ইটনার জয়সিদ্ধি আনন্দমোহন বসুর বাড়ি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এই বাড়িটি কিশোরগন্জ ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্তিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা।
ময়মনসিংহ এবং কলকাতার আনন্দমোহন কলেজ দুইটি তারই নামে প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছিলেন ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দলের ২ মেয়াদে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
ঐ সময়ে তিনিই একমাত্র ভারতীয় হিসেবে র‍্যাংলার’ উপাধি পান।

র‍্যাংলার হলো গণিতশাস্ত্রের ওপর প্রদত্ত পৃথিবীর সর্বোচ্চ উপাধি, যা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া হয়। আর এই র‍্যাংলার উপাধি পান কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম জয়সিদ্ধির আনন্দমোহন বসু ১৮৭৪ সালে। তিনিই প্রথম এবং একমাত্র ‘র‍্যাংলার’ উপাধি পাওয়া একজন ভারতীয়।তার জন্ম ১৮৪৭- মৃত্যু ১৯০৬।

এত গুণের অধিকারী তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম একজন বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কারক এবং বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আনন্দমোহন বসুর জন্ম ভিটা জয়সিদ্ধিতে গিয়ে তিনি যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরে বসে এক অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হয়েছিলো ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই বাল্যবন্ধু সাগর মীর ও বড় ভাই জামাল মীর (ওসি কদমতলী থানা) সহ তাদের স্বজনদের আমাদের সুন্দর আপ্যায়ন এবং মূল্যবান সময় প্রদান করার জন্য।

বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি বুদ্ধিজীবী আনন্দমোহন বসু;
ক্যামব্রিজের মতো বিশ্বের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে পড়া প্রথম ভারতীয় আনন্দমোহন বসু। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন তুখোড় মেধাবী। ১৮৬২ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন তিনি। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ এবং বিএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৮৭০ সালে তিনি লাভ করেন প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি। সেই বৃত্তির টাকায় ১৮৭৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে পাড়ি জমান এবং দেশের জন্য বয়ে আনেন অফুরন্ত সম্মান ও সুখ্যাতি। উপমহাদেশের মানুষদের প্রতি ব্রিটিশদের দেখার চোখই বদলে দিয়েছেন হাওরের ধুলো মেখে শৈশব কাটানো এই ব্যক্তিটি।

আনন্দমোহন বসুর পরিচয় শুধু মেধাবী হওয়াই নয়; তিনি ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা।

শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান

কলকাতাই ছিল তৎকালীন সমাজের পাশ্চাত্য শিক্ষার কেন্দ্রমুখ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আলোকশিখা যদি মফস্বলগুলোতে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব না হতো তাহলে কি এই উপমহাদেশ আজ শিক্ষিত হতে পারত? আমরা পারতাম ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের অধিকার-স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে?

না, পারতাম না। এই গ্রামে-গঞ্জে-মফস্বলে শিক্ষার আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতে যেসব মনীষী তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, তাদের মাঝে অনেকেই আছেন, যাদের কথা আমরা জানি না, নামও হয়তো শুনিনি সবাই। এরকম একজন হারিয়ে যাওয়া মনীষী কিশোরগঞ্জের আনন্দমোহন বসু। তিনি ময়মনসিংহে নিজের বাড়িতে কলকাতা সিটি কলেজের একটি শাখা নির্মাণ করেন। ১৯০১ সালে এর নামকরণ করা হয় ময়মনসিংহ কলেজিয়েট স্কুল হিসেবে। ১৯০৬ সালের ২০ আগস্ট তার মৃত্যুর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলেও দু’বছর পর তা পুনরায় চালু করা হয়। তখন এর নাম দেয়া হয় ‘আনন্দমোহন কলেজ’, যা আজ ময়মনসিংহ জেলার নামকরা বিখ্যাত কলেজ হিসেবে সগর্বে উদ্ভাসিত। একইসাথে তিনি কলকাতা সিটি স্কুল ও কলেজেরও প্রতিষ্ঠাতা।

ময়মনসিংহের গর্ব- আনন্দমোহন কলেজ;
শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ, ত্যাগ ও সাধনার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে হান্টার কমিশনের সদস্য নিযুক্ত করেন। পরে ক্রমান্বয়ে তিনি বঙ্গীয় আইন সদস্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনেট সদস্য এবং একজন ‘ফেলো’ হিসেবে মনোনীত হন। তার চেষ্টায় ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট অভ ইনকর্পোরেশন’ সংশোধন করা হয়। এ সংশোধনের পর থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি শিক্ষা গ্রহণকারী সংস্থাই নয়, শিক্ষা দানকারী সংস্থাও হয়ে ওঠে।

এরপর ১৮৯২ সালে ভারত আইন যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বঙ্গীয় আইন পরিষদের একজন সদস্য নির্বাচন করবার অধিকার দেয়, তখন আনন্দমোহন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের প্রথম প্রতিনিধি হন। নারীদের জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন। ১৮৭৬ সালে কলকাতায় তিনি বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে তিনি আরো ভালো ফল লাভের আশায় বেথুন কলেজের সাথে যুক্ত করে দেন।

বঙ্গীয় রেনেসাঁর স্থপতি হিসেবে যাদের নাম শোনা যায়, তাদের মধ্যে কোথাও তার নামটি সেভাবে উচ্চারিত হতে দেখা যায় না। অথচ তার অবদান সেই জাগরণকে দিয়েছিল নতুন এক মাত্রা।

রাজনৈতিক ভূমিকাঃ

রাজনীতি অঙ্গনের জন্য তিনি ছিলেন একজন অগ্রদূত এবং স্বপ্নদ্রষ্টা। বিলেত থেকে ফেরত এসে তিনি যখন দেখলেন, উপমহাদেশের ছাত্র সমাজ তাদের অবসর সময়ে দেশসেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে; তারা নারীজাতির শিক্ষা, জনহিতকর কাজে নিয়োজিত- তখন তার মনে আশার দানা বাঁধল। তিনি উপলব্ধি করলেন, উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে হলে অবদান রাখতে হবে এই ছাত্র সমাজেরই। তারাই পারবে এদেশ থেকে বিদেশীদের শাসন দূর করতে, তারাই পারবে নারীদের জাগিয়ে তুলতে। তাই এ দেশের উন্নয়ন, বিকাশ, স্বাধীনতার বীজ রোপণ করতে হবে তাদেরই হাত ধরে। আর তাই ১৮৭৫ সালে তিনি ‘ক্যালকাটা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে ছাত্রদের জন্য একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে এর সভাপতি হন।

তার অন্যতম এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। এর উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করা। ১৮৭৬ সালে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। পরে এর নাম হয় ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাকালে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সাথে অসামান্য অবদান রাখেন আনন্দমোহন বসু। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ছিলেন তার অন্যতম পরামর্শদাতা।

তিনি দু’বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিত্ব পান। ১৮৮৪, ১৮৯০ এবং ১৮৯৫ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।

তথ্য সূএঃ সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর