ঢাকা ০৪:৪৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাড়া মহল্লার মৃত্যুদূত ওরা বড়ই ভয়ংকর

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:০৪:০০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ জুন ২০২২
  • ১১২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ২১ ফেব্রুয়ারী রাত ১১টা। ধানমন্ডির বাসিন্দা ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমানের ঘুম ভাঙে হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে।

দরজা খুলে দেখেন অস্ত্রহাতে দাঁড়িয়ে তিন কিশোর। আকস্মিক তার দিকে অস্ত্র তাক করে বলা হয়-‘মজিবুর ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে ফেল। না হলে মরবি।’

শুধু ধানমন্ডিতে নয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এভাবেই ভাড়া খাটছে কিশোর গ্যাং। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখল কিংবা চুক্তিতে খুন। কিছুই বাদ নেই।

তাদের অনেকেই পেশাদার সন্ত্রাসী। কেউ কেউ পাড়া-মহল্লার সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানবে কে? এমনটিই মনে করছেন ভুক্তভোগী মহল।

যা বললেন মোস্তাফিজুর রহমান : ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তিনি গণপূর্তের ঠিকাদার। ধানমন্ডির ১১/এ রোডের ৭৭ নম্বর ভবনে তার নিজের ফ্ল্যাট। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে বসবাস করছেন। ফলে এলাকায় তিনি সুপরিচিত। ঘটনার দিন তিনি বাসায় ফিরে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। ১০টা ৪০ মিনিটে কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙে তার। গেট খুলে দেখেন তিনজন অল্প বয়সি ছেলে অস্ত্র হাতে দরজার সামনে দাঁড়ানো। তিনি প্রশ্ন করেন কি চাই। তারা বলে-আপনি কি মোস্তাফিজ? হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র তাক করে সন্ত্রাসীরা বলে, মজিবর ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেন। না হলে মরবেন।’

‘তাদের কথায় আমি হতবাক। এরা বলে কী? আর বেশি কথা না বাড়িয়ে আমি দরজা লাগিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা। দরজায় দাঁড়িয়ে একটানা কলিংবেল বাজাতে থাকল তারা। এক পর্যায়ে আমি ইন্টারকম থেকে ভবনের নিচে দারোয়ানকে ফোন দিলাম। দেখলাম সেও আতঙ্কিত। দারোয়ান আমাকে বলল, স্যার তিনটা মোটরসাইকেলে ওরা মোট নয়জন এসেছে। তিনজন গেছে আপনার বাসায়। আর ছয়জন দাঁড়িয়ে আছে নিচে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘটনার পর তিনি খোঁজখবর শুরু করেন। এক পর্যায়ে জানা যায়, অস্ত্রধারীরা স্থানীয় এক প্রভাবশালীর হয়ে কাজ করে। টাকা-পয়সা এবং জমিসংক্রান্ত বিরোধে ভাড়া খাটে তারা। পূর্বশত্রুতার জের ধরে তাদের ভাড়া করেন মজিবুর রহমান নামের তার এক প্রতিবেশী। পুরো ঘটনা সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ ধানমন্ডি থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু মামলার পরিবর্তে জিডি নেওয়া হয়। জিডি তদন্তের দায়িত্ব পান ধানমন্ডি থানার এসআই রাজিব হাসান। তদন্তের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বুধবার সন্ধ্যায় তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ঘটনাটি প্রমাণের জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর্যায়ে আছে। আইনগতভাবে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

উত্তরার বড় ঘাঁটি : উত্তরায় সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের বেশ কয়েকটি রীতিমতো ভয়ংকর। অপরাধ জগতে তাদের তৎপরতা গা শিউরে ওঠার মতো। এদের অন্যতম জুয়েল ওরফে পালসার জুয়েল। ওলিগলিতে প্রতিদিনই হোন্ডা পার্টিসহযোগে ক্ষমতার শোডাউন দেয় জুয়েল গ্যাং।

যাকে-তাকে মারধর এবং অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ফোটানো জুয়েলের অন্যতম শখ। উত্তরা ৮, ৯ এবং ১০ নম্বর সেক্টরে জুয়েল গ্রুপের দৌরাত্ম্য এখন স্থানীয়দের গাসওয়া হতে বাধ্য করেছে। পালসার জুয়েল ছাড়াও একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয় হাশেম চেয়ারম্যানের ছেলে নাজমুল। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা আছে। তবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক শেল্টারের কারণে নীরব ভূমিকা বেছে নিয়েছে পুলিশ।

উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ বলছে, বেশ কয়েকটি মদের বার ঘিরে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। এর মধ্যে ১৩ নম্বর সেক্টরে গরিব-ই-নেওয়াজ এভিনিউয়ে অবস্থিত লেক ভিউ (কিং ফিশার) মদের বার ঘিরে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা লাগামহীন। গভীর রাত পর্যন্ত সদলবলে বারে মদপান শেষে রাস্তায় নেমে আসে এসব বখাটে। এরপর ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারধরসহ নানা অপরাধের সূত্রপাত ঘটে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন থানায় অভিযোগ আসছে।

মদের বারে ২ ঘণ্টা : গত শনিবার রাত ১০টায় লেক ভিউ বারে সরেজমিন হাজির হয় যুগান্তর প্রতিবেদক। দেখা যায়, ৩৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের একটি বাড়িতে রেস্টুরেন্ট কাম বার চলছে। ভবনের ৪, ৫ এবং ৬ তলায় মদপানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বারের ভেতর বিভিন্ন টেবিলে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি কিশোর-তরুণীকে মদপান করতে দেখা যায়। অথচ আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক না হলে বারে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু এখানে সে আইন মানার ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না।

রাত তখন পৌনে ১১টা। হঠাৎ ভিআইপি সাইরেন বাজিয়ে দুটি দ্রুতগতির পাজেরো জিপ বারের গেটে এসে থামে। মুহূর্তে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। তটস্থ হয়ে ওঠেন বারের নিরাপত্তারক্ষীরা। বারের কয়েকজন কর্মী গাড়ির দিকে এগিয়ে যান। এক পর্যায়ে দরজা খুলে নামে দুই কিশোর। তাদের একজনকে ভারসাম্যহীন দেখা যায়। হাঁটতে গিয়ে সে হঠাৎ রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি তাকে টেনে তোলে বারের নিরাপত্তারক্ষীরা। একপর্যায়ে তারা গিয়ে দাঁড়ায় গাড়ির পেছনে। এরপর তটস্থ বার কর্মীরা ছুটলেন ওপরে। কিছুক্ষণের মধ্যে মদের বোতল এবং কয়েকটি বিয়ার ক্যান নিয়ে বখাটের কাছে ফিরলেন তারা। মদের বোতল ধরিয়ে দিতেই ফিল্মিস্টাইলে শুরু হলো তাদের মদপানের পর্ব। ভাবখানা এমন যে, দুই প্রভাবশালীর গুণধর কিশোরপুত্র পুরো প্রশাসন ও সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মদ উৎসব করছেন। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক ও ক্ষুব্ধ পথচারীদের মুখেও শোনা যাচ্ছিল তির্যক মন্তব্য।

মদপানরত কিশোরদের আনা দুটি সাদা ল্যান্ডক্রুজারের নম্বর যথাক্রমে ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৫-৩৪০৪ এবং ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫-৪৪৩৯। গাড়িতে সংসদ সদস্য স্টিকার সাঁটানো। গাড়ির ইঞ্জিন চালু আছে। আবার কান ফাটানো সাইরেনও বেজেই যাচ্ছে। সবাই বিরক্ত অতিষ্ঠ। তবে কিচ্ছুক্ষণ পর বোঝা গেল এটা নাকি তাদের আতঙ্ক সৃষ্টি করার আর একটা পদ্ধতি।

একপর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে প্রতিবেদক এক কিশোরের কাছে জানতে চান-‘আপনাদের পা টলছে। এ অবস্থায় গাড়ি চালাতে পারবেন? প্রশ্ন শুনে তাদের মুখে যেন ভিলেনের হাসি। এরপর জড়ানো শব্দে এক কিশোর জবাব দেয়, ‘আমরা তিন বোতল খাওইন্ন্যা পোলা। কেবল তো শুরু করছি। আধা বোতলও হয়নি।’ পুরো ঘটনা মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করে যুগান্তর প্রতিবেদক।

এদিকে রোববার বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে জিপ দুটির মালিকের খোঁজ নেওয়া হয়। কিন্তু মালিক হিসাবে কোনো সংসদ সদস্যের নাম পাওয়া যায়নি। নিবন্ধন অনুযায়ী ঢাকা মেট্রো ঘ ১৫-৩৪০৪ নম্বর গাড়ি মালিকের নাম ফাতেমা বেগম লাকি। প্রযত্নে-সাইফুর রহমান। এছাড়া ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫-৪৪৩৯ নম্বর পাজেরো জিপের মালিক জনৈকা ফিরোজা খাতুন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসির অর্থায়নে গাড়িটি কেনা হয়।

খুনোখুনি পল্লবীতে : পল্লবীর ১৮ নম্বর রোড ঘিরে সক্রিয় ভাই ভাই গ্রুপ। মধ্যরাতের হোন্ডা রেস তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাইলেন্সার পাইপ খুলে বিকট শব্দে একাধিক হোন্ডা একসঙ্গে ছুটে যায়। এতে গভীর রাতে মহল্লায় আতঙ্ক নেমে আসে। ভাই ভাই গ্রুপের লিডার হিসাবে পুলিশের খাতায় নাম আছে ইমন ও তার ভাই বিল্লালের।

পুলিশ জানায়, পল্লবীতে ৭টি কিশোর গ্যাং তালিকাভুক্ত। গ্যাং লিডার হিসাবে নাম আছে ৫ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নেতা নাঈম, বিহারি ক্যাম্পের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন ওরফে বন্টু, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা খলিলুর রহমান, মহানগর উত্তর যুবলীগের সদস্য সুলতান, ৯১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের কর্মী ফারুক ও নুর ইসলাম এবং পল্লবী থানা ছাত্রলীগের নেতা মিলন ঢালির। এছাড়া একাধিক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এলাকার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী শুক্কুর ওরফে শুক্কুর মাতবর।

২৪ মে সরেজমিন পল্লবী এলাকায় গেলে স্থানীয়রা জানান, আলোচিত শাহিন উদ্দীন হত্যাকাণ্ডের পর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমে আসে। কিন্তু এখন অলিগলিতে ফের মহড়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বাউনিয়া বাঁধ, প্যারিস রোড এবং ১১ নম্বর সি ব্লকে সক্রিয় একাধিক গ্রুপ। ফুটপাতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং দখলসহ নানাবিধ অপকর্মে তারা জড়িত। এর মধ্যে ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে ভাসানী হোটেলের মোড় এবং নান্নু মার্কেট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ফুটপাতের চাঁদাবাজি বাপ্পা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।

বাড়ছে মামলা : ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের রেকর্ড অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকার ১৪টি নারী ও শিশু আদালতে কিশোর অপরাধের বিপুলসংখ্যক মামলা ঝুলছে। চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭২১টি। এর মধ্যে ছিনতাই, মারামারি, অপহরণের মামলা সর্বাধিক।

বন্দি অনেক : আইন অনুযায়ী অপরাধে জড়িত শিশু-কিশোরদের আটক রাখা হয় রাজধানীর উপকণ্ঠে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে। ২৪ মে সকাল ১১টায় সেখানে হাজির হয় যুগান্তর প্রতিবেদক। প্রধান ফটক ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, অন্তত পনেরো জন কিশোর তালাবদ্ধ গ্রিলঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অপরপ্রান্তে অপেক্ষমাণ তাদের উদ্বিগ্ন স্বজনরা। গ্রিলের ফোকর দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কেউ কেউ।

দায়িত্ব পালনরত আনসার সদস্যরা জানান, লাইনে দাঁড়ানো কিশোরদের জামিনের আদেশ এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুক্তি পাবে তারা। বাইরে দাঁড়ানো স্বজনরা তাদের নিতে এসেছেন।

বারান্দার দেওয়ালে ঝোলানো বোর্ডে বন্দির সংখ্যাসহ বিভিন্ন তথ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। ২২ মে পর্যন্ত বন্দি শিশু-কিশোরের সংখ্যা ৭৫২ জন। এর মধ্যে হত্যা মামলায় বন্দি ১৪৪, মাদক মামলায় দেড়শ, নারী ও শিশু সংক্রান্ত অপরাধে ১৭২ এবং চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই মামলায় আটক দুশর বেশি।

কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের মনোস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিভাগের পরামর্শক আজিজুল ইসলাম  বলেন, দীর্ঘ সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ভাসমান কিশোরদের অনেকে খুনের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পরিবারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তারা সহজেই অপরাধ জগতের সঙ্গে মিশে যেতে পারছে।

কেন্দ্রের প্রবেশন কর্মকর্তা তৌফিক হোসেন  বলেন, ‘কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এখান থেকে অনেক শিশু-কিশোরকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পুরোনো পরিবেশে ফিরে তাদের কেউ কেউ ঠিক থাকতে পারে না। পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে অনেকেই এখানে বারবার ফিরে আসছে।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

পাড়া মহল্লার মৃত্যুদূত ওরা বড়ই ভয়ংকর

আপডেট টাইম : ১০:০৪:০০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ জুন ২০২২

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ২১ ফেব্রুয়ারী রাত ১১টা। ধানমন্ডির বাসিন্দা ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমানের ঘুম ভাঙে হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে।

দরজা খুলে দেখেন অস্ত্রহাতে দাঁড়িয়ে তিন কিশোর। আকস্মিক তার দিকে অস্ত্র তাক করে বলা হয়-‘মজিবুর ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে ফেল। না হলে মরবি।’

শুধু ধানমন্ডিতে নয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এভাবেই ভাড়া খাটছে কিশোর গ্যাং। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখল কিংবা চুক্তিতে খুন। কিছুই বাদ নেই।

তাদের অনেকেই পেশাদার সন্ত্রাসী। কেউ কেউ পাড়া-মহল্লার সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানবে কে? এমনটিই মনে করছেন ভুক্তভোগী মহল।

যা বললেন মোস্তাফিজুর রহমান : ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তিনি গণপূর্তের ঠিকাদার। ধানমন্ডির ১১/এ রোডের ৭৭ নম্বর ভবনে তার নিজের ফ্ল্যাট। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে বসবাস করছেন। ফলে এলাকায় তিনি সুপরিচিত। ঘটনার দিন তিনি বাসায় ফিরে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। ১০টা ৪০ মিনিটে কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙে তার। গেট খুলে দেখেন তিনজন অল্প বয়সি ছেলে অস্ত্র হাতে দরজার সামনে দাঁড়ানো। তিনি প্রশ্ন করেন কি চাই। তারা বলে-আপনি কি মোস্তাফিজ? হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র তাক করে সন্ত্রাসীরা বলে, মজিবর ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেন। না হলে মরবেন।’

‘তাদের কথায় আমি হতবাক। এরা বলে কী? আর বেশি কথা না বাড়িয়ে আমি দরজা লাগিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা। দরজায় দাঁড়িয়ে একটানা কলিংবেল বাজাতে থাকল তারা। এক পর্যায়ে আমি ইন্টারকম থেকে ভবনের নিচে দারোয়ানকে ফোন দিলাম। দেখলাম সেও আতঙ্কিত। দারোয়ান আমাকে বলল, স্যার তিনটা মোটরসাইকেলে ওরা মোট নয়জন এসেছে। তিনজন গেছে আপনার বাসায়। আর ছয়জন দাঁড়িয়ে আছে নিচে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘটনার পর তিনি খোঁজখবর শুরু করেন। এক পর্যায়ে জানা যায়, অস্ত্রধারীরা স্থানীয় এক প্রভাবশালীর হয়ে কাজ করে। টাকা-পয়সা এবং জমিসংক্রান্ত বিরোধে ভাড়া খাটে তারা। পূর্বশত্রুতার জের ধরে তাদের ভাড়া করেন মজিবুর রহমান নামের তার এক প্রতিবেশী। পুরো ঘটনা সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ ধানমন্ডি থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু মামলার পরিবর্তে জিডি নেওয়া হয়। জিডি তদন্তের দায়িত্ব পান ধানমন্ডি থানার এসআই রাজিব হাসান। তদন্তের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বুধবার সন্ধ্যায় তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ঘটনাটি প্রমাণের জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর্যায়ে আছে। আইনগতভাবে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

উত্তরার বড় ঘাঁটি : উত্তরায় সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের বেশ কয়েকটি রীতিমতো ভয়ংকর। অপরাধ জগতে তাদের তৎপরতা গা শিউরে ওঠার মতো। এদের অন্যতম জুয়েল ওরফে পালসার জুয়েল। ওলিগলিতে প্রতিদিনই হোন্ডা পার্টিসহযোগে ক্ষমতার শোডাউন দেয় জুয়েল গ্যাং।

যাকে-তাকে মারধর এবং অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ফোটানো জুয়েলের অন্যতম শখ। উত্তরা ৮, ৯ এবং ১০ নম্বর সেক্টরে জুয়েল গ্রুপের দৌরাত্ম্য এখন স্থানীয়দের গাসওয়া হতে বাধ্য করেছে। পালসার জুয়েল ছাড়াও একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয় হাশেম চেয়ারম্যানের ছেলে নাজমুল। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা আছে। তবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক শেল্টারের কারণে নীরব ভূমিকা বেছে নিয়েছে পুলিশ।

উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ বলছে, বেশ কয়েকটি মদের বার ঘিরে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। এর মধ্যে ১৩ নম্বর সেক্টরে গরিব-ই-নেওয়াজ এভিনিউয়ে অবস্থিত লেক ভিউ (কিং ফিশার) মদের বার ঘিরে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা লাগামহীন। গভীর রাত পর্যন্ত সদলবলে বারে মদপান শেষে রাস্তায় নেমে আসে এসব বখাটে। এরপর ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারধরসহ নানা অপরাধের সূত্রপাত ঘটে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন থানায় অভিযোগ আসছে।

মদের বারে ২ ঘণ্টা : গত শনিবার রাত ১০টায় লেক ভিউ বারে সরেজমিন হাজির হয় যুগান্তর প্রতিবেদক। দেখা যায়, ৩৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের একটি বাড়িতে রেস্টুরেন্ট কাম বার চলছে। ভবনের ৪, ৫ এবং ৬ তলায় মদপানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বারের ভেতর বিভিন্ন টেবিলে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি কিশোর-তরুণীকে মদপান করতে দেখা যায়। অথচ আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক না হলে বারে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু এখানে সে আইন মানার ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না।

রাত তখন পৌনে ১১টা। হঠাৎ ভিআইপি সাইরেন বাজিয়ে দুটি দ্রুতগতির পাজেরো জিপ বারের গেটে এসে থামে। মুহূর্তে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। তটস্থ হয়ে ওঠেন বারের নিরাপত্তারক্ষীরা। বারের কয়েকজন কর্মী গাড়ির দিকে এগিয়ে যান। এক পর্যায়ে দরজা খুলে নামে দুই কিশোর। তাদের একজনকে ভারসাম্যহীন দেখা যায়। হাঁটতে গিয়ে সে হঠাৎ রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি তাকে টেনে তোলে বারের নিরাপত্তারক্ষীরা। একপর্যায়ে তারা গিয়ে দাঁড়ায় গাড়ির পেছনে। এরপর তটস্থ বার কর্মীরা ছুটলেন ওপরে। কিছুক্ষণের মধ্যে মদের বোতল এবং কয়েকটি বিয়ার ক্যান নিয়ে বখাটের কাছে ফিরলেন তারা। মদের বোতল ধরিয়ে দিতেই ফিল্মিস্টাইলে শুরু হলো তাদের মদপানের পর্ব। ভাবখানা এমন যে, দুই প্রভাবশালীর গুণধর কিশোরপুত্র পুরো প্রশাসন ও সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মদ উৎসব করছেন। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক ও ক্ষুব্ধ পথচারীদের মুখেও শোনা যাচ্ছিল তির্যক মন্তব্য।

মদপানরত কিশোরদের আনা দুটি সাদা ল্যান্ডক্রুজারের নম্বর যথাক্রমে ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৫-৩৪০৪ এবং ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫-৪৪৩৯। গাড়িতে সংসদ সদস্য স্টিকার সাঁটানো। গাড়ির ইঞ্জিন চালু আছে। আবার কান ফাটানো সাইরেনও বেজেই যাচ্ছে। সবাই বিরক্ত অতিষ্ঠ। তবে কিচ্ছুক্ষণ পর বোঝা গেল এটা নাকি তাদের আতঙ্ক সৃষ্টি করার আর একটা পদ্ধতি।

একপর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে প্রতিবেদক এক কিশোরের কাছে জানতে চান-‘আপনাদের পা টলছে। এ অবস্থায় গাড়ি চালাতে পারবেন? প্রশ্ন শুনে তাদের মুখে যেন ভিলেনের হাসি। এরপর জড়ানো শব্দে এক কিশোর জবাব দেয়, ‘আমরা তিন বোতল খাওইন্ন্যা পোলা। কেবল তো শুরু করছি। আধা বোতলও হয়নি।’ পুরো ঘটনা মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করে যুগান্তর প্রতিবেদক।

এদিকে রোববার বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে জিপ দুটির মালিকের খোঁজ নেওয়া হয়। কিন্তু মালিক হিসাবে কোনো সংসদ সদস্যের নাম পাওয়া যায়নি। নিবন্ধন অনুযায়ী ঢাকা মেট্রো ঘ ১৫-৩৪০৪ নম্বর গাড়ি মালিকের নাম ফাতেমা বেগম লাকি। প্রযত্নে-সাইফুর রহমান। এছাড়া ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫-৪৪৩৯ নম্বর পাজেরো জিপের মালিক জনৈকা ফিরোজা খাতুন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসির অর্থায়নে গাড়িটি কেনা হয়।

খুনোখুনি পল্লবীতে : পল্লবীর ১৮ নম্বর রোড ঘিরে সক্রিয় ভাই ভাই গ্রুপ। মধ্যরাতের হোন্ডা রেস তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাইলেন্সার পাইপ খুলে বিকট শব্দে একাধিক হোন্ডা একসঙ্গে ছুটে যায়। এতে গভীর রাতে মহল্লায় আতঙ্ক নেমে আসে। ভাই ভাই গ্রুপের লিডার হিসাবে পুলিশের খাতায় নাম আছে ইমন ও তার ভাই বিল্লালের।

পুলিশ জানায়, পল্লবীতে ৭টি কিশোর গ্যাং তালিকাভুক্ত। গ্যাং লিডার হিসাবে নাম আছে ৫ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নেতা নাঈম, বিহারি ক্যাম্পের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন ওরফে বন্টু, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা খলিলুর রহমান, মহানগর উত্তর যুবলীগের সদস্য সুলতান, ৯১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের কর্মী ফারুক ও নুর ইসলাম এবং পল্লবী থানা ছাত্রলীগের নেতা মিলন ঢালির। এছাড়া একাধিক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এলাকার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী শুক্কুর ওরফে শুক্কুর মাতবর।

২৪ মে সরেজমিন পল্লবী এলাকায় গেলে স্থানীয়রা জানান, আলোচিত শাহিন উদ্দীন হত্যাকাণ্ডের পর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমে আসে। কিন্তু এখন অলিগলিতে ফের মহড়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বাউনিয়া বাঁধ, প্যারিস রোড এবং ১১ নম্বর সি ব্লকে সক্রিয় একাধিক গ্রুপ। ফুটপাতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং দখলসহ নানাবিধ অপকর্মে তারা জড়িত। এর মধ্যে ১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে ভাসানী হোটেলের মোড় এবং নান্নু মার্কেট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ফুটপাতের চাঁদাবাজি বাপ্পা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।

বাড়ছে মামলা : ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের রেকর্ড অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকার ১৪টি নারী ও শিশু আদালতে কিশোর অপরাধের বিপুলসংখ্যক মামলা ঝুলছে। চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭২১টি। এর মধ্যে ছিনতাই, মারামারি, অপহরণের মামলা সর্বাধিক।

বন্দি অনেক : আইন অনুযায়ী অপরাধে জড়িত শিশু-কিশোরদের আটক রাখা হয় রাজধানীর উপকণ্ঠে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে। ২৪ মে সকাল ১১টায় সেখানে হাজির হয় যুগান্তর প্রতিবেদক। প্রধান ফটক ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, অন্তত পনেরো জন কিশোর তালাবদ্ধ গ্রিলঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অপরপ্রান্তে অপেক্ষমাণ তাদের উদ্বিগ্ন স্বজনরা। গ্রিলের ফোকর দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কেউ কেউ।

দায়িত্ব পালনরত আনসার সদস্যরা জানান, লাইনে দাঁড়ানো কিশোরদের জামিনের আদেশ এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুক্তি পাবে তারা। বাইরে দাঁড়ানো স্বজনরা তাদের নিতে এসেছেন।

বারান্দার দেওয়ালে ঝোলানো বোর্ডে বন্দির সংখ্যাসহ বিভিন্ন তথ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। ২২ মে পর্যন্ত বন্দি শিশু-কিশোরের সংখ্যা ৭৫২ জন। এর মধ্যে হত্যা মামলায় বন্দি ১৪৪, মাদক মামলায় দেড়শ, নারী ও শিশু সংক্রান্ত অপরাধে ১৭২ এবং চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই মামলায় আটক দুশর বেশি।

কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের মনোস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিভাগের পরামর্শক আজিজুল ইসলাম  বলেন, দীর্ঘ সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ভাসমান কিশোরদের অনেকে খুনের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পরিবারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তারা সহজেই অপরাধ জগতের সঙ্গে মিশে যেতে পারছে।

কেন্দ্রের প্রবেশন কর্মকর্তা তৌফিক হোসেন  বলেন, ‘কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এখান থেকে অনেক শিশু-কিশোরকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পুরোনো পরিবেশে ফিরে তাদের কেউ কেউ ঠিক থাকতে পারে না। পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে অনেকেই এখানে বারবার ফিরে আসছে।’