হাওর বার্তা ডেস্কঃ তামান্না আক্তার নুরা। হাত-পা না থাকলে কিছুই করার নেই-চিরাচরিত এমন ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছেন তিনি। দেখিয়েছেন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয়। লড়াই করে যেতে হয় শেষ না দেখা পর্যন্ত। জন্মগতভাবেই দুই হাত এক পা নেই যশোরের ঝিকরগাছার অদম্য এই মেধাবীর। অথচ সব পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। দেশবাসী অভিভূত হয়েছেন তার এমন বিস্ময়কর সাফল্যে। বিষয়টি চোখ এড়ায়নি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও। বঙ্গবন্ধুকন্যা তাকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তামান্নার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সম্ভাব্য সবকিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’কে। দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে থাকা তামান্না এখন স্বপ্ন বুনছেন অণুজীববিজ্ঞান (মাইক্রোবায়োলজি) গবেষক হওয়ার।
বুধবার বিকালে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ১৪ তলার কেবিনে তামান্না ও তার পরিবারের সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। সাবলীলভাবে সংগ্রামী জীবনের নানা গল্প ও চিকিৎসার বর্তমান অবস্থার কথা বলেন তিনি। জানান পরিবার ও নিজেকে নিয়ে স্বপ্নের কথা। এ সময় তার মুখে লেগে ছিল তৃপ্তির হাসি। তামান্না যখন কথা বলছিলেন তখন তার গর্বিত বাবা ও মায়ের চোখ ছলছল করছিল আনন্দ অশ্রুতে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বারবার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন তারা। এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দুবার তামান্না ও তার বাবার কাছে চিকিৎসার বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে কল আসে। এ সময় ডাক্তারদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সন্তুষ্টির কথা জানান তারা।
তামান্না আক্তার নুরা বলেন, যদি আমার পা এবং হাত প্রতিস্থাপন করা যায়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হবেন। তিনি প্রতিনিয়ত আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন। এখানে ভর্তি হওয়ার আগে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। এর মধ্যেও খুদেবার্তায় কথা হয়েছে তার সঙ্গে। এখন তিনি দুবাই আছেন এবং সেখান থেকেই সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছেন। বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেনের কাছ থেকে চিকিৎসার সর্বশেষ অবস্থা জানছেন।
আগামীতে নিজের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তামান্না বলেন, মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়তে চাই। এই সাবজেক্টটা পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। এ বিষয়ে গবেষক হওয়ার ইচ্ছা আছে। সেজন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণে দেশের বাইরে যেতে চাই। যেহেতু শারীরিক কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, সেক্ষেত্রে বাইরে পড়তে গেলেও সহযোগিতার জন্য পরিবারকে নিয়ে যেতে হবে। এটা হয়তো একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেহেতু আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন এখন আমি সাহস হারাচ্ছি না। তিনি যেভাবে আন্তরিকতা দিয়ে আমার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন, সেটা অব্যাহত থাকলে কোনো প্রতিবন্ধকতাই আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।
তামান্না বলেন, আমার এই যাত্রা সহজ ছিল না। অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আজ এখানে এসেছি। ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য সেটা সম্ভব নয়। জানি, সামনের পথটাও হয়তো সহজ হবে না। তবে আমি চেষ্টা করে যাব। আমি স্টিফেন হকিংকে দেখে খুবই আশাবাদী হই। তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তিনি একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েছেন। আমার চেষ্টাও আশা করি বৃথা যাবে না। আমি শুধু এগিয়ে যেতে চাই।
তামান্নার বাবা রওশন আলী বলেন, শুরুতে কোনো স্কুল তামান্নাকে ভর্তি করতে চায়নি। পরে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করি। তামান্না টেবিল-চেয়ারে বসতে পারত না। তখন জায়নামাজে বসে ক্লাস করেছে। আমি কোলে করে তিন কিলোমিটার দূরে নিয়ে গেছি। ক্লাস শেষে নিয়ে এসেছি। সায়েন্স (বিজ্ঞান) নিয়ে পড়তে চেয়েছে। শুরুতে না করলেও ওর প্রবল আগ্রহের কারণে বিজ্ঞানেই ভর্তি করেছি। অনেকের অনেক কথা শুনেছি। আমরা থামিনি। সে কারণে আজ সবার ভালোবাসা পাচ্ছি। দেশবাসী ও বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। তামান্নার হাত-পা লাগাতে চিকিৎসকেরা সব ধরনের চেষ্টা করছেন। তাদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ।
তামান্নার মা খাদিজা বেগম বলেন, ‘তামান্নার জন্মের (২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর) পর কষ্ট পেয়েছিলাম। ৬ বছর বয়সে ওর পায়ে কাঠি দিয়ে লেখানোর চেষ্টা করলাম। এতে আঙুলে ব্যথা লাগত তাই পেন্সিল দিলাম। কাজ হলো না। এরপর মুখে পেন্সিল দিলাম, তাতেও কাজ হলো না। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওকে পা দিয়েই লেখাতে হবে। এরপর বাঁকড়া আজমাইন এডাস স্কুলে ভর্তি করালাম। মাত্র দুই মাসের মাথায় ও পা দিয়ে লিখতে শুরু করল। এরপর ছবি আঁকা শুরু করল। ওর রেজাল্টে সবাই অবাক হয়ে গেছে। যারা স্কুলে ভর্তি করতে চায়নি এখন তারাও গর্ব করছে ওকে নিয়ে।’
মঙ্গলবার বেলা ৩টার দিকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে তামান্নার ভর্তির বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানান চিকিৎসকেরা। এরপর তার চিকিৎসার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন যুগান্তরকে বলেন, ‘তার চিকিৎসায় সম্ভাব্য সব উপায় বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এগুলো শেষ হলে আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব যে কী করা যায়।’ চিকিৎসায় তার হাঁটাচলার ক্ষেত্রে কোনো আশা আছে কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সে হাঁটছিল না। ফলে নতুন করে পা লাগলে সেটা কতটুকু এডজাস্ট করতে পারবে সেগুলোও দেখার বিষয় আছে। দেশের স্বনামধন্য সিনিয়র চিকিৎসকদের ১০ সদস্যের হাই পাওয়ার মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। জার্মানিসহ অন্য একটি দেশের দুজন চিকিৎসকও যুক্ত হয়েছেন তার চিকিৎসা প্রক্রিয়ায়। আমাদের সব ধরনের প্রচেষ্টা থাকবে। তবে কতটুকু আমরা সফল হতে পারব এখনই তা বলা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে তামান্নার পড়াশোনার ইচ্ছা পূরণে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের কথা জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য এবং অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, তামান্না আক্তারের মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়ার ইচ্ছাকে আমরা স্বাগত জানাই। এমন অদম্য মেধাবীদের এ সেক্টরে অত্যন্ত প্রয়োজন। মেধাবীরা পড়াশোনার জন্য এ বিষয়টি বেছে নিলে আমাদেরও ভালো লাগে। এখান থেকে জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক শাখায় কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এই সেক্টরের গবেষকদের দেশ ও দেশের বাইরে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। গবেষকদের জন্য এ সাবজেক্ট অনেক বড় একটি প্ল্যাটফরম। মাইক্রোবায়োলজিস্ট হিসাবে তাকে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
তামান্না যশোরের ঝিকরগাছার উপজেলার বাঁকড়া আলীপুর গ্রামের সন্তান। বাঁকড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া জনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষাতেও জিপিএ-৫ পান। বাবা রওশন আলী ঝিকরগাছা উপজেলার ছোট পৌদাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার (নন-এমপিও) শিক্ষক। মা খাদিজা পারভীন গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তামান্না সবার বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রশ্মি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। ভাই মুহিবুল্লা তাজ প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে।