বাংলাদেশি অভিবাসীরা যেভাবে ইউক্রেনে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনে বিভিন্ন সময়ে পাড়ি জমিয়েছেন বাংলাদেশিরা৷ তাদের কেউ নিয়মিতভাবে এসেছেন, অনেকে এসেছেন অনিয়মিত উপায়ে৷ দেশটির জেলখানা বা বন্দিশিবিরেও আটকে ছিলেন ও আছেন কেউ কেউ৷ কিভাবে এই দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন বাংলাদেশিরা৷? তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

ইউক্রেনে ঠিক কতজন বাংলাদেশি বসবাস করেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ দেশটিতে বাংলাদেশের দূতাবাসও নেই৷ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বর্তমানে পোল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস নাগরিকদের উদ্ধারে সহায়তা করছে৷ রাশিয়ার হামলার পর থেকে সাতটি পথে ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডে ঢুকছেন অভিবাসী, শরণার্থীরা৷ গত কয়েকদিনে সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন অনেক বাংলাদেশিও৷ বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা অনির্বাণ নিয়োগী ডয়চে ভেলেকে জানান শুধু মেডিকা সীমান্ত দিয়েই ৩০০ থেকে ৫০০ বাংলাদেশি পোল্যান্ডে এসেছেন৷ ইউক্রেনে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশির ছিলেন বলে তাদের ধারণা৷

কী করতেন বাংলাদেশিরা

গত কয়েকদিনে ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডে আসা অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেছেন ডয়চে ভেলের সংবাদকর্মী আরাফাতুল ইসলাম৷ তাদের বেশিরভাগই জানিয়েছেন তারা ইউক্রেনে পড়াশোনার করতেন৷ এর মধ্যে দেশটির মেডিক্যালসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীও রয়েছেন৷ আবার অনেকে দেশটিতে কাজের ভিসা নিয়ে নিয়মিত উপায়ে এসেছেন৷ কেউ কেউ এসেছেন অনিয়মিত উপায়ে৷ যাদের অনেকে দেশটির জেলখানা বা বন্দি শিবিরেও আটক ছিলেন৷ এখনও কয়েকজন আটক রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে৷

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মেডিকা সীমান্ত দিয়ে পোল্যান্ডে ঢুকেন বাংলাদেশের মোহাম্মদ রায়হান৷ গত পাঁচ বছর ধরে তিনি ইউক্রেনে ছিলেন৷ বাংলাদেশ থেকে প্রথমে তিনি শিক্ষা ভিসায় আজারবাইজান আসেন৷ সেখান থেকে ইউক্রেনে৷ তিনি বলেন, ‘‘পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম৷ এরপরতো যুদ্ধ শুরু হলো এখন নিজের জীবন নিয়েই টানাটানি৷’’

মেডিকা সীমান্তে তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের আবুল হাসান লিমন৷ ২০১৯ সালে তিনি কাজের ভিসা নিয়ে সরাসরি বাংলাদেশ থেকে ইউক্রেনে আসেন বলে জানান ডয়চে ভেলেকে৷ সেখানে চাকুরির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘‘আমি একটি বাজারে কাজ করতাম৷ সেখানে কাজ আছে কিন্তু বেতন খুবই কম৷ সেকারণে ঠিকমতো বাংলাদেশ টাকা পাঠানো যেত না৷ অনেক সমস্যা৷ তারপরেও ইউক্রেনে থাকার কারণ ছিল ওখান থেকে বের হওয়া যাচ্ছিল না৷ অন্য কোনো দেশের ভিসাও পাওয়া যাচ্ছিল না৷’’

দেশে ফিরতে চান না

আরিফ হোসেন ইউক্রেনে আসেন তারও আগে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘২০১৬ সালে রাশিয়া হয়ে এসেছি৷ ইউরোপে (ইইউ) যাওয়ার লক্ষ্যে এসেছিলাম৷ তারপর আটকা পড়ে যাই৷ এরমধ্যে দালালের মাধ্যমে যাওয়ার চেষ্টা করেছি অনেকেবার৷ আমাদের কাছ থেকে অনেক টাকা নিলেও যেতে পারিনি৷ এই অবস্থায় দেশে ফিরে কিভাবে মুখ দেখাব তাই আর দেশে যাইনি৷’’

ইউক্রেনে হামলার প্রেক্ষিতে পোল্যান্ড অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশিদেরও ১৫ দিনের ট্রাভেল ভিসায় দেশটিতে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে৷ সেটি কাজে লাগিয়ে দালাল বা পাচারকারীদের টাকা দেয়া ছাড়াই এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশ করতে পেরেছেন বলে জানান আরিফ৷ তিনি বলেন, ‘‘ইউক্রেন যদি কোন ডকুমেন্ট দিত তাহলে অবশ্যই ইউক্রেনে থাকতাম৷ ইউরোপে আসতে চাওয়ার একটাই কারণ কাগজটা দ্রুত হয়ে যায়৷ এখন কোথায় যাব ঠিক করিনি৷’’

শুধু আরিফ নন, গত কয়েকদিনে পোল্যান্ডে প্রবেশ করা বাংলাদেশিদের অনেকেই বলেছেন তারা ইউক্রেনে এসেছিলেন মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দেশে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে৷ মোহাম্মদ রায়হান বলেন, ‘‘অনেকেই হয়ত জানে না যে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ না, এটা সেঙ্গেনভুক্ত দেশও না৷ দ্বিতীয়ত, অনেকে যারা ইউরোপে যায় তারা ইউক্রেন সীমান্ত অতিক্রম করে৷’’

এই অভিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ইউক্রেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের একটি অংশ ২০১৮ সালে রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপের পরে এসেছেন৷ এই আয়োজনের সময় তারা বাংলাদেশ থেকে রাশিয়া আসেন৷ পরে ইউক্রেন সীমান্ত অতিক্রম করেন৷ রায়হান বলেন, ‘‘আসার পর অনেকে আটকা পড়ে গেছেন সেখানে (ইউক্রেনে)৷ কিছু কিছু লোক এজেন্টের মাধ্যমে ব্রোকারের মাধ্যমে চলে গেছেন (ইইউ দেশে)৷ …ইউক্রেনে অনেকেই ব্যবসা বা পড়াশোনায় আছে৷ কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীই সাত আট লাখ টাকা দিয়ে ঢুকে৷ ওদেরকে বলা হয় যে ৫০ হাজার টাকার উপরে বেতন পাওয়া যাবে এখানে কাজ করে৷ এখান থেকে যেকোনসময় ইউরোপেও ঢুকতে পারবেন তারা৷ এইজন্য সবাই ঢুকে৷ …কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছে তারা এই কাজগুলো করে৷’’

বর্তমানে এই বাংলাদেশিদের বেশিরভাগই হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডসহ প্রতিবেশি ইইউ দেশগুলোতে চলে এসেছেন বলে জানান অভিবাসীরা৷ পোল্যান্ডে তাদের সাময়িক থাকা এবং দেশে যেতে চাইলে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে দূতাবাসের পক্ষ থেকে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে দেশে ফিরে যেতে রাজি নন বেশিরভাগই৷ সোমবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, ‘‘ ইউক্রেনে থেকে ৪৭০ জন বাংলাদেশি পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও মলদোভায় আশ্রয় নিয়েছে৷ এটা পাঁচশো হতে পারে আজ দিন শেষে৷’’ বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তাকে উদ্ধৃত করে আরো লিখেছে, ‘‘খুব বেশি সংখ্যক মানুষ কিন্তু আসার আগ্রহ প্রকাশ করেননি৷ খুব বেশি হলে ৫০-৬০ জনকে পেয়েছি৷’’

 

শতাধিক বন্দি 

অনিয়মিত উপায়ে ইউক্রেনে প্রবেশ বা ইইউ সীমান্ত পার হতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন সময় দেশটিতে বন্দি হয়েছেন৷ পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন গত রোববার ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘আমরা শুনেছি, প্রায় দেড়শোর মতো বাংলাদেশি ইউক্রেনের জেলে আটকে আছেন৷’’

বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রায়হান বলেন, অনিয়মিতভাবে আসা অভিবাসীদের কেউ ছয়-সাত মাস কেউ একবছর বা তারও বেশি জেল খাটার উদাহরণ আছে৷ ‘‘হাজত থেকে মুক্ত হওয়ার পর হয়ত আবার সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে এবং আবার হাজতে আছে৷ যুদ্ধ চলকালীন তাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে,’’ বলেন তিনি৷

তবে মঙ্গলবার ইউক্রেনের মিকোলাইভ শহরে একটি বন্দি শিবির থেকে উদ্ধারের আকুতি জানিয়েছেন দুইজন বাংলাদেশি৷ ডয়চে ভেলেকে পাঠানো ভিডিওতে তাদের একজন বলেন, ‘‘গত বৃহস্পতিবার সকালে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে বোমের শব্দে৷ পাশেই একটি মিলিটারি এয়ারপোর্ট আছে সেখানে বোমা ফেলা হয়৷ এজন্য আমরা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যাতে আমাদের মুক্ত করে দেয়া হয় এবং যাতে আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে ইউক্রেনে পশ্চিমাঞ্চলে যেতে পারি৷’’

তিনি জানান, বন্দি শিবিরটিতে বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের সঙ্গে তিনিসহ বাংলাদেশের দুইজন রয়েছেন৷ এই অবস্থায় তারা কর্তৃপক্ষের কাছে মুক্তির আবেদন জানালেও এ বিষয়ে সাড়া দেয়া হচ্ছে না৷ তিনি বলেন, ‘‘ গত শুক্রবার এ নিয়ে আরো চাপ দেয়ার পর তারা বন্দিদের একটি আবেদন পত্র দিতে বলেন৷ এক ঘণ্টা পর সেখানে পুলিশ আসে৷ সবাইকে লাঠিসোটা দিয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেয় এবং একেক জনকে আলাদা কক্ষে বন্দি করে আমাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনও নিয়ে নেয়৷ এমন অবস্থায় সারাদিন রুমে বন্দি৷ আমরা চারদিন রুমে বন্দি ছিলাম৷ আমাদের যথেষ্ট খাবার দাবার, পানি দেয়া হয়নি৷ কোন লাইট জ্বালানো হয়নি৷ একেবারে অন্ধকারে৷’’

তিনি বলেন, বন্দিশিবির পরিচালনাকারীরা জানিয়েছেন দেশটির অভিবাসন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ছাড়া তাদের ছাড়া হবে না৷ এই বিষয়ে কোথাও যোগাযোগ করে তারা কোনো সমাধান পাচ্ছেন না৷ এই বাংলাদেশি বলেন, ‘‘আমরা এখানে বন্দি, এখান থেকে বের হতে পারছি না, আশে পাশে অনবরত বিস্ফোরণ হচ্ছে৷ আমাদের জীবন এখন সংকটাপন্ন আমরা সবার সাহায্য চাই৷

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর