ফজরের নামাজ পড়ে হালকা কিছু খাবার খেয়ে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন তিনি। এক হাতে বৃদ্ধ বয়সে চলার বাহক লাঠি, অন্য হাতে একটি গামলা। এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রামের রাস্তার দু’পাশে দৃষ্টি রেখে হাঁটতে থাকেন। বুনোশাক দেখলেই বসে পড়েন। শাক কুড়িয়ে গামলা ভর্তি করে তবে তাঁর বাড়ি ফেরা!
ফিরতি পথে আসার সময় কলাগাছের দিকে দৃষ্টি রেখে পথ চলেন। যদি বাগানের মালিকের সম্মতি পান তো কলাগাছের মোচাও কেটে নিয়ে আসেন। সারা দিন গ্রামে-গ্রামে বুনোশাক তুলে বাড়ী আসেন। রাতে তাঁর স্ত্রী ভাল করে বেছে আটি বেঁধে গুছিয়ে রাখেন। পরের দিন সকালে মৎস্য-বন্দর আলীপুর বাজারে তা বিক্রি। বিক্রি করে যে টাকা আসে তা দিয়েই সংসারের প্রয়োজন মেটানো।
যার কথা বর্ণনা করা হয়— তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ কাদের ঘরামী। জানালেন তাঁর বয়স ১০৫ বছর। কাদের ঘরামীর বর্তমান নিবাস কুয়াকাটার তুলাতলী গ্রামে।
কারো বাড়ীর পুকুর পাড়ে, বাড়ীর আঙ্গিনায়, বেড়ার মধ্যে, বিলের খালে, খোলা ভিটায় তিনি শাক তোলেন। অবশ্য কোনো কোনো বাড়ীতে বা কারো কারো জমিতে শাক তুলতে নিষেধও আছে। মাঝে-মধ্যে কেউ কেউ আগ-পিছ না ভেবে অসৌজন্যমূলক ব্যবহারও করে বসে। তারপরেও তাঁকে শাক তুলতে হচ্ছে। তা না হলে যে, সংসার চলে না। তা ছাড়া চলতে-ফিরতে কষ্ট হলেও তিনি কাজ করেই জীবন নির্বাহ করতে চান— মানুষের কাছে চাইতে তিনি পছন্দ করেন না।
১৪ বছর যাবৎ বুনোশাক কুড়িয়ে সংসার চলছে কাদের ঘরামীর। যখন যে শাকের মৌসুম থাকে তখন সে শাক তুলে বিক্রি করেন। এ সব শাকের মধ্যে কলমী শাক, হেলেঞ্চা শাক, গোল হেলেঞ্চা শাক, আগ্রা শাক, কচু শাক, গ্রিমা শাক, কচুর লতী, থানকুণী পাতা, কলার মোচা ইত্যাদিই প্রধান। যা বিক্রি করে সংসার চলছে তাঁর।
কিন্তু দিন দিন বনাঞ্চল কমে যাচ্ছে, ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুর ডোবা নালা, দিন দিন বাড়ছে বসতি, উজার হচ্ছে বনাঞ্চল। এখন আর আগের মতো বুনোশাক পাওয়া যায় না। তারপরেও যে জমিতে যতটুকু শাক পাওয়া যায় তার অনেকটিই ছাগল, ভেড়া, গরু মহিষে খেয়ে ফেলে। তবুও এ পেশাতেই তাঁর থাকতে হচ্ছে আমৃত্যু। এ পেশা ছাড়া টিকে থাকার উপায়-ও বা কি? ১০৫ বছরের বৃদ্ধ কাদের ঘরামী অন্য কী কাজ-ই করবেন বা করতে পারবেন?
অবশ্য বর্তমানে শাক কুড়িয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে কাদের ঘরামী হারবার পাত্র নন— ফলে অবসর পেলেই তিনি বাড়ীতে বসে জাল বুনেন। স্ত্রী রহিমা বেগম কেওয়াপাতার ওগলা বুনেন। এ ছাড়া কাদের ঘরামী মাসে চার শ’ টাকা বয়স্ক ভাতা পান। কারো কাছে হাত না পাতলেও— কেউ যদি স্বেচ্ছায় মায়া করে দু’-এক শ’ টাকা দেন তো তিনি না করেন না। এভাবেই চলছে তাঁর সংসার জীবনের সংগ্রাম।
কাদের ঘরামীর চার মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ে সালেহা, আলেয়া, শারমীন, মাজেদার বিয়ে দিয়েছেন বেশ আগেই। অবশ্য ৭ বছর হল বৃদ্ধ বাবার ঘাড়ে চেপে বসেছেন তাঁর মেজো কন্যা আলেয়া বেগম। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় আলেয়া বেগমকে ফেলে নিরুদ্দেশ্যে চলে গেছে তাঁর স্বামী। আর কাদের ঘরামীর একমাত্র পুত্র শাহ আলম বিয়ে করে লক্ষ্মীপাড়া গ্রামে শ্বশুর বাড়ীতে থাকেন। অপরের মোটরসাইকেল ভাড়ায় চালিয়ে চলে শাহ আলমের সংসার। নিজের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিধায় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খোঁজ খবর রাখতে পারেন না বলে জানা গেছে।
বয়সের ভারে ক্লান্ত কাদের ঘরামীর জানান, তাঁর আদিবাস ছিল পটুয়াখালীর সদরের আউয়ালীপুরে। ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে তুলাতলী গ্রামে আসেন। তাঁর বাবা নূর মোহাম্মাদ ঘরামী তিন কুড়া জমি কবলা করেন। ওই জমিটুকু চাষাবাদ করতেন আর ভিটাতে আট সদস্যের পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতেন। ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকারী জলোচ্ছ্বাসে তাঁর বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে হারান কাদের ঘরামী। ওই জলোচ্ছ্বাসে নূর মোহাম্মাদ ঘরামীর পরিবারে তিনি একাই বেঁচে যান।
পরিবারের ৭ জনকে হারিয়ে পরবর্তীকালে পূর্বের ভিটায় কোনো মতে ছাপরা দিয়ে থাকতেন। কিন্তু বন্যায় তাঁর বাবার কেনা জমির দলিল হারান, জমিও বেদখলে চলে যায়। কেননা দলিল পত্র না থাকার অজুহাতে বিভিন্ন সময় নামে মাত্র টাকা দিয়ে দলিল করে নেয় একটি প্রভাবশালী মহল।
একপর্যায় তিনি হারান বসত বাড়ীর জমিও। প্রভাবশালী মহলের দাবী কাদের ঘরামী তাঁর বসত ভিটার জমিও বিক্রি করেছেন। কিন্তু কাদের ঘরামী জানান, আর্থিক সমস্যা দেখা দিলে কিছু টাকা-পয়সা ওরা দিয়েছে। কিন্তু সেই কয়টা টাকার কারণে তাঁর বসত ভিটা যাবে বুঝলে টাকা ধার করতেন না।
জীবনের পড়ন্তবেলার বসত বাড়ী হারিয়ে দিশেহারা হয়েছিলেন তিনি। কোথায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন! মৃত্যুর পরে কোথায় হবে তাঁর দাফন? বৃদ্ধ স্ত্রী রহিমা বেগম কোথায় থাকবেন? এমন নানা চিন্তায় অস্থির বৃ্দ্ধ কাদের ঘরামী পাশে এসে দাঁড়ান গ্রামের জুলহাস হোসেন জালাল খান। তিনি দৌড়ঝাঁপ করে ষোল হাজার টাকার বিনিময়ে বছর তিনেক আগে ১ একর জমির বন্দোবস্ত এনে দেন। যেখানেই কাদের ঘরামী বর্তমানে বসবাস করছেন। অবশ্য সেখানে ৭০ শতাংশ জমি তাঁর দখলে থাকলেও, তা নিয়ে মামলা চলছে।
প্রতিবেশী প্রভাবশালী শামসুল হক চেয়ারম্যানের পুত্র জালাল উদ্দিন মামলাটি করেছে। জালাল উদ্দিন কলাপাড়া উপজেলার যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা। তাই এখানেই কাদের ঘরামীর ভয় হয়। স্থানীয় কয়েকজন বৃদ্ধ জানিয়েছে, জালাল উদ্দিন নাকি ওই জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন দাবী করে মামলা করেছেন। তাদের প্রশ্ন ৫০০ একর জমির মালিকরা কীভাবে সরকারি জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন? এদিকে মামলার নিষ্পত্তি কবে হবে? রায় কি তাঁর পক্ষে আসবে নাকি প্রভাবশালীদের পক্ষে যাবে? —এ নিয়ে ঘরামীর চিন্তার শেষ নেই। আর বাকী ৩০ শতাংশ জমি কাগজে থাকলেও সরেজমিনে এখনো বুঝে পাননি তিনি। মারা যাওয়ার আগে বুঝে পাবেন কিনা সন্দেহ তাঁর।
তবুও জীবনসংগ্রামে পিছ-পা হতে চান না কাদের ঘরামী। কাজ করেই জীবন অতিবাহিত করতে চান তিনি। তবে তাঁর মাথাগুঁজার ঠাঁই টুকু যেন হাত-ছাড়া না হয়— সে চিন্তা তাঁর থাকেই…।