ঢাকা ১১:২০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শেখ হাসিনার কণ্ঠে নির্মোহ সত্যের উচ্চারণ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:৪৮:২৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০১৬
  • ২৯৬ বার

পীর হাবিবুর রহমান:

রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলা বর্ষবরণের যে ঐতিহ্যের ধারা ছড়িয়ে পড়ছে দিনে দিনে তা গোটা বাংলাদেশে মানুষের প্রাণের উৎসবে পরিণত। বাঙালি জাতির আবেগ মতিত এই সাংস্কৃতিক উচ্ছ্বাসের বিপরীতে কোন অপশক্তি দাঁড়াতে পারেনি। একটি দেশ ও জাতি যেখানেই থাকুক চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গেই নয়, দেশজুড়ে মেলা, বাংলা খাবারের বাহারি আয়োজন, উৎসবের বর্ণীল ফ্যাশন সাজসজ্জা মিলে প্রাণে প্রাণে একাকার হয়ে যায়। দল মত নির্বিশেষে বাঙালি জাতি প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে উৎসবের মোহনায় প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর জাতির আত্মপরিচয় তুলে ধরার দিন পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ এবারও তাপদাহের মধ্যে আনন্দের বন্যায় ভাসিয়েছে। উৎসব পার্বণ কর্পোরেট সংস্কৃতির বাণিজ্যের আগ্রাসনে পতিত হলেও বাঙালির শাশ্বত বর্ষবরণের চেতনা বিচ্যুত হয়নি। এটি মানুষের আবেগ, প্রেম, চেতনা ও হৃদয় নিঃসৃত বিষয়। সেখান থেকে কেউ সরেনি।

নববর্ষের পরদিন শুক্রবার লৌহজঙের পদ্মার ওপারে বিচারপতি সামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী মানিকের বাড়িতে দাওয়াতে গিয়েছিলাম। বাইরের তাপদাহ সইতে পারি না। মানিক ভাইয়ের আন্তরিকতা উপেক্ষা করতেও পারিনি। দ্বিধা দ্বন্দ্বের পর অবশেষে রাকসুর সাবেক পত্রিকা সম্পাদক বন্ধুবর এবিএম জাকিরুল হক টিটনকে নিয়ে রওনা হই লৌহজঙের দিকে। ১৯৯৪ সালে একবার সরেজমিন নদী ভাঙনের রিপোর্ট করতে লৌহজং গিয়েছিলাম। চোখের সামনে দেখেছিলাম রাক্ষুসী পদ্মার ভাঙনে বাজারটি তলিয়ে যেতে। চোখের সামনে নিলাম হয়ে যাওয়া হাসপাতালটি ভেঙে নেওয়া হলো। পদ্মার দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষের উদাস চোখে দেখেছিলাম সর্বনাশের হাহাকার। প্রকৃতির খেয়ালি বৈরী আচরণে পদ্মার ভাঙনে কতো মানুষ হারিয়েছে বাপ-দাদার ভিটে। সেই পদ্মায় এখনও কোথাও ভাঙন, কোথাওবা ধু ধু মরুভূমি। বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাপ-দাদার ভিটে হারালেও নাড়ীর টানে পদ্মার ওপারে চরের মধ্যে একখানি ডুপ্লেক্স বাংলো বাড়ি বানিয়েছেন। চারদিকে কাশবন, বোঝা যায় বর্ষায় বাড়িটি কতো রোমান্টিকতা জাগিয়ে তোলে। ঢাকা থেকে অনেক মেহমান গিয়েছিলেন। ডাল-ভাতের আয়োজন ছিল উপাদেয়। সেই সঙ্গে ছিল গ্রামীণ পরিবেশে দিলখোলা আড্ডা। কুষ্টিয়ার লালনের আশ্রম থেকে আসা বাউলের গান আর হু হু বাতাস, মানুষের আন্তরিকতা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় ও একাত্ম করে তুলেছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্য সেগুফতা ইয়াসমিন এমিলি এই তাপদাহের মধ্যেও সবার মেহমানদারি করেছেন। ব্যাপক জনসংযোগ করছেন। একালে যখন হঠাত মেকআপ মারা মন্ত্রী নেতা এমপির আবির্ভাব ঘটে সেখানে এমিলির মতো তৃণমূল থেকে উঠে আসা গণমুখী চরিত্রের রাজনৈতিক কর্মীকে দেখলে শ্রদ্ধাই আসেনা সাদা-কালো যুগের রাজনীতিটাও মনে করিয়ে দেয়। পদ্মার ঢেউয়ে নৌকায় দুলতে দুলতে ভ্রমণ শেষে গাড়িতে উঠে মুঠোফোনে অনলাইন খবরে চোখ রাখি।

নববর্ষের দিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় কালে যে বক্তৃতা করেছেন তা পড়ে মুগ্ধ হই। যেন মানুষের হৃদয়ের কথা বলছেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও বিশ্বাস তার কণ্ঠে নির্মোহ সত্য হিসেবে উচ্চারিত হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে যে কথাগুলো বলতে চেয়েও বলতে পারিনি সেটিই যেন তিনি উচ্চারণ করেছেন। নববর্ষের আগের রাতে একাত্তর টিভির একাত্তর জার্নালে অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের বক্তব্যের প্রসঙ্গ এসেছিল। পহেলা বৈশাখ বিকেল ৫টার পর রমনাসহ উন্মুক্ত স্থানে বর্ষবরণের সকল অনুষ্ঠান আয়োজনে পুলিশ যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সুলতানা কামাল তার জন্য সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। সরকারই নয় খোদ প্রধানমন্ত্রী, প্রভাবশালী মন্ত্রী এমনকি শাসক দল আওয়ামী লীগের সমালোচনায় কখনো ভুল করিনি। কিন্তু সুলতানা কামালের বক্তব্যের সঙ্গে সেদিন একমত হতে পারিনি। তিনি বলেছেন, ‘সরকার মুক্তবুদ্ধির মানুষদের কোণঠাসা করে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। সরকার নিজেদের পিঠ বাঁচাতে ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চাচ্ছে না, তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাচ্ছে না। পক্ষান্তরে যারা মুক্তবুদ্ধির মানুষ তাদের উপরে নানা ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই শক্তিগুলোকে অনেক বেশী প্রশ্রয় দিচ্ছে, শক্তিশালী করে তুলছে। মানুষের অধিকার খর্ব করে, মানুষের বাইরে আসার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে, মানুষের উৎসবের আনন্দকে মলিন করে কীভাবে তারা দাবি করে গণতন্ত্রের সরকার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার।’

বিএনপির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। সেদিন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চেয়েছিলেন। তা করতে না পারার অপারগতা এবং যেসব ঘটনাবলীর সঙ্গে তারা একমত নন, একের পর এক সেসব ঘটনা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে চারজন উপদেষ্টার একজন হয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। সেদিন মরহুম মাহবুবে আলম পদত্যাগ না করলেও লেফট্যানেন্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী, ড. আকবর আলী খান, সি এম শফি সামি ও তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। সেদিন সুলতানা কামালের সামনে এটিই ছিল বাস্তবতা। সেটিই ছিল তাদের সামনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র পথ। এবারের নববর্ষে সরকার ৫টার পর উন্মুক্ত স্থানে উৎসব-অনুষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বাস্তব সত্যকেই গ্রহণ করেছে। মানুষের জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের হয়ে মানুষের জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষায় সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তা কারো কারো মনে বেদনা জাগালেও বাস্তবসম্মত। উৎসবের আনন্দ খানিকটা মলিন হলে কিংবা ছন্দপতন ঘটলে ক্ষতি নেই। মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু নিজেদের সীমাবদ্ধতা, বাস্তবতার নিরিখে নিরাপত্তার জন্য উৎসব সময়ের সীমারেখা টেনে রমনার বটমূলের মতো বোমা হামলা বা টিএসসির মতো নারীর সম্ভ্রম লুটের নির্লজ্জ নির্মম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে না দেওয়াই উত্তম। সুলতানা কামাল যেখানে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে না পারার বেদনা নিয়ে পদত্যাগ করে চারজন উপদেষ্টার সঙ্গে অভিনন্দিত হয়েছিলেন সেখানে বিকেল ৫টার পর উন্মুক্ত স্থানে উৎসবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সিদ্ধান্তকে যখন মধ্যযুগীয় চিন্তার প্রতিফলন বলেন তখন তার বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য মনে হয়না। মনে হয় তিনি অঘটন চেয়েছিলেন! কন্ঠে তার হঠকারী অতিবিপ্লবীর সুর পাওয়া যায়। মধ্যযুগের চিন্তায় বাঙালি জাতি অতীতেও ছিলনা বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও নেই। তাই একটি উদার সাংস্কৃতিক গণজাগরণের কারণে তিনি যেমন সনাতন হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ পুত্রকে বিয়ে করে সুখের জীবন কাটাচ্ছেন তেমনি প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েরা ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে যে কারো সঙ্গে হৃদয়ে হৃদয়ে মেলে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মুক্ত জীবন কাটাচ্ছেন।

সুলতানা কামাল জানেন, পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়েছিল সামন্তশ্রেণী চরিত্রের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা নেতাকর্মীদের এই দল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কালের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে দলটির নাম-নিশানা। টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদীর তীর থেকে উঠে আসা মহাত্মা গান্ধীর স্নেহসান্নিধ্য পাওয়া, শেরা বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে রাজনীতিতে পথ হাঁটা সাহসী তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের আবেগ অনুভূতিকে হৃদয়াঙ্গম করেছিলেন। ভাঙা গড়া আর শোষণ নির্যাতনের রাজনীতির পথে আওয়ামী লীগের নিভু নিভু বাতিকে জ্বালিয়ে তিনি যখন স্বাধীনতার লক্ষ্য নির্ধারণ করে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ হেঁটেছিলেন, ৬ দফার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন মস্কো ও পিকিং পন্থী বামরা বাস্তবতা থেকে হাজার মাইল দূরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শ্লোগান তুলে তার সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ পথে যখন জীবন বাজি রাখা সংগ্রামে একটি জাতিকে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার আদায়ের পথে স্বাধীনতার দিকে ঐক্যের মোহনায় মিলিত করছিলেন তখন তার সঙ্গে অর্ধশিক্ষিত আর সাধারণ মানুষেরা আস্থা রেখেছিলেন। সেদিন গণতন্ত্রের আগেই সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তথাকথিত মার্কসবাদী লেলিনবাদী মোটা বইয়ে ডুবে থাকা শিক্ষিত প্রগতিশীলরা মস্কো ও পিকিং-য়ের ছাতা ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাইরে হেঁটেছিলেন। অতি বিপ্লবীরা ভোটের বাক্সে লাথি মেরে সমাজতন্ত্র কায়েমের শ্লোগান তুলেছিলেন। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০এর নিরঙ্কুশ গণরায় নিয়ে একটি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে গৌরবের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের সেবাদাস মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলামসহ ধর্মনির্ভর সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির কবর রচিত হয়েছিল। সমাজতন্ত্রীরা শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের জন্য এটি ছিল বাস্তবতা। জনগণের আবেগ অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনার জায়গা থেকে এদেশের বামরা বা অতিবিপ্লবীরা বরাবর দূরত্বে ছিলেন বলেই জনগণের হৃদয় জয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে যেখানে একই আর্ত সামাজিক প্রেক্ষাপটে বামরা ৩৫ বছর শাসন করেছে সেখানে এদেশে সরকার গঠন দিবাস্বপ্নের মত দেখা দিয়েছে। এমনকি জনসমর্থন আদায় দূরে থাক লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি ও বড় দলে আশ্রিত ক্ষমতার অংশিদারিত্বের লোভ তাদের রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড পল্টন আর তোপখানায় গুটিয়ে এনেছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যারা মুজিব সরকারের করুনাশ্রিত হয়েছিলেন বা যারা অতি বিপ্লবের পথ নিয়েছিলেন তাদের বড় অংশই ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসকদের হেরেমে ঢুকেছিলেন। বাকি যারা খড় কুটোর মতো রাজনীতিতে সাইনবোর্ডসর্বস্ব দল নিয়ে টিকে ছিলেন তারা আজ মুজিবকন্যার আচল ধরে নৌকায় চড়ে সংসদ ও সরকারে ঠাই পেয়েছেন। এটাই আজকের রাজনীতির বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধু জগৎ বিখ্যাত ওয়েস্ট মিনিস্টার ডেমোক্রেসির ধাঁচে একটি উদার, ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দিয়েছিলেন। যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত। ৭৫’উত্তর বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত সাংবিধানিক চেতনা অনেকটাই বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ধর্মের রাজনীতি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রক্তে লেখা যে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে মৈত্রী ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল সেই ভারত বিরোধী রাজনীতিকে সামনে আনা হয়েছিল। সেই রাজনীতি দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী আওয়ামী লীগকে একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছে। আজকের বাস্তবতায় নববর্ষে খিচুড়ি খেতে যেমন মানুষ ভালোবাসে তেমনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা ও তত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিধান রাখার মতো সংবিধান বহাল।

গণভবনের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মুক্তচিন্তার নামে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া বিকৃত রুচি ও নোংরা রুচির পরিচয়। যেন এটা একটা ফ্যাশন দাঁড়িয়ে গেছে। ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তারা হয়ে গেল মুক্তচিন্তার। আমিতো এখানে মুক্তচিন্তা দেখি না। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। আমার ধর্ম আমি পালন করি। আমার ধর্ম সম্পর্কে কেও যদি নোংরা কথা লেখে সেটা আমরা কেন বরদাস্ত করব? এতো নোংরা নোংরা লেখা কেন লেখবে? যাকে আমি নবী মানি, তার সম্পর্কে নোংরা কথা কেও যদি লেখে সেটি যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, ঠিক তেমনি অন্য ধর্মের যারা আছেন, তাদের সম্পর্কে কেও যদি লেখে এটাও কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। এই সমস্ত নোংরা কথা, পর্ণের কথা কেন লেখবে? আমিতো মনে করি, এটা সম্পূর্ণ নোংরা মনের পরিচয়, বিকৃত মনের পরিচয়। এটা কোন ধর্ম বা দর্শন পালন নয়। এটা সম্পূর্ণ তাদের চরিত্রের দোষ এবং তারা বিকৃত মানসিকতায় ভোগে। এজন্য তারা এধরণের লেখে। আশাকরি এধরনের লেখা কেও লিখবেন না। আমি একজন মুসলমান হিসেবে প্রতিনিয়ত আমার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলি। সেখানে কেও যদি লেখে, এতে আমার নিজেরও কষ্ট হয়। আর এই লেখার জন্য অঘটন ঘটলে দোষ সরকারের উপর আসবে কেন? সবাইকে সংযম হয়ে চলতে হবে। অসভ্যতা কেও করবেন না। অসভ্যতা করলে তার দায়িত্ব কে নেবে? আর মানুষ খুন করার মধ্যে কোন সমাধান নাই। একজন লিখলো আরেকজন খুন করে সেটার প্রতিশোধ নেবে, এটাতো ইসলাম ধর্ম বলেনি। বিচারের দায়িত্ব আল্লাহ তাদের দেননি। বিচারের মালিক আল্লাহ। তিনিই শেষ বিচার করবেন। তাহলে আল্লাহর উপর কি তাদের ভরসা নাই? আল্লাহর উপর যাদের ভরসা নেই তারাই এসব খুন-খারাবি করে কারণ তারা আল্লাহ রসূল মানে না।’

ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্র-নজরুল অনুরাগী বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শেখ হাসিনা তাহাজ্জুদের নামাজ, ফজরের নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও সংবাদপত্র পাঠ করার মধ্য দিয়ে তার দিন শুরু করেন। অসংখ্যবার হজ্ব করেছেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুও বলেছিলেন, আমি মুসলমান। মুসলমান এক বারই মরে, বারবার মরে না। তার জন্য ফাঁসির আদেশই সেদিন শেষ হয়নি, কবরও খোঁড়া হয়েছিল। তিনি তার স্বাধীন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। এদেশের মানুষ বাংলাদেশের অভ্যুদয় কালে নফল নামাজ পড়েছে, রোজা রেখেছে বাঙালির মহত্তম নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য। সন্তান মুক্তিযুদ্ধে গেছে, মা জায়নামাজে এবাদত করেছে। অন্য ধর্মের মায়েরা প্রার্থনায় বসেছে। আমাদের ছেলেবেলায় সাম্প্রদায়িকতার বাতাস এতোটা ছিল না। মায়ের সুরেলা কণ্ঠে ‘ফাবিআইয়ি আলা ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’ কোরআন তেলাওয়াত শুনে ঘুম ভেঙেছে। ফজরের নামাজ পড়ে পড়তে বসা এবং মাগরিবের নামাজ পড়ে পড়াল টেবিলে বসা নিয়মে দাঁড়িয়েছিল। বাবাকে কখনো দেখিনি নামাজ ক্বাযা করতে। তাহাজ্জুদের নামাজ দিয়ে তিনিও আল্লাহর এবাদতই শুরু করতেন। সন্ধ্যা বেলায় পাড়ার মাসিমারা সন্ধ্যা আরতি ও প্রার্থনায় মগ্ন হতেন। জোসনা রাতে মা মাসিমারা শীতল পাটি বিছিয়ে উঠোন জোড়া জোসনায় ভিজে পানের বাটা নিয়ে বসতেন। দুর্গা পূজায়, পৌষ সংক্রান্তিতে আমরা পেতাম নিমন্ত্রণ। সবার বাড়ি বাড়ি যেতাম। ঈদের সময় তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত করতাম। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা পাঠের আসর, বাউলের জলসা, ছাত্র মিছিল, উৎসবে পার্বণে হরি হরি আত্মা হয়ে বন্ধুত্বের বাঁধনে জড়িয়ে কিংবা স্নেহ ছায়ায় সমবয়সী বা অগ্রজ-অনুজরা বেড়ে উঠেছি। আমাদের প্রেমের শহর সুনামগঞ্জে আসাম প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী অক্ষয় কুমার দাশ প্রতি রমযানে শহরের অনেকের বাড়িতে ইফতার পাঠাতেন। ঈদের জামাত শেষে দেখা যেত ঈদগার বাইরে লাঠিতে ভর দিয়ে মাথায় নেহেরু টুপি, কালো পামসু, শ্বেতশুভ্র ধুতি, কালো শেরওয়ানি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। ঈদের জামাত শেষে মুসল্লিরা তার সঙ্গে কোলাকুলি করে ঘরে ফিরতেন।

শহরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ভবনে একবার গল্পে গল্পে তুলে ধরেছিলাম। তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। বই পাগল এই রাজনীতিবিদ বলেছিলেন, তার ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে সুনামগঞ্জ শহরের একজন লোক তার বাবার কাছে যেতেন। তার পড়া রবীন্দ্রনাথের চয়নিকা বইটি তিনি ফেলে এসেছিলেন। সেটিতে সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরির সিল ছিল। শুনে বুকটা ভরে গিয়েছিল। সেই সম্প্রীতির শহরেও যেকোনো ধর্মীয় উস্কানিতে দেখেছি সেকালের সবার প্রিয় মিষ্টির দোকান দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে সুযোগ সন্ধানীরা হামলা করত মুনাফার আশায়। আমাদের ছাত্র জীবনে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও সেতুং নিয়ে আয়রনহীন কাপড় পরা বাম রাজনীতির ছায়ায় থাকা কর্মীরা উসকো খুসকো চুল নিয়ে তত্ত্ব কচলাতেন। জ্ঞানের গভীরে যেতে পারুন আর নাই পারুন, বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারুন আর নাই পারুন, নিজেকে বাম বলে কখনো নাক উঁচা, কখনো উগ্রতা নিয়ে গৌরবে হেঁটে বেড়ানোটাকে ফ্যাশন মনে করতেন। এদের অনেককে পরবর্তী জীবনে সুবিধাবাদীর তালিকায় নষ্ট আদর্শহীন রাজনীতির পথে হাঁটতে দেখেছি।

যেখানে রাজনৈতিক দর্শনে অনেকে অন্ধ সেখানে ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ তার আল্লাহ রসূল (স.) ও পয়গম্বরদের প্রতিই নয় নিজের ধর্মের প্রতিও অন্ধ থাকা স্বাভাবিক। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সব মত পথের মানুষ থাকবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি মডারেট মুসলিম কান্ট্রি। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন সেই স্বপ্নের লড়াই এখনও চলছে। এখানে বাংলা নববর্ষে, একুশের প্রথম প্রহরে বিজয় দিবসের সকালে মানুষের ঢল নামে একাত্ম হয়ে। জুমার নামাজে মসজিদের বাইরে মুসল্লিদের জনস্রোত দেখা যায়। দুর্গা পূজায় মন্দিরে মন্দিরে মানুষের জনস্রোত কিংবা ক্রিস্টমাসে বর্ণাঢ্য আলোকচ্ছটা শোভা পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, আল্লাহ, রসূল কটাক্ষ করে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে নিজেকে জাহির করা কারো কারো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।

এতে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, পরিবার ও রাষ্ট্রকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হলেও ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত সংবিধান সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করেছে। এখানে জনগণের শক্তি ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী শক্তিকে প্রতিরোধ করে আসছে। ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তি যেভাবে গনরায় জনসমর্থন নিতে ব্যর্থ হয়েছে তেমনি কবর রচিত হয়েছে বাম ও অতিবিপ্লবীদের। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শক্তি বরাবর গনরায়ে অভিষিক্ত হয়েছে। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে যেমন ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে সাফল্য আসেনি, তেমনি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, নাস্তিকদের হত্যার মধ্য দিয়ে শান্তিও নেমে আসেনি। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও হত্যার মধ্য দিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের পথ যারা গ্রহণ করছেন কার্যত তারা সমাজের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন। যেমনভাবে এক সময় চিহ্নিত হয়েছিলেন শ্রেণীশত্রু খতমের নামে অন্ধকার রাজনীতির অতিবিপ্লবীরা। এইখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য যথার্থ। আর দেশের জন্য একটি উদার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই উত্তম।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

শেখ হাসিনার কণ্ঠে নির্মোহ সত্যের উচ্চারণ

আপডেট টাইম : ০১:৪৮:২৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

পীর হাবিবুর রহমান:

রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলা বর্ষবরণের যে ঐতিহ্যের ধারা ছড়িয়ে পড়ছে দিনে দিনে তা গোটা বাংলাদেশে মানুষের প্রাণের উৎসবে পরিণত। বাঙালি জাতির আবেগ মতিত এই সাংস্কৃতিক উচ্ছ্বাসের বিপরীতে কোন অপশক্তি দাঁড়াতে পারেনি। একটি দেশ ও জাতি যেখানেই থাকুক চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গেই নয়, দেশজুড়ে মেলা, বাংলা খাবারের বাহারি আয়োজন, উৎসবের বর্ণীল ফ্যাশন সাজসজ্জা মিলে প্রাণে প্রাণে একাকার হয়ে যায়। দল মত নির্বিশেষে বাঙালি জাতি প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে উৎসবের মোহনায় প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর জাতির আত্মপরিচয় তুলে ধরার দিন পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ এবারও তাপদাহের মধ্যে আনন্দের বন্যায় ভাসিয়েছে। উৎসব পার্বণ কর্পোরেট সংস্কৃতির বাণিজ্যের আগ্রাসনে পতিত হলেও বাঙালির শাশ্বত বর্ষবরণের চেতনা বিচ্যুত হয়নি। এটি মানুষের আবেগ, প্রেম, চেতনা ও হৃদয় নিঃসৃত বিষয়। সেখান থেকে কেউ সরেনি।

নববর্ষের পরদিন শুক্রবার লৌহজঙের পদ্মার ওপারে বিচারপতি সামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী মানিকের বাড়িতে দাওয়াতে গিয়েছিলাম। বাইরের তাপদাহ সইতে পারি না। মানিক ভাইয়ের আন্তরিকতা উপেক্ষা করতেও পারিনি। দ্বিধা দ্বন্দ্বের পর অবশেষে রাকসুর সাবেক পত্রিকা সম্পাদক বন্ধুবর এবিএম জাকিরুল হক টিটনকে নিয়ে রওনা হই লৌহজঙের দিকে। ১৯৯৪ সালে একবার সরেজমিন নদী ভাঙনের রিপোর্ট করতে লৌহজং গিয়েছিলাম। চোখের সামনে দেখেছিলাম রাক্ষুসী পদ্মার ভাঙনে বাজারটি তলিয়ে যেতে। চোখের সামনে নিলাম হয়ে যাওয়া হাসপাতালটি ভেঙে নেওয়া হলো। পদ্মার দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষের উদাস চোখে দেখেছিলাম সর্বনাশের হাহাকার। প্রকৃতির খেয়ালি বৈরী আচরণে পদ্মার ভাঙনে কতো মানুষ হারিয়েছে বাপ-দাদার ভিটে। সেই পদ্মায় এখনও কোথাও ভাঙন, কোথাওবা ধু ধু মরুভূমি। বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাপ-দাদার ভিটে হারালেও নাড়ীর টানে পদ্মার ওপারে চরের মধ্যে একখানি ডুপ্লেক্স বাংলো বাড়ি বানিয়েছেন। চারদিকে কাশবন, বোঝা যায় বর্ষায় বাড়িটি কতো রোমান্টিকতা জাগিয়ে তোলে। ঢাকা থেকে অনেক মেহমান গিয়েছিলেন। ডাল-ভাতের আয়োজন ছিল উপাদেয়। সেই সঙ্গে ছিল গ্রামীণ পরিবেশে দিলখোলা আড্ডা। কুষ্টিয়ার লালনের আশ্রম থেকে আসা বাউলের গান আর হু হু বাতাস, মানুষের আন্তরিকতা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় ও একাত্ম করে তুলেছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্য সেগুফতা ইয়াসমিন এমিলি এই তাপদাহের মধ্যেও সবার মেহমানদারি করেছেন। ব্যাপক জনসংযোগ করছেন। একালে যখন হঠাত মেকআপ মারা মন্ত্রী নেতা এমপির আবির্ভাব ঘটে সেখানে এমিলির মতো তৃণমূল থেকে উঠে আসা গণমুখী চরিত্রের রাজনৈতিক কর্মীকে দেখলে শ্রদ্ধাই আসেনা সাদা-কালো যুগের রাজনীতিটাও মনে করিয়ে দেয়। পদ্মার ঢেউয়ে নৌকায় দুলতে দুলতে ভ্রমণ শেষে গাড়িতে উঠে মুঠোফোনে অনলাইন খবরে চোখ রাখি।

নববর্ষের দিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় কালে যে বক্তৃতা করেছেন তা পড়ে মুগ্ধ হই। যেন মানুষের হৃদয়ের কথা বলছেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও বিশ্বাস তার কণ্ঠে নির্মোহ সত্য হিসেবে উচ্চারিত হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে যে কথাগুলো বলতে চেয়েও বলতে পারিনি সেটিই যেন তিনি উচ্চারণ করেছেন। নববর্ষের আগের রাতে একাত্তর টিভির একাত্তর জার্নালে অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের বক্তব্যের প্রসঙ্গ এসেছিল। পহেলা বৈশাখ বিকেল ৫টার পর রমনাসহ উন্মুক্ত স্থানে বর্ষবরণের সকল অনুষ্ঠান আয়োজনে পুলিশ যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সুলতানা কামাল তার জন্য সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। সরকারই নয় খোদ প্রধানমন্ত্রী, প্রভাবশালী মন্ত্রী এমনকি শাসক দল আওয়ামী লীগের সমালোচনায় কখনো ভুল করিনি। কিন্তু সুলতানা কামালের বক্তব্যের সঙ্গে সেদিন একমত হতে পারিনি। তিনি বলেছেন, ‘সরকার মুক্তবুদ্ধির মানুষদের কোণঠাসা করে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। সরকার নিজেদের পিঠ বাঁচাতে ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চাচ্ছে না, তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাচ্ছে না। পক্ষান্তরে যারা মুক্তবুদ্ধির মানুষ তাদের উপরে নানা ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই শক্তিগুলোকে অনেক বেশী প্রশ্রয় দিচ্ছে, শক্তিশালী করে তুলছে। মানুষের অধিকার খর্ব করে, মানুষের বাইরে আসার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে, মানুষের উৎসবের আনন্দকে মলিন করে কীভাবে তারা দাবি করে গণতন্ত্রের সরকার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার।’

বিএনপির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। সেদিন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চেয়েছিলেন। তা করতে না পারার অপারগতা এবং যেসব ঘটনাবলীর সঙ্গে তারা একমত নন, একের পর এক সেসব ঘটনা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে চারজন উপদেষ্টার একজন হয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। সেদিন মরহুম মাহবুবে আলম পদত্যাগ না করলেও লেফট্যানেন্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী, ড. আকবর আলী খান, সি এম শফি সামি ও তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। সেদিন সুলতানা কামালের সামনে এটিই ছিল বাস্তবতা। সেটিই ছিল তাদের সামনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র পথ। এবারের নববর্ষে সরকার ৫টার পর উন্মুক্ত স্থানে উৎসব-অনুষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বাস্তব সত্যকেই গ্রহণ করেছে। মানুষের জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের হয়ে মানুষের জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষায় সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তা কারো কারো মনে বেদনা জাগালেও বাস্তবসম্মত। উৎসবের আনন্দ খানিকটা মলিন হলে কিংবা ছন্দপতন ঘটলে ক্ষতি নেই। মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু নিজেদের সীমাবদ্ধতা, বাস্তবতার নিরিখে নিরাপত্তার জন্য উৎসব সময়ের সীমারেখা টেনে রমনার বটমূলের মতো বোমা হামলা বা টিএসসির মতো নারীর সম্ভ্রম লুটের নির্লজ্জ নির্মম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে না দেওয়াই উত্তম। সুলতানা কামাল যেখানে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে না পারার বেদনা নিয়ে পদত্যাগ করে চারজন উপদেষ্টার সঙ্গে অভিনন্দিত হয়েছিলেন সেখানে বিকেল ৫টার পর উন্মুক্ত স্থানে উৎসবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সিদ্ধান্তকে যখন মধ্যযুগীয় চিন্তার প্রতিফলন বলেন তখন তার বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য মনে হয়না। মনে হয় তিনি অঘটন চেয়েছিলেন! কন্ঠে তার হঠকারী অতিবিপ্লবীর সুর পাওয়া যায়। মধ্যযুগের চিন্তায় বাঙালি জাতি অতীতেও ছিলনা বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও নেই। তাই একটি উদার সাংস্কৃতিক গণজাগরণের কারণে তিনি যেমন সনাতন হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ পুত্রকে বিয়ে করে সুখের জীবন কাটাচ্ছেন তেমনি প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েরা ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে যে কারো সঙ্গে হৃদয়ে হৃদয়ে মেলে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মুক্ত জীবন কাটাচ্ছেন।

সুলতানা কামাল জানেন, পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়েছিল সামন্তশ্রেণী চরিত্রের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা নেতাকর্মীদের এই দল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কালের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে দলটির নাম-নিশানা। টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদীর তীর থেকে উঠে আসা মহাত্মা গান্ধীর স্নেহসান্নিধ্য পাওয়া, শেরা বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে রাজনীতিতে পথ হাঁটা সাহসী তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের আবেগ অনুভূতিকে হৃদয়াঙ্গম করেছিলেন। ভাঙা গড়া আর শোষণ নির্যাতনের রাজনীতির পথে আওয়ামী লীগের নিভু নিভু বাতিকে জ্বালিয়ে তিনি যখন স্বাধীনতার লক্ষ্য নির্ধারণ করে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ হেঁটেছিলেন, ৬ দফার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন মস্কো ও পিকিং পন্থী বামরা বাস্তবতা থেকে হাজার মাইল দূরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শ্লোগান তুলে তার সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ পথে যখন জীবন বাজি রাখা সংগ্রামে একটি জাতিকে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার আদায়ের পথে স্বাধীনতার দিকে ঐক্যের মোহনায় মিলিত করছিলেন তখন তার সঙ্গে অর্ধশিক্ষিত আর সাধারণ মানুষেরা আস্থা রেখেছিলেন। সেদিন গণতন্ত্রের আগেই সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তথাকথিত মার্কসবাদী লেলিনবাদী মোটা বইয়ে ডুবে থাকা শিক্ষিত প্রগতিশীলরা মস্কো ও পিকিং-য়ের ছাতা ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাইরে হেঁটেছিলেন। অতি বিপ্লবীরা ভোটের বাক্সে লাথি মেরে সমাজতন্ত্র কায়েমের শ্লোগান তুলেছিলেন। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০এর নিরঙ্কুশ গণরায় নিয়ে একটি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে গৌরবের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের সেবাদাস মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলামসহ ধর্মনির্ভর সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির কবর রচিত হয়েছিল। সমাজতন্ত্রীরা শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের জন্য এটি ছিল বাস্তবতা। জনগণের আবেগ অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনার জায়গা থেকে এদেশের বামরা বা অতিবিপ্লবীরা বরাবর দূরত্বে ছিলেন বলেই জনগণের হৃদয় জয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে যেখানে একই আর্ত সামাজিক প্রেক্ষাপটে বামরা ৩৫ বছর শাসন করেছে সেখানে এদেশে সরকার গঠন দিবাস্বপ্নের মত দেখা দিয়েছে। এমনকি জনসমর্থন আদায় দূরে থাক লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি ও বড় দলে আশ্রিত ক্ষমতার অংশিদারিত্বের লোভ তাদের রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড পল্টন আর তোপখানায় গুটিয়ে এনেছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যারা মুজিব সরকারের করুনাশ্রিত হয়েছিলেন বা যারা অতি বিপ্লবের পথ নিয়েছিলেন তাদের বড় অংশই ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসকদের হেরেমে ঢুকেছিলেন। বাকি যারা খড় কুটোর মতো রাজনীতিতে সাইনবোর্ডসর্বস্ব দল নিয়ে টিকে ছিলেন তারা আজ মুজিবকন্যার আচল ধরে নৌকায় চড়ে সংসদ ও সরকারে ঠাই পেয়েছেন। এটাই আজকের রাজনীতির বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধু জগৎ বিখ্যাত ওয়েস্ট মিনিস্টার ডেমোক্রেসির ধাঁচে একটি উদার, ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দিয়েছিলেন। যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত। ৭৫’উত্তর বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত সাংবিধানিক চেতনা অনেকটাই বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ধর্মের রাজনীতি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রক্তে লেখা যে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে মৈত্রী ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল সেই ভারত বিরোধী রাজনীতিকে সামনে আনা হয়েছিল। সেই রাজনীতি দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী আওয়ামী লীগকে একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছে। আজকের বাস্তবতায় নববর্ষে খিচুড়ি খেতে যেমন মানুষ ভালোবাসে তেমনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা ও তত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিধান রাখার মতো সংবিধান বহাল।

গণভবনের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মুক্তচিন্তার নামে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া বিকৃত রুচি ও নোংরা রুচির পরিচয়। যেন এটা একটা ফ্যাশন দাঁড়িয়ে গেছে। ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তারা হয়ে গেল মুক্তচিন্তার। আমিতো এখানে মুক্তচিন্তা দেখি না। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। আমার ধর্ম আমি পালন করি। আমার ধর্ম সম্পর্কে কেও যদি নোংরা কথা লেখে সেটা আমরা কেন বরদাস্ত করব? এতো নোংরা নোংরা লেখা কেন লেখবে? যাকে আমি নবী মানি, তার সম্পর্কে নোংরা কথা কেও যদি লেখে সেটি যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, ঠিক তেমনি অন্য ধর্মের যারা আছেন, তাদের সম্পর্কে কেও যদি লেখে এটাও কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। এই সমস্ত নোংরা কথা, পর্ণের কথা কেন লেখবে? আমিতো মনে করি, এটা সম্পূর্ণ নোংরা মনের পরিচয়, বিকৃত মনের পরিচয়। এটা কোন ধর্ম বা দর্শন পালন নয়। এটা সম্পূর্ণ তাদের চরিত্রের দোষ এবং তারা বিকৃত মানসিকতায় ভোগে। এজন্য তারা এধরণের লেখে। আশাকরি এধরনের লেখা কেও লিখবেন না। আমি একজন মুসলমান হিসেবে প্রতিনিয়ত আমার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলি। সেখানে কেও যদি লেখে, এতে আমার নিজেরও কষ্ট হয়। আর এই লেখার জন্য অঘটন ঘটলে দোষ সরকারের উপর আসবে কেন? সবাইকে সংযম হয়ে চলতে হবে। অসভ্যতা কেও করবেন না। অসভ্যতা করলে তার দায়িত্ব কে নেবে? আর মানুষ খুন করার মধ্যে কোন সমাধান নাই। একজন লিখলো আরেকজন খুন করে সেটার প্রতিশোধ নেবে, এটাতো ইসলাম ধর্ম বলেনি। বিচারের দায়িত্ব আল্লাহ তাদের দেননি। বিচারের মালিক আল্লাহ। তিনিই শেষ বিচার করবেন। তাহলে আল্লাহর উপর কি তাদের ভরসা নাই? আল্লাহর উপর যাদের ভরসা নেই তারাই এসব খুন-খারাবি করে কারণ তারা আল্লাহ রসূল মানে না।’

ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্র-নজরুল অনুরাগী বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শেখ হাসিনা তাহাজ্জুদের নামাজ, ফজরের নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও সংবাদপত্র পাঠ করার মধ্য দিয়ে তার দিন শুরু করেন। অসংখ্যবার হজ্ব করেছেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুও বলেছিলেন, আমি মুসলমান। মুসলমান এক বারই মরে, বারবার মরে না। তার জন্য ফাঁসির আদেশই সেদিন শেষ হয়নি, কবরও খোঁড়া হয়েছিল। তিনি তার স্বাধীন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। এদেশের মানুষ বাংলাদেশের অভ্যুদয় কালে নফল নামাজ পড়েছে, রোজা রেখেছে বাঙালির মহত্তম নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য। সন্তান মুক্তিযুদ্ধে গেছে, মা জায়নামাজে এবাদত করেছে। অন্য ধর্মের মায়েরা প্রার্থনায় বসেছে। আমাদের ছেলেবেলায় সাম্প্রদায়িকতার বাতাস এতোটা ছিল না। মায়ের সুরেলা কণ্ঠে ‘ফাবিআইয়ি আলা ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’ কোরআন তেলাওয়াত শুনে ঘুম ভেঙেছে। ফজরের নামাজ পড়ে পড়তে বসা এবং মাগরিবের নামাজ পড়ে পড়াল টেবিলে বসা নিয়মে দাঁড়িয়েছিল। বাবাকে কখনো দেখিনি নামাজ ক্বাযা করতে। তাহাজ্জুদের নামাজ দিয়ে তিনিও আল্লাহর এবাদতই শুরু করতেন। সন্ধ্যা বেলায় পাড়ার মাসিমারা সন্ধ্যা আরতি ও প্রার্থনায় মগ্ন হতেন। জোসনা রাতে মা মাসিমারা শীতল পাটি বিছিয়ে উঠোন জোড়া জোসনায় ভিজে পানের বাটা নিয়ে বসতেন। দুর্গা পূজায়, পৌষ সংক্রান্তিতে আমরা পেতাম নিমন্ত্রণ। সবার বাড়ি বাড়ি যেতাম। ঈদের সময় তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত করতাম। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা পাঠের আসর, বাউলের জলসা, ছাত্র মিছিল, উৎসবে পার্বণে হরি হরি আত্মা হয়ে বন্ধুত্বের বাঁধনে জড়িয়ে কিংবা স্নেহ ছায়ায় সমবয়সী বা অগ্রজ-অনুজরা বেড়ে উঠেছি। আমাদের প্রেমের শহর সুনামগঞ্জে আসাম প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী অক্ষয় কুমার দাশ প্রতি রমযানে শহরের অনেকের বাড়িতে ইফতার পাঠাতেন। ঈদের জামাত শেষে দেখা যেত ঈদগার বাইরে লাঠিতে ভর দিয়ে মাথায় নেহেরু টুপি, কালো পামসু, শ্বেতশুভ্র ধুতি, কালো শেরওয়ানি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। ঈদের জামাত শেষে মুসল্লিরা তার সঙ্গে কোলাকুলি করে ঘরে ফিরতেন।

শহরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ভবনে একবার গল্পে গল্পে তুলে ধরেছিলাম। তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। বই পাগল এই রাজনীতিবিদ বলেছিলেন, তার ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে সুনামগঞ্জ শহরের একজন লোক তার বাবার কাছে যেতেন। তার পড়া রবীন্দ্রনাথের চয়নিকা বইটি তিনি ফেলে এসেছিলেন। সেটিতে সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরির সিল ছিল। শুনে বুকটা ভরে গিয়েছিল। সেই সম্প্রীতির শহরেও যেকোনো ধর্মীয় উস্কানিতে দেখেছি সেকালের সবার প্রিয় মিষ্টির দোকান দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে সুযোগ সন্ধানীরা হামলা করত মুনাফার আশায়। আমাদের ছাত্র জীবনে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও সেতুং নিয়ে আয়রনহীন কাপড় পরা বাম রাজনীতির ছায়ায় থাকা কর্মীরা উসকো খুসকো চুল নিয়ে তত্ত্ব কচলাতেন। জ্ঞানের গভীরে যেতে পারুন আর নাই পারুন, বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারুন আর নাই পারুন, নিজেকে বাম বলে কখনো নাক উঁচা, কখনো উগ্রতা নিয়ে গৌরবে হেঁটে বেড়ানোটাকে ফ্যাশন মনে করতেন। এদের অনেককে পরবর্তী জীবনে সুবিধাবাদীর তালিকায় নষ্ট আদর্শহীন রাজনীতির পথে হাঁটতে দেখেছি।

যেখানে রাজনৈতিক দর্শনে অনেকে অন্ধ সেখানে ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ তার আল্লাহ রসূল (স.) ও পয়গম্বরদের প্রতিই নয় নিজের ধর্মের প্রতিও অন্ধ থাকা স্বাভাবিক। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সব মত পথের মানুষ থাকবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি মডারেট মুসলিম কান্ট্রি। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন সেই স্বপ্নের লড়াই এখনও চলছে। এখানে বাংলা নববর্ষে, একুশের প্রথম প্রহরে বিজয় দিবসের সকালে মানুষের ঢল নামে একাত্ম হয়ে। জুমার নামাজে মসজিদের বাইরে মুসল্লিদের জনস্রোত দেখা যায়। দুর্গা পূজায় মন্দিরে মন্দিরে মানুষের জনস্রোত কিংবা ক্রিস্টমাসে বর্ণাঢ্য আলোকচ্ছটা শোভা পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, আল্লাহ, রসূল কটাক্ষ করে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে নিজেকে জাহির করা কারো কারো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।

এতে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, পরিবার ও রাষ্ট্রকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হলেও ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত সংবিধান সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করেছে। এখানে জনগণের শক্তি ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী শক্তিকে প্রতিরোধ করে আসছে। ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তি যেভাবে গনরায় জনসমর্থন নিতে ব্যর্থ হয়েছে তেমনি কবর রচিত হয়েছে বাম ও অতিবিপ্লবীদের। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শক্তি বরাবর গনরায়ে অভিষিক্ত হয়েছে। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে যেমন ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে সাফল্য আসেনি, তেমনি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, নাস্তিকদের হত্যার মধ্য দিয়ে শান্তিও নেমে আসেনি। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও হত্যার মধ্য দিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের পথ যারা গ্রহণ করছেন কার্যত তারা সমাজের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন। যেমনভাবে এক সময় চিহ্নিত হয়েছিলেন শ্রেণীশত্রু খতমের নামে অন্ধকার রাজনীতির অতিবিপ্লবীরা। এইখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য যথার্থ। আর দেশের জন্য একটি উদার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই উত্তম।