ঢাকা ০৬:৫৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বন্যার মুখে হাওর অঞ্চল

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:১৮:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২
  • ১৩১ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের হাওর অঞ্চলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে আকস্মিক বন্যার মুখে পড়েছে হাওর অঞ্চল। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উজানে ভারতের আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে হাওর এলাকায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে আবারও বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। হাওর অঞ্চলে নদ-নদীসমূহের ৩৩টি পয়েন্ট পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে সুরমা ও সারিগোয়াইন নদী ৪টি স্থানে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে হাওর অঞ্চলে আধাপাকা ইরি-বোরো ধান ও অন্যান্য ফল-ফসলের নতুন করে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে গতকাল শুক্রবার একথা জানা গেছে।
দেশের হাওর অঞ্চলের নদ-নদীসমূহের পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল জানায়, আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টায় সিলেট সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় আকস্মিক বন্যার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। পাউবোর কেন্দ্র জানায়, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও হবিগঞ্জ জেলার প্রধান নদ-নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগের তথ্য ও পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশের কতিপয় স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
এর ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার প্রধান নদ-নদীসমূহের পানির সমতল কতিপয় স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষিতে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। যার ফলে সুরমা নদী সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় এবং ধনু বাউলাই নদী নেত্রকোণা জেলায় কতিপয় পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ইতোমধ্যে সুরমা নদী দু’টি পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।
নদ-নদী প্রবাহের অবস্থা সম্পর্কে জানা গেছে, পাউবোর পর্যবেক্ষণাধীন ৩৯টি স্টেশনের মধ্যে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে ৩৩টি পয়েন্টে, হ্রাস পাচ্ছে ৬টিতে। এরমধ্যে গতকাল বিকাল পর্যন্ত সুরমা নদী কানাইঘাটে ২৫ সেন্টিমিটার ও সিলেটে ১৩ সে.মি. এবং সারিগোয়াইন নদী সারিঘাট ও গোয়াইনঘাটে বিপদসীমার যথাক্রমে ৪০ ও ৫৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীও বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। অথচ গত বুধবার পর্যন্ত হাওর অঞ্চলে নদ-নদীর ১৭টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি এবং ২১টি পয়েন্টে হ্রাস পায়।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচলে ভারী বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেট অঞ্চলের লালাখালে ৭৮ মি.মি., শেওলায় ৪২ মি.মি. এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় প্রদেশের চেরাপুঞ্জিতে ২৮৮ মি.মি., শীলচরে ৫৭ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়েছে।
আজ শনিবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সাথে প্রবল বিজলী চমকানোসহ বৃষ্টি, বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আকাশ আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। রাজশাহী, পাবনা ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের উপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্র প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে।
এদিকে গাজীপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, অসময়ের পানিতে তলিয়ে গেছে গাজীপুর জেলার বিভিন্ন জায়গার ১২০ হেক্টর জমির কৃষকের ফসল। যে ধানে তাদের সারা বছরের ভাতের চিন্তা করতে হতো না সেই ধান অসময়ের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
গত দু’দিন ধরে টাঙ্গাইলের যমুনা নদী, গাজীপুরের তুরাগ এবং কালিয়াকৈর উপজেলার মকশ বিলসহ কয়েকটি বিলের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষকরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর মহানগরের ইসলামপুর, ইটাহাটা, কড্ডা, মজলিসপুর, লাটিভাঙ্গা, সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকার তুরাগ নদের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো, কালিয়াকৈর উপজেলার মকশ বিল এবং মৌচাক এলাকার ধানের আবাদি জমি পানিতে ডুবে গেছে।
গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকার কৃষক ইন্তাজ উদ্দিন জানান, তিনি এবার এক একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেন। ফসল ভালো হয়েছে। আর কয়েকটা দিন সময় পেলে ধানগুলো পুরোপুরি পেঁকে যেত। কিন্তু হঠাৎ করে তুরাগ নদে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জমির ধান তলিয়ে গেছে। তার মতো অনেক কৃষক এমন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকের মতো তিনিও আধাপাকা ধান কাটা শুরু করেছেন।
গাজীপুর মহানগরের মজলিসপুর এলাকার কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, তিনি এবার ৭০ শতক জমিতে স্থানীয় জাতের বোরো আবাদ করেন। ধানের শীষগুলো বেশ ঘন ছিল। এই ধান বর্তমানে কাঁচা এবং আধাপাকা অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে সব ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি নেমে গেলেও কাঙ্খিত ফসল এ মুহূর্তে ঘরে তোলা সম্ভব হবে না। জমিতে দুই থেকে তিন ফুট উচ্চতার পানি রয়েছে। এ মুহূর্তে ধানকাটা শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না।
কালিয়াকৈর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার প্রায় ১০ হাজার ১৭৫ হেক্টর জমিতে এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে। হঠাৎ নদী ও বিলের পানি বৃদ্ধির কারণে উপজেলার মকশ বিল, কালিয়াদহ বিল, রঘুনাথপুর, বোয়ালী বিল, চান পাত্রা, আলুয়া বিলসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৫০০ বিঘা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। কাটার উপযোগী না হলেও কাঁচা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।
গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানান, যেসব জমির ধান প্রায় পেঁকে গেছে সেসব জমির চাষিরা ধান কাটা শুরু করেছেন। কিছু ধান ওঠানো সম্ভব হবে। তবে বেশির ভাগ কৃষকই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। উপজেলা এবং উপ-সহ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

 

তারা তালিকা প্রস্তুত করছেন। একাধিক কৃষক জানান, যে ধানে তাদের সারা বছরের ভাত হতো এত কষ্ট ও ধার দেনা করে ফলালো তাদের সেই ধান অসময়ের পানি তলিয়ে যাওয়ায় তারা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
সুনামগঞ্জে বেড়েছে নদনদীর পানি : তাড়াহুড়ো করে হাওরের ধান কেটে ঘরে তুলছেন কৃষকেরা। সুনামগঞ্জে আবারও উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার সুরমা নদীর পানি বেড়েছে ৬২ সেন্টিমিটার। এ ছাড়া জেলার সীমান্তবর্তী যাদুকাটা নদী ও পাটলাই নদেও পানি বেড়েছে। তাই দ্বিতীয় দফা হাওরের ফসল ঝুঁকিতে পড়েছে।
তবে সুনামগঞ্জে গত দু’দিন ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকেরা কিছুটা স্বস্তিতে। এ অবস্থায় যেসব হাওরে ধান পেকেছে, সেখানে ধান কাটছেন তারা। একই সঙ্গে বৃষ্টি না হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ ফসল রক্ষা বাঁধগুলোর সংস্কারকাজ চলমান।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তথ্য মতে, ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে আবার ভারী বৃষ্টি হয়েছে। উজানে বৃষ্টি হওয়ার কারণে সুনামগঞ্জে নদ-নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে প্রথম আঘাত হানে জেলার তাহিরপুর উপজেলায়। মূলত এই উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি নামে প্রথম। টাঙ্গুয়া ও আশপাশের হাওরগুলোতে পানির চাপ রয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ কারণে সেখানে থাকা বাঁধগুলো রয়েছে ঝুঁকিতে। যদিও টাঙ্গুয়ার হাওরে বোরো ফসল হয় কম, এই হাওর উজানের ঢলের পানি ধরে রাখা ‘ট্যাংক’ হিসেবে পরিচিতি। এখানে পানি থাকলে অন্য হাওরে চাপ কমে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান করিব জানান, বাঁধে পানির চাপ বেড়েছে। সমস্যা হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের বাঁধগুলো নিয়ে। এখানে দিনরাত কাজ করতে হচ্ছে। দেখা গেছে, একদিকে কাজ করলে অন্যদিকে ফাটল দেখা দেয়। আবার ধসে যাচ্ছে। তখন সেখানেও কাজ করতে হয়। উপজেলার অন্য হাওরগুলোর বাঁধ ভালো আছে বলে জানান তিনি।
কৃষক আবদুল গণি আনসারী জানান, এলাকার রক্তি নদের পানি বাড়ছে। মানুষ আতঙ্ক নিয়েই ধান কাটছে। তিনি চার একর জমির মধ্যে দুই একর কেটেছেন। সবাই এখন ধান কাটার চেষ্টা করছেন। আবদুল গণি বলেন, এবার সুনামগঞ্জে কম বৃষ্টি হওয়াতেই ফসল এখন পর্যন্ত ঠিক আছে আছে। মানুষ বাঁধে যেমন কাজ করতে পারছে, তেমনি ধানও কাটতে সুবিধা হচ্ছে। না হলে উজান ও ভাটির বৃষ্টিতে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে হাওরের সব ধান তলিয়ে যেত। যেভাবে ২০১৭ সালে হয়েছিল।
জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ বলেন, ‘আমরা একদিকে কৃষকদের বলছি ধান কাটতে, অন্যদিকে হাওরের বাঁধ রক্ষায় কাজ করছি। সুনামগঞ্জে গতকাল দুপুরের রোদ দেখলে তো বোঝা যাবে না, হাওরে কী হচ্ছে। পানি কিন্তু বাড়ছে। দেখা যাবে ঝড়-বৃষ্টি নেই, কিন্তু ঢলে ফসলের সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

বন্যার মুখে হাওর অঞ্চল

আপডেট টাইম : ১০:১৮:৫৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের হাওর অঞ্চলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে আকস্মিক বন্যার মুখে পড়েছে হাওর অঞ্চল। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উজানে ভারতের আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে হাওর এলাকায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে আবারও বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। হাওর অঞ্চলে নদ-নদীসমূহের ৩৩টি পয়েন্ট পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে সুরমা ও সারিগোয়াইন নদী ৪টি স্থানে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে হাওর অঞ্চলে আধাপাকা ইরি-বোরো ধান ও অন্যান্য ফল-ফসলের নতুন করে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে গতকাল শুক্রবার একথা জানা গেছে।
দেশের হাওর অঞ্চলের নদ-নদীসমূহের পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল জানায়, আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টায় সিলেট সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় আকস্মিক বন্যার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। পাউবোর কেন্দ্র জানায়, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও হবিগঞ্জ জেলার প্রধান নদ-নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগের তথ্য ও পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশের কতিপয় স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
এর ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার প্রধান নদ-নদীসমূহের পানির সমতল কতিপয় স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষিতে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। যার ফলে সুরমা নদী সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় এবং ধনু বাউলাই নদী নেত্রকোণা জেলায় কতিপয় পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ইতোমধ্যে সুরমা নদী দু’টি পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।
নদ-নদী প্রবাহের অবস্থা সম্পর্কে জানা গেছে, পাউবোর পর্যবেক্ষণাধীন ৩৯টি স্টেশনের মধ্যে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে ৩৩টি পয়েন্টে, হ্রাস পাচ্ছে ৬টিতে। এরমধ্যে গতকাল বিকাল পর্যন্ত সুরমা নদী কানাইঘাটে ২৫ সেন্টিমিটার ও সিলেটে ১৩ সে.মি. এবং সারিগোয়াইন নদী সারিঘাট ও গোয়াইনঘাটে বিপদসীমার যথাক্রমে ৪০ ও ৫৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীও বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। অথচ গত বুধবার পর্যন্ত হাওর অঞ্চলে নদ-নদীর ১৭টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি এবং ২১টি পয়েন্টে হ্রাস পায়।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচলে ভারী বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেট অঞ্চলের লালাখালে ৭৮ মি.মি., শেওলায় ৪২ মি.মি. এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় প্রদেশের চেরাপুঞ্জিতে ২৮৮ মি.মি., শীলচরে ৫৭ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়েছে।
আজ শনিবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সাথে প্রবল বিজলী চমকানোসহ বৃষ্টি, বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আকাশ আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। রাজশাহী, পাবনা ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের উপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্র প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে।
এদিকে গাজীপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, অসময়ের পানিতে তলিয়ে গেছে গাজীপুর জেলার বিভিন্ন জায়গার ১২০ হেক্টর জমির কৃষকের ফসল। যে ধানে তাদের সারা বছরের ভাতের চিন্তা করতে হতো না সেই ধান অসময়ের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
গত দু’দিন ধরে টাঙ্গাইলের যমুনা নদী, গাজীপুরের তুরাগ এবং কালিয়াকৈর উপজেলার মকশ বিলসহ কয়েকটি বিলের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষকরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর মহানগরের ইসলামপুর, ইটাহাটা, কড্ডা, মজলিসপুর, লাটিভাঙ্গা, সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকার তুরাগ নদের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো, কালিয়াকৈর উপজেলার মকশ বিল এবং মৌচাক এলাকার ধানের আবাদি জমি পানিতে ডুবে গেছে।
গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকার কৃষক ইন্তাজ উদ্দিন জানান, তিনি এবার এক একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেন। ফসল ভালো হয়েছে। আর কয়েকটা দিন সময় পেলে ধানগুলো পুরোপুরি পেঁকে যেত। কিন্তু হঠাৎ করে তুরাগ নদে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জমির ধান তলিয়ে গেছে। তার মতো অনেক কৃষক এমন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকের মতো তিনিও আধাপাকা ধান কাটা শুরু করেছেন।
গাজীপুর মহানগরের মজলিসপুর এলাকার কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, তিনি এবার ৭০ শতক জমিতে স্থানীয় জাতের বোরো আবাদ করেন। ধানের শীষগুলো বেশ ঘন ছিল। এই ধান বর্তমানে কাঁচা এবং আধাপাকা অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে সব ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি নেমে গেলেও কাঙ্খিত ফসল এ মুহূর্তে ঘরে তোলা সম্ভব হবে না। জমিতে দুই থেকে তিন ফুট উচ্চতার পানি রয়েছে। এ মুহূর্তে ধানকাটা শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না।
কালিয়াকৈর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার প্রায় ১০ হাজার ১৭৫ হেক্টর জমিতে এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে। হঠাৎ নদী ও বিলের পানি বৃদ্ধির কারণে উপজেলার মকশ বিল, কালিয়াদহ বিল, রঘুনাথপুর, বোয়ালী বিল, চান পাত্রা, আলুয়া বিলসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৫০০ বিঘা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। কাটার উপযোগী না হলেও কাঁচা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।
গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানান, যেসব জমির ধান প্রায় পেঁকে গেছে সেসব জমির চাষিরা ধান কাটা শুরু করেছেন। কিছু ধান ওঠানো সম্ভব হবে। তবে বেশির ভাগ কৃষকই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। উপজেলা এবং উপ-সহ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

 

তারা তালিকা প্রস্তুত করছেন। একাধিক কৃষক জানান, যে ধানে তাদের সারা বছরের ভাত হতো এত কষ্ট ও ধার দেনা করে ফলালো তাদের সেই ধান অসময়ের পানি তলিয়ে যাওয়ায় তারা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
সুনামগঞ্জে বেড়েছে নদনদীর পানি : তাড়াহুড়ো করে হাওরের ধান কেটে ঘরে তুলছেন কৃষকেরা। সুনামগঞ্জে আবারও উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার সুরমা নদীর পানি বেড়েছে ৬২ সেন্টিমিটার। এ ছাড়া জেলার সীমান্তবর্তী যাদুকাটা নদী ও পাটলাই নদেও পানি বেড়েছে। তাই দ্বিতীয় দফা হাওরের ফসল ঝুঁকিতে পড়েছে।
তবে সুনামগঞ্জে গত দু’দিন ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকেরা কিছুটা স্বস্তিতে। এ অবস্থায় যেসব হাওরে ধান পেকেছে, সেখানে ধান কাটছেন তারা। একই সঙ্গে বৃষ্টি না হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ ফসল রক্ষা বাঁধগুলোর সংস্কারকাজ চলমান।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তথ্য মতে, ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে আবার ভারী বৃষ্টি হয়েছে। উজানে বৃষ্টি হওয়ার কারণে সুনামগঞ্জে নদ-নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে প্রথম আঘাত হানে জেলার তাহিরপুর উপজেলায়। মূলত এই উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি নামে প্রথম। টাঙ্গুয়া ও আশপাশের হাওরগুলোতে পানির চাপ রয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ কারণে সেখানে থাকা বাঁধগুলো রয়েছে ঝুঁকিতে। যদিও টাঙ্গুয়ার হাওরে বোরো ফসল হয় কম, এই হাওর উজানের ঢলের পানি ধরে রাখা ‘ট্যাংক’ হিসেবে পরিচিতি। এখানে পানি থাকলে অন্য হাওরে চাপ কমে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান করিব জানান, বাঁধে পানির চাপ বেড়েছে। সমস্যা হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের বাঁধগুলো নিয়ে। এখানে দিনরাত কাজ করতে হচ্ছে। দেখা গেছে, একদিকে কাজ করলে অন্যদিকে ফাটল দেখা দেয়। আবার ধসে যাচ্ছে। তখন সেখানেও কাজ করতে হয়। উপজেলার অন্য হাওরগুলোর বাঁধ ভালো আছে বলে জানান তিনি।
কৃষক আবদুল গণি আনসারী জানান, এলাকার রক্তি নদের পানি বাড়ছে। মানুষ আতঙ্ক নিয়েই ধান কাটছে। তিনি চার একর জমির মধ্যে দুই একর কেটেছেন। সবাই এখন ধান কাটার চেষ্টা করছেন। আবদুল গণি বলেন, এবার সুনামগঞ্জে কম বৃষ্টি হওয়াতেই ফসল এখন পর্যন্ত ঠিক আছে আছে। মানুষ বাঁধে যেমন কাজ করতে পারছে, তেমনি ধানও কাটতে সুবিধা হচ্ছে। না হলে উজান ও ভাটির বৃষ্টিতে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে হাওরের সব ধান তলিয়ে যেত। যেভাবে ২০১৭ সালে হয়েছিল।
জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ বলেন, ‘আমরা একদিকে কৃষকদের বলছি ধান কাটতে, অন্যদিকে হাওরের বাঁধ রক্ষায় কাজ করছি। সুনামগঞ্জে গতকাল দুপুরের রোদ দেখলে তো বোঝা যাবে না, হাওরে কী হচ্ছে। পানি কিন্তু বাড়ছে। দেখা যাবে ঝড়-বৃষ্টি নেই, কিন্তু ঢলে ফসলের সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’