হাওর বার্তা ডেস্কঃ সমাগত ২৬ মার্চ, আমার জন্মভূমির মহান স্বাধীনতা দিবস। ২০২১ সালের সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে ৫১তম স্বাধীনতা দিবস কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মনে এক ভিন্নমাত্রার আবেগ নিয়ে হাজির হবে। এ আবেগ গৌরবের, এ আবেগ ভালোবাসার, এ আবেগ প্রতিকূলতাকে জয় করে সৃষ্টিশীলতা আর এগিয়ে যাবার জয়োল্লাস।
এ দিন ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে, কানাডার বৃহত্তম শহর টরন্টোর পিয়ারসন্স ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বলাকা খচিত, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করবে। এ শুভক্ষণের পেছনে সাধারণের অজানা অনেক ইতিহাস যেমন আছে, নানা প্রতিকূলতা আর চ্যালেঞ্জের চড়াই-উতরাইও নিশ্চয়ই ছিল। সবকিছুকে অতিক্রম করেই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ দিক নির্দেশনায় আর বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের একঝাঁক দেশপ্রেমিক মানুষের নিরলস প্রচেষ্টায় কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
বিমান নিয়ে নানা গল্প চালু আছে, যুগ যুগান্তরের এই লোকসানি প্রতিষ্ঠান নিয়ে নানা শিহরণ জাগানিয়া কাহিনীও আছে। প্রতিষ্ঠানটিকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে বঙ্গবন্ধু কন্যার অনেক প্রচেষ্টাও লক্ষ্যনীয় ছিল। তাইতো সততা আর দক্ষতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অনেক ডাকসাইটে রাজনীতিককে মন্ত্রণালয়টির দায়িত্ব দিয়ে বারংবার কলংক থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছিল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, জাতীয় নেতা, তারকা খচিত ত্যাগী রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেননের মতো মানুষ প্রাণপণে চেষ্টা করেও বিমর্ষ চেহারায় বিমান থেকে বিদায় নিয়েছেন। এহেন পরিস্থিতিতে, নতুন সরকারের কেবিনেট ঘোষণার পর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বন্টনের আগে অপেক্ষাকৃত সফল ও সৎ মন্ত্রীরা নাকি বিমানের দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে শংকায় থাকতেন, ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে যদি রাজনৈতিক জীবনকে কলংকিত করতে হয়, সেই আশংকায় উদ্বিগ্ন হতেন!!
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারের কেবিনেটে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান অপেক্ষাকৃত তরুণ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী। দায়িত্ব প্রাপ্তির আগে প্রতিমন্ত্রীর পরিচিত, শুভাকাঙ্ক্ষীরা ভেবেছিলেন আইন অঙ্গনের অভিজ্ঞ মানুষ হিসেবে তিনি হয়তো সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতার কাছাকাছি কোন মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের দায়িত্ব পাবেন। প্রতিমন্ত্রী নিজেও এমনটিই প্রত্যাশা করেছিলেন। আর বিমান! সেটিতো ছিল কল্পনাতীত।
সবাইকে চমকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তুলে দেন মাহবুব আলীর হাতে। আরও বিস্ময়কর হলো, মন্ত্রীবিহীন দুটো মন্ত্রণালয় তাকে একা সামলাতে হবে। এহেন পরিস্থিতিতে সেদিন চিন্তার ভাঁজ পড়েছিলো প্রতিমন্ত্রীর কপালে, আর বিমান নিয়ে শংকা সেদিন উনাকে কতটা উদ্বিগ্ন করেছিল, সে সময়কার নানা আলাপচারিতার আমিও সাক্ষী। তবে প্রতিশ্রুতিশীল দৃঢ়তা ছিলো, সফলতার বাসনা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর আস্থা-বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষায় চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষাও তার ছিল।
প্রতিমন্ত্রীর সফলতা ব্যর্থতার গল্প বলা আজ আমার উদ্দেশ্য নয়, এর বিচার করবেন দেশের আপামর জনতা। তবুও বলতে চাই দায়িত্ব নেয়ার পর নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি দূর্নীতির সিন্ডিকেটে আতংক সৃষ্টি করতে পেরেছেন, বহুমুখী দায়-দেনার পরও প্রথম বারের মতো বিমানকে লাভের মুখ দেখিয়েছেন।
এ অর্জনই বা কম কিসে!! কক্সবাজার বিমানবন্দরকে নিয়ে এগিয়ে চলছে মহাপরিকল্পনা, ঢাকা, সিলেটে চলছে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন মহাযজ্ঞ, সৈয়দপুর, বরিশাল সহ আঞ্চলিক এয়ারপোর্টগুলোও উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বাইরে নেই। এরই মাঝে ২৬শে মার্চ ২০২২ চালু হচ্ছে ঢাকা-টরন্টো সরাসরি বিমান ফ্লাইট। এ নিয়ে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে আনন্দ উত্তেজনা যেমন আছে, কারও কারও মাঝে সফলতার ক্রেডিট নেওয়ার বাসনাও লক্ষ্যনীয়। তবে বিশ্বাস করি, হাতে গুণা কিছু মানুষ ছাড়া সবাই বিমানের সাফল্য চায়, যাত্রী চাহিদায় বিমান পছন্দের শীর্ষে থাকুক, সেটিই সবাই প্রত্যাশা করে।
ব্যর্থতা সফলতার পথ দেখায়। এক সময়ের ঢাকা-নিউইয়র্ক সরাসরি ফ্লাইট কেন বন্ধ হলো, এ নিয়ে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন, প্রাপ্ত তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। তবে সাধারণের পক্ষ থেকে বলতে পারি নিরাপত্তার পাশাপাশি যাত্রী সেবার মান, প্রতিযোগীতা মূলক টিকেটের দাম বাজার সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিরাই যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাহক হবেন, তাতে তো সন্দেহের অবকাশ নেই।
বত্রিশ থেকে চল্লিশ ঘন্টার দীর্ঘ যাত্রার অবর্ননীয় কষ্টকর ভ্রমণের পথ পরিহার করে বিমান-ই তাদের প্রাথমিক পছন্দ হবে তাতে বোধ করি কারো কোন দ্বি-মত নেই। তবুও শংকা আছে, বাজারের প্রতিযোগীতায় টিকতে হলে অযাচিত ব্যয় কমিয়ে চাহিদার সাথে সংগতি রেখে টিকেটের মূল্য সমন্বয় করতে হবে, যাত্রী সেবার মানে ছাড় দেয়ার ন্যুনতম সুযোগ যেমন নেই, গ্রাহক আকৃষ্ট করতে একটি আকর্ষণীয় ভাবমূর্তি তৈরিরও কোন বিকল্প নেই। আর এমনটি হলে, কিছুটা বাড়তি খরচ করেও তুলনামূলক স্বল্পতম সময়ে দেশে পৌঁছার বাসনা নিয়ে, বাংলাদেশিরা বিমানকেই বেছে নেবেন- এটিই তো প্রত্যাশিত।
নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর জীবন-জীবিকার মৌলিক অধিকার নিয়ে স্বস্তি থাকলেও অবারিত অর্থ বিত্তের দেশ কানাডা নয়। কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৃহত্তম অংশ কোন ভাবেই প্রতি বছর দেশে যাওয়ার চিন্তা করতে পারেন না। একবার দেশে যেতে প্রতি পরিবারের গড়পড়তা দশ হাজার ডলার খরচ হলেও, সেই পরিমাণ অর্থ সঞ্চয়ে হাজার হাজার পরিবারের কয়েক বছর লেগে যায়। এমন অনেক পরিবার কে জানি, যারা এক দশকেও দেশে যেতে পারেনি। অতি সাম্প্রতিক কালে নো-ভিসার নতুন নিয়মে সশরীরে হাইকমিশনে হাজির হয়ে পাসপোর্টের বাধ্যবাধকতায় তাদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছিল।
অনেক বড় দেশ কানাডা, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বা এমন দূরবর্তী যে কোন প্রদেশ থেকে অটোয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়ে চারজনের একটি পরিবারের পাসপোর্টের আবেদন করতে হলে বিমান ভাড়া, থাকা-খাওয়া মিলিয়ে দশ হাজার ডলারের প্রয়োজন। তাই একবার অটোয়া গিয়ে বাংলাদেশী পাসপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে কানাডিয়ান পাসপোর্টে নো-ভিসা নিয়ে দেশে যাওয়া অধিকাংশ বাংলাদেশির পক্ষেই সাধ্যেরও অতীত ছিল।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিকদের পাসপোর্টের বাধ্যবাধকতার জটিলতায় অনেকেই ইতোমধ্যে আগামী গরম কালের ছুটিতে দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। বিধাতা সহায়, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিনে নো-ভিসার জটিলতা অবসানে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের ঘোষণায় বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সাময়িক আনন্দ বন্যা হলেও এর পরিপূর্ণ সুফল পেতে বিমানকে আগামী বছরের স্কুল, কলেজের ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
“বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বাংলাদেশিদের বিমান”- এ ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সাফল্যের প্রতিযোগীতায় বিমান অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এর জন্য চাই, প্রবাসী কানাডীয়ান বাংলাদেশিদের সাথে বিমানের আত্মিক বন্ধন। ডিজিটালাইজেশনের যুগে এ বন্ধন সৃষ্টির কাজটি মোটেও কঠিন কিছু নয়। কানাডার প্রতিটি শহরেই বাংলাদেশিদের বিভিন্ন কমিউনিটি সংগঠন আছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশিদের বিভিন্ন প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন, বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন ও বাংলাদেশি গণমাধ্যম সমুহকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই আত্নিক বন্ধন সৃষ্টির কাজটি করা যায়। দশ মিনিট সময় ব্যয় করে, একশটি ইমেইল প্রেরণ করা যায়। আসছে ২৬ মার্চের শুভদিনে বাংলাদেশি গণমাধ্যমসহ এসব কমিউনিটি সংগঠনকে সংশ্লিষ্ট করে একটি আনুষ্ঠানিক দাওয়াত পত্রের মাধ্যমে এর শুভ সুচনা প্রত্যাশিত হলেও, এখনো এমন কোন বার্তা কারো নজরে এসেছে বলে জানা নেই।
সেবার পাশাপাশি বিমান একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। একজন গ্রোসারী শপের মালিকের যেমন ধর্ম, বর্ণ, ধনী, গরিব, রাজনৈতিক বিশ্বাস দেখে ব্যবসা করার সুযোগ নেই, তেমনি বিমানকেও তার সাফল্যের জন্য সর্বজনীন হওয়া চাই। ২৬ মার্চের ঐতিহাসিক উদ্বোধনী দিনকে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য সর্বজনীন করার কোন উদ্যোগ কেন এখনো কমিউনিটির নজরে আসেনি তা বোধগম্য নয়। বিমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয়কে দীর্ঘদিন যাবত যেভাবে জানি, তাতে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিভিন্ন বাংলাদেশি কমিউনিটি সংগঠনকে ভার্চুয়ালি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সঙ্গী করার একটি প্রস্তাবনা উত্থাপিত হলে নিঃসন্দেহে তিনি তা সানন্দে গ্রহণ করতেন। সেটি কেন হলো না, তা কোনোভাবেই আমার বোধগম্য নয়।
কানাডিয়ান বাংলাদেশিরা বিমানের সাফল্য চায়, বিমানকে গর্বের সঙ্গে লালন করতে চায় কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। কমিউনিটির সঙ্গে সরকারি প্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক সমন্বয় বিমানের ইমেজ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এটিকে এড়িয়ে যাওয়ার যে কোন প্রচেষ্টা আমাদের জাতীয় স্বার্থকেই বিঘ্নিত করবে, এমনকি বিমান নিয়ে সাধারণ মানুষের তুমুল আগ্রহ উদ্দীপনায় সেটি চ্যালেঞ্জ হয়েও উঠতে পারে। সরকার বা বাংলাদেশ বিমানের পক্ষে যে বা যারাই কানাডায় দায়িত্ব পালন করছেন, বাংলাদেশি কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাবনা কে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা জাতীয় দায়িত্বেরই অংশ হবে।
বিমান সফল হলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। শুধুমাত্র মন্ত্রী সচিবের সাফল্য নয়; বাংলাদেশের অর্জন কে আরও গৌরবান্বিত করতে বিমানের সাফল্যের কোনো বিকল্প নেই।