নির্বাচনী প্রচারপত্রে মনের মানুষটিকে খুঁজে পাই

রফিকুল ইসলামঃ ‘সজ্জন গুণ খোঁজে, দোষ খোঁজে পামর / মক্ষিকা ভ্রুণ খোঁজে, মধু খোঁজে ভ্রমর – ‘বিখ্যাত এই প্রবাদবাক্যটিই এই নিবন্ধের উদ্দীপক।

এক.
সম্প্রতি একটি সালিশি বিচারক সভাতে উপস্থিত ছিলাম। বিরোধে জড়িত উভয় পক্ষের অভিমত গ্রহণের পর বিচারকার্য চিহ্নিত করে তাঁদের রায় ছিল দৃষ্টান্তমূলক। পল্লী অঞ্চলের সালিশ বেশির ভাগ স্বার্থান্বেষী মহল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেও এখানে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা গেছে। স্বার্থান্বেষীরাও ন্যায্যতার কাছে হয় ন্যুব্জ।

স্থানটি ছিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্বপ্নের হাওর কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা সদর ইউনিয়ন পরিষদে। টানা তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শরীফ কামাল ছিলেন সালিশের সভাপতি। এতে উপস্থিত ছিলেন সদর ইউপির প্রাক্তন চেয়ারম্যান আহাম্মদ আলী চৌধুরী, উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান মো. ইব্রাহীম মিয়া।

প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে প্রধানত যে দু’ধরনের বিচারব্যবস্থা প্রচলিত, তার একটি হলো সালিশ। সাধারণত কোনো সালিশ পক্রিয়া শুরু হয় বাস্তব তথ্যগুলোর ভিত্তিতে। ইসলাম ধর্মেও বলা হয়েছে, ‘একজন ন্যায় বিচারক ফেরেশতার সমতূল্য।’

দুই.
আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সপ্তম ও শেষ ধাপে সারাদেশে ১৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ভোট নেওয়া হবে। এ নিয়ে ৪ হাজার ১০৬টি ইউপির তফসিল ঘোষণা করা হলো।

এটি দশম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এই নির্বাচনের শেষ পর্যায়ে এসে এবং সেদিনের সালিশি বিচারব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়, ন্যায্যতার প্রতিফলন দেখে বেজায় মনে পরছে মো. শামসুল হক ভূঁইয়াকে।

তাঁর জন্ম কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডে নতুন বগাদিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। কিন্তু ক্ষণজন্মা তৃণমূলের এই নেতা ২০০৩ সালে করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলা-চামড়া বন্দরের অকুস্থলে মর্মান্তিক এক লঞ্চ দুর্ঘনায় সবাইকে কাঁদিয়ে অঙ্কুর বয়সেই চলে যান না ফেরার দেশে।

সামসু হক ভূঞা উচ্চ শিক্ষত না হলেও মানবসত্তার অধিকারী ছিলেন। জানা-বুঝা ও শেখার ক্ষেত্রে আগ্রহ ছিল প্রবল। বয়সে অগ্রজ হলেও প্রকৃত নেতৃত্বের গুণে গুণান্বিত হতে আমার কাছে গাইড লাইন চাইতেন আত্মম্ভরিতা না করে।

নেতৃত্ব মানেই যে প্রভুত্ব নয়, একটি শিল্প – সেই বোধটা জাগাতে পেরেছিলাম। সমাজের উপকারের উদাহরণ সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করেছিলাম এই বলে যে, সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হয়ে তাঁর এমন কাজ করা উচিত, যাতে সমাজের দশজন মানুষ তাঁকে অনুসরণ করে। ভীতির জায়গাটিতে নয়, মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিতে হবে ঠিক যেন – ‘বেঁচেও মরে যদি মানুষ দোষে, / মরেও বাঁচে যদি মানুষ ঘোষে।’

এ পথ পরিক্রমায় ২০০৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়ে বিশেষ করে সাবেক ৩ নং ওয়ার্ডে একতার যে নজিরবিহীন হৃদ্যতার ঐকতান স্থাপন করে গেছেন, তা আজ নির্বাসনে। আদর্শিক অবস্থানে মো. সামসুল হক ভূঞার অনুজ মো. নূরুল হক ভূঞা বিপরীত মেরুতে।

এলাকাতে তখনকার নেতৃত্ব বিকাশে স্বয়ংক্রিয় কতগুলো ব্যবস্থা ছিল, যা ধ্বংস করা হয়ে গেছে। ‘হীরক রাজা ভগবান’ নেতৃত্ব কায়েম হয়ে এলাকাটি হারিয়েছে সহনশীলতা ও সম্প্রীতির চরিত্র। আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতির হলুদ রঙে আবর্তিত নোংরা ভিলেজ পলিটিক্সে ‘খাইট্টা লাগাচ্ছে আইট্টা গিয়া ভাইঙা দিয়া আসছে!’

সামসুল হক ভূঞা ছিলেন আমার আপনজন। আমি ছিলাম তাঁর ছায়াসাথী ও আপদ-বিপদের ভাগীদার শুধু নয়, খুদে উপদেশকও। ২০০৩ সালের মার্চের ইউপি নির্বচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক ১ ও ২ নং ওয়ার্ড এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে অত্যুগ্র বাধাগ্রস্ত করে তোলা হলে প্রথমে আমি ভোটারের কাছে যাবার অভিনব কৌশল অবলম্বনে নির্বাচনী প্রচারপত্র লিখে দেই, যা তখনকার জেলা প্রশসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বহুল প্রশংসার পাত্র হন এবং পদক্ষেপ গ্রহণে নির্বচনী প্রচারণা হয় নিরাপদ ও অবাধ। তখন আমি ছিলাম জাতীয় সংসদ ও রাজনৈতিক বিটের স্পেশাল করসপনডেন্ট।

সে সময় গোপদিঘী থেকে প্রাক্তন চেয়ারম্যান নূরুল হক বাচ্চুই ছিল একমাত্র সমর্থক। তাকেই কিনা শেষতক টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহার করে বিশেষত নতুন বগাদিয়া ও ধলাই গ্রামে হতদরিদ্র সুবিধাবঞ্চিত গ্রামবাসীর কাছে ভিলেন বানানো হলো এবার এবং প্যানেল চেয়ারম্যান আজিজুল হককেও!

এছাড়া ৫ জানুয়ারির ‘২২ এর নব নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেনও যদি ওই পদ মাড়ান, তাহলে সাধারণ মানুষ দ্বারা তিনিও নিক্ষিপ্ত হবেন আস্তাকুঁড়ে।

বর্তমান সামাজিক অবক্ষয়ের অধোমুখীতায় মো. সামসুল হক ভূঞার ওই নির্বাচনী প্রচারপত্রটি প্রচার সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে – ‘শিকল পরা ছল / মোদের এই শিকল পরা ছল।’

সম্মানিত গোপদিঘী ইউনিয়নবাসী,
আসসালামু আলাইকুম / আদাব।
দেশজুড়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে। আসছে ১ মার্চ ২০০৩ ইং শনিবার অনুষ্ঠিত হবে গোপদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। উক্ত নির্বাচনে আমি মো. সামসুল হক ভূঞা আপনাদের খেদমতে ছাতা প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে দাঁড়িয়ে সকলের দোয়া, সহযোগিতা ও ভোট প্রার্থনা করছি।

আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, নতুন বগাদিয়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে আমার জন্ম। আমি গোপদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম জনাব মো. আবদুল আলী ভূঞার জ্যেষ্ঠপুত্র এবং দানবীয় খ্যাত মরহুম জনাব আবদুল মজিদ ভূঞার নাতি।

বাপ-দাদার জনহিতৈষীমূলক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমিও মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করেছি। জনকল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছি আমার জীবন ও সম্পদ। সৃজনশীল ও সুস্থ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। স্বাস্থ্য রক্ষায় কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য জমি দিয়েছি। জমি দিয়েছি গোরস্থান, ঈদগাহ ও খেলার মাঠের জন্য। এছাড়া শিক্ষার প্রসারে এবং জীবনমান উন্নয়নে আরও জমি দিয়েছি হাট-বাজার, প্রাইমারি ও হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার জন্যও। শুধু তাই নয়, বগাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি ও ধলাই-বগাদিয়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং মিঠামইন মহাবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সদস্য পদে অধিষ্ঠিত হয়ে আমি একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি হিসেবে সমাদৃত ও স্বীকৃতি পেয়েছি।

আপনাদের আশীর্বাদে গ্রাম্য সালিশি ন্যায় বিচারক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছি আমি। পবিত্র কোরআন শরিফে ইরশাদ হয়েছে, “আপস-নিষ্পত্তি উত্তম ব্যবস্থা।”  আমি সেই লক্ষ্যে কাজ করে ব্যক্তি ও পরিবার তথা সমাজে পরস্পরের মধ্যকার সৃষ্ট ঝগড়া-বিবাদ ন্যায্যতার ভিত্তিতে সন্তোষজনক মিমাংসা করে দিয়েছি, যাতে বিরোধীতার বিস্ময় দংশনে সমাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয়।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের এলাকা অনেক দিক দিয়েই পিছনে পড়ে আছে। তাই পাড়াগাঁয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে আমার নিন্মোক্ত পরিকল্পনা রয়েছে –
১. প্রতিটি পাড়া-গ্রাম ও সেচ প্রকল্প পাওয়ার পাম্প পল্লী বিদ্যুতের আওতায় আনা এবং বর্ষার ভাঙনরোধে গ্রামে গ্রামে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা।
২. খাল কেটে গ্রামের বন্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জমির ফসলের উৎপাদন বাড়ানো এবং সংযোগকারী রাস্তা, সেচ খাল, জলাধার ও বন্যা নিরোধক কাঠামো তৈরি।
৩. নাগরিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে রাস্তা ও কালভার্ট নির্মাণ এবং স্থানীয় হাট-বাজারর সংস্কার ও উন্নতি সাধন।
৪. কৃষি, শিক্ষা ও আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত ইউনিয়ন কমিটিগুলোকে  সক্রিয় ও গতিশীল করা।
৫. মানব সম্পদ উন্নয়নে দুঃস্থ মহিলাদের জন্য অধিকসংখ্যক ভিজিডি-ভিজিএফ কার্ড চালু এবং বয়োবৃদ্ধদের জন্য অধিকসংখ্যক বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন রকম নাগরিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, ‘মিথ্যা বলা ও প্রতারণা করা মহাপাপ।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদেরকে প্রভাবিত করার জন্য অনেকে মিথ্যা ও অবাস্তব কথা জনসম্মুখে তুলে ধরছেন প্রতিপক্ষ প্রার্থী। যেমন- আমাকে ভোট দিলে ইউনিয়ন কমপ্লেক্স গোপদিঘী হতে অন্যত্র স্থানান্তরিত করিয়ে ফেলব। আসলে, এ কাজ করা কখনো কোনো অবস্থাতেই কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ, সরকারের একটি নিয়মনীতি আছে। সর্বোপরি আছে আইন। তাতে উল্লেখ রয়েছে, ‘চেয়ারম্যান মনগড়া মতো যেখানে খুশি সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবেন না।’ আইনে আরও আছে, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মেম্বারদের সর্বোচ্চ সমর্থন ছাড়া চেয়ারম্যানের এককভাবে কোনকিছু করার ক্ষমতা নেই।’ তারপরও ধর্মতঃ আমি আপনাদের কাছে কথা দিলাম, আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে ‘ইউনিয়ন কমপ্লেক্স’কে অন্যত্র সরানোর মতো হীন কাজ কখনো কোনদিন করবো না।

শুধু নির্বাচনের জন্য নয়, কিংবা চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য নয়; মানুষের পাশে থেকে মানুষের উপকার করার জন্যই নিবেদিত থাকবো। আমি সকল স্তরের মানুষের কাছে এই বলে পরিচিত হতে চাই যে, ‘আমি আপনাদেরই লোক; কারও ভাই, কারও মামা আবার কারও বন্ধু।’

আমার অতীত ও বর্তমান আপনাদের মাঝে সবিনয়ে তুলে ধরলাম। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও আপনাদের সম্মুখে পেশ করলাম। আপনাদের সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে এ সমস্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবো। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডে আপনাদেরকে সাথে নিয়ে সুষম উন্নয়নের সুফল আমি সকলের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবো।

পরিশেষে গোপদিঘী ইউনিয়নবাসীর কাছে আমার আকুল আবেদন, ‘আপনারা আমাকে ছাতা মার্কায় একটা করে ভোট ভিক্ষা দেন। আপনাদের খেদমতে আমি জীবন উৎসর্গ করবো এবং এলাকার সার্বিক উন্নয়নে আজীবন কাজ করে যাবো ইংশাআল্লাহ্।’

সকলের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। আল্লাহ্ হাফেজ।

আপনাদেরই স্নেহধন্য -মো. সামসুল হক ভূঞা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর