চা বাগান অধ্যূষিত সিলেটের মৌলভীবাজার জেলা। এই জেলায় পাহাড়ি উচু-নিচু ৯২টি চা বাগান রয়েছে। জেলার সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলায় ডানকান ব্রাদার্স এর শমশেরনগর চা বাগান। চা বাগানে চা চাষ ছাড়াও রয়েছে পরিত্যক্ত টিলাভূমি, রাবার চাষাবাদ ও আবাদি কৃষিজমি। বিশাল এই চা বাগানের দেওছড়া, কানিহাটিসহ কয়েকটি ফাঁড়ি চা বাগান রয়েছে।
সম্প্রতি দেওছড়া ফাঁড়ি চা বাগানে টিলাভূমি কেটে তৈরি করা হয়েছে দীর্ঘ লেক। পাহাড়ি টিলার ঢালু ভুমি কেটে প্রায় দেড় হাজার মিটার দীর্ঘ লেক তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনরূপ অনুমতি ছাড়া এবং ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন না করেই সরকারি লিজকৃত ভূমিতে লেক তৈরির ফলে পরিবেশের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দেওছড়া চা বাগানের উত্তরাংশের শেষ প্রান্তে চা প্লান্টেশন এলাকার বাইরে পতিত টিলার ঢালু ভূমির আঁকাবাকা প্রায় দেড় হাজার মিটার দীর্ঘ ভূমিতে লেক খনন করা হয়েছে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পাঁচটি এসকেবেটার লাগিয়ে একাধারে এই খননকাজ চালানো হয়। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চা বাগানের স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিক অভিযোগ করে বলেন, চা বাগানে চা গাছের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণে ছায়াবৃক্ষ।
ছায়া বৃক্ষগুলো প্রবল খরার সময়ে চা গাছের ছায়ার যোগান দেয় আবার বর্ষার সময়ে ভারী বৃষ্টিপাত থেকেও চা গাছকে রক্ষার কাজ করে। গত কয়েক বছর আগেও দেওছড়া চা বাগানের প্রতিটি সেকশনে পর্যাপ্ত পরিমাণে ছায়াবৃক্ষ ছিল। এসব ছায়াবৃক্ষের অধিকাংশই ছিল বৃহদাকার। ম্যানেজমেন্টের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় চা বাগান ও বস্তির একটি দালাল সিন্ডিকেট চক্র গত কয়েক বছরে মূল্যবান গাছ কেটে খন্ডাংশ করে নিয়ে গেছে। আশপাশ স’মিল সমুহে চিরাই করে এগুলো বিক্রি করা হচ্ছে।
শ্রমিকরা আরো বলেন, বাগান ম্যানেজমেন্টকে এগুলো জানানো হলেও কার্যকর আইনী কোন পদক্ষেপ না নিয়ে চা বাগানের দু’একজন শ্রমিককে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দিয়ে সাময়িক কাজ বন্ধ রাখেন। চা বাগানের ছায়াবৃক্ষ উজাড় করে এখন সেচের জন্য টিলা কেটে লেক তৈরি করা হয়েছে। এর কিছু অংশে কৃষিজমিও ছিল।
বাগানের সাধারণ শ্রমিকরা কৃষিজমি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। লেক খননের ফলে শ্রমিকদের কৃষি উৎপাদনও চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। চা বাগানে খরায় পুড়ে যাওয়া গাছে সেচ দেয়ার জন্য এই লেক তৈরি করতে যে পরিমাণে অর্থ ব্যয় হয়েছে তার চেয়ে অর্ধেক টাকা খরচ করেও চা গাছের ছায়াবৃক্ষের ব্যবস্থা করা যেতো এবং পরিবেশেরও ভারসাম্য রক্ষা করা যেতো বলে তারা মন্তব্য করেন।
ওই বাগানের শ্রমিক দেওরাজ ও শিউ প্রসাদ বলেন, টিলাভূমির পাশাপাশি যেটুকু কৃষিজমি খুড়ে লেক তৈরি করা হয়েছে সেই কৃষিজমিতে যুগ যুগ ধরে চা শ্রমিকরা ধান চাষাবাদ করতেন। এখন বিকল্প কোন স্থানে চাষাবাদের জমি না দিয়েই টিলার সাথে কৃষিজমিটুকুও লেকে পরিণত করা হয়েছে। ফলে এই শ্রমিকদেরও জীবিকা নির্বাহের কষ্টটা একধাপ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
চা শ্রমিকদের আবাদকৃত লেক খনন কাজের সুপারভাইজার জানান, চা বাগানের আঁকাবাঁকা ঢালু ভূমিতে খননকৃত লেক প্রায় দেড় হাজার মিটার দীর্ঘ এবং এর গভীরতা প্রায় ১৮ ফুট হবে। স্থানীয় দু’জন শিক্ষক ও একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, চা বাগানে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি অনেক লেক রয়েছে। কিন্তু বৃহদ টিলার ঢালুভূমি কেটে এভাবে লেক তৈরির ফলে পরিবেশেরই ক্ষতি বেশি হবে।
চা বাগান কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ এর ধারা ৬(খ) লঙ্ঘন করেই চায়ের টিলাভুমিতে লেক খনন করেছে। এই ধারায় বলা হয়েছে ‘কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে কোন পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইতে পারে।’
একইভাবে এখানে লেক খনন করতে বেশ কিছু আবাদি জমি বিনষ্ট হয়েছে। অথচ কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভুমি ব্যবহার আইন ২০১৫ ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে ‘যে স্থানে কৃষিজমি রহিয়াছে, তাহা এই আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা করিতে হইবে এবং কোনোভাবেই তাহার ব্যবহার ভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাইবে না।’ এই দু’টি আইন অমান্য করেই চা বাগান কর্তৃপক্ষ টিলাভূমি ও ধানিজমি খনন করে লেক তৈরির ফলে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতারও ক্ষতি বয়ে আনবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
চা বাগান সংশ্লিষ্টরা জানান, দেওছড়া চা বাগানের পতিত টিলার ঢালু ভূমিতে দীর্ঘ প্রায় ১৫শ’ মিটার লম্বা লেক তৈরির জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন অনুমতি নেয়া হয়নি কিংবা ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনও করা হয়নি। এই লেক খনন করার ফলে শুষ্ক মৌসুমে সংরক্ষিত পানি বাগানে চা গাছের জন্য সেচ দেয়ার সুবিধা হবে।
এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ রফিকুল আলম বলেন, এক ভূমি অন্য কাজে ব্যবহারে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তবে দেওছড়া চা বাগানে টিলার ঢালু ভূমিতে এ ধরনের কার্যক্রম বিষয়ে ভূমির কোন শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়নি।
শমশেরনগর চা বাগান ব্যবস্থাপক মোঃ জাকির হোসেন বলেন, পানি সংরক্ষণের জন্য টিলার ঢালু ভূমিতে এই লেক খনন করা হয়েছে। ঢালু ভূমি থাকার কারনেই ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে করা হয়নি।