেড়েই চলেছে। সেই সাথে শুরু হয়েছে নদী ভাঙন। ভাঙন আতংকে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন পদ্মা পাড়ের মানুষ। প্রতিদিনই ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার পানি বাড়ায় নদীর চরাঞ্চল ডুবতে শুরু করেছে। সাঁড়া ইউনিয়নে নদী ভাঙনের ফলে হুমকির মধ্যে রয়েছে লালনশাহ সেতু রক্ষাবাঁধ ও নদীর বাম তীর সংরক্ষণ বাঁধটি। সাঁড়ার থানাপাড়া ও ব্লকপাড়ায় বাঁধের সামনের জমি ভাঙতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বাঁধের সামনের ১০ বিঘা জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের রিডার আরিফুন নাঈন ইবনে সালাম জানান, বুধবার বিকেলে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে ৯.৪৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছিল। তিনি জানান, প্রতিদিনই পানি বাড়ছে।
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান সুজন বলেন, কিছুদিন আগে সাঁড়ায় জিও প্যাক ডাম্পিং করে ভাঙন রোধ করা হয়। আবারো ভাঙন দেখা দিলে তাত্ক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বন্যার পানিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। ১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। বন্যার কারণে ৭ টি প্রাথমিক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপজেলার অরুয়াইল মোহিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। উপজেলার ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সরাইল-অরুয়াইল সড়কের এক থেকে দেড় কিলোমিটার অংশ পানিতে ডুবে গেছে। হাওরের মাঝে অবস্থিত সড়কটি দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। এ ছাড়া বন্যার পানিতে উপজেলার সরাইল-পানিশ্বর, তেরকান্দা-বড্ডাপাড়া, রসুলপুর-আজবপুর, শাহজাদাপুর-শাহবাজপুর সড়ক তলিয়ে গেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা একরাম হোসেন জানান, ৫০০ হেক্টর জমির আউশ ধান খেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৪৪টি ঘরের মধ্যে ২৫টিতে পানি ঢুকে গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের পানিবন্দী পরিবারগুলোর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।
গতকালও ত্রাণ পাননি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের মানুষ
বিজয়নগর (ব্রাক্ষণবাড়িয়া) সংবাদদাতা জানান, তিতাস নদী এবং কাজলা বিলের পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে গেছে বিজয়নগর উপজেলার ৩০ টি গ্রাম। পানিবন্দি হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। গতকাল পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের।
নেত্রকোনার পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, জেলার অধিকাংশ নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও উব্দাখালি নদীর কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার ও ধনু নদের খালিয়াজুরি পয়েন্টে গতকাল বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী উপজেলা দূর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টা ও খালিয়াজুরী উপজেলাসহ দশ উপজেলার ৭৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। জেলার ৩৪২ টি আশ্রয় কেন্দ্রে সোয়া লাখ বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। বন্যায় ভেসে গেছে প্রায় ৩০ হাজার পুকুরের মাছ। বিভিন্ন ইউনিয়নের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে সাড়ে ১২ লক্ষাধিক মানুষ। বানভাসীদের অভিযোগ, তারা প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী পাচ্ছে না। নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানিয়েছেন, জেলার বন্যা দুর্গতদের জন্য এ পর্যন্ত ১৩ লক্ষ নগদ টাকা, ৩৩৩ মেট্রিক টন চাল ও ৪ হাজার ৯৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৩১ মেট্রিক টন চাল, ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা ও ২ হাজার ৩শ শুকনো খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জে ২২০ গ্রামের আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি কিশোরগঞ্জে হাওরের পানি দ্রুত বাড়ছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। গত কয়েকদিনে জেলার ৭টি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নের ২২০ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। গতকাল কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান জানান, উজানের পানি দ্রুত হাওরে প্রবেশ করছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত জেলার নিকলী অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন, করিমগঞ্জ, তাড়াইল, বাজিতপুর ও ভৈরবসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় দেড় হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম জানান, ২৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্রের প্রায় ১২ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ১৪০ টন চাল, দুই হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট ও আড়াই লাখ টাকার জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৬ টন চাল ও নগদ এক লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মো. খলিলুর রহমান গতকাল কিশোরগঞ্জের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন ও বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন।
জামালপুরে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি জামালপুরে যমুনার পানি বৃদ্ধি অপরিবর্তিত রয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদ সীমার ৫৮সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলার ৭টি উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় ৩৬টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে তলিয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক জানান, ১১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করায় ৬৬ প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে।
শেরপুরের পল্লীতে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ শেরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। তবে ভাটি এলাকায় এখনও পানিবন্দি রয়েছে শতশত মানুষ। গবাদিপশু, হাস মুরগী নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে শত শত পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার জানান, বন্যার্তদের মাঝে ইতিমধ্যে ১০০ মেটিÌক টন বিশেষ বরাদ্দের চাল, ৫ লাখ টাকা ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
গাইবান্ধায় গো-খাদ্য সংকট গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকায় মানুষের কষ্ট দিন দিন বেড়েই চলছে। গো-খাদ্য সংকটে গবাদি পশু নিয়ে তারা বিপাকে পড়েছেন। গতকাল বেলা তিনটায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ২৩টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। অন্তত ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা কবলিত চার উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ইতিমধ্যে ৮০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৬ লাখ, শিশু খাদ্য ক্রয় বাবদ ১৫ লাখ ৫০ হাজার এবং গো খাদ্য ক্রয় বাবদ ১৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।