ঢাকা ১২:১৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিশোরগঞ্জের প্রাণেশ !স্যার ড. মাহফুজ পারভেজ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৫১:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ মে ২০১৫
  • ৭৩৭ বার

পিকেসি নামে সমধিক পরিচিত প্রফেসর প্রাণেশ কুমার চৌধুরী উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকাল ছাড়া জীবনের বাকি সবটুকু সময়কালই কাটিয়েছেন পূর্ব ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক ভূগোলের জনপদ নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জে। নেত্রকোনার জলমগ্ন সুমৃত্তিকা তাঁর মানস গঠন করেছে আর কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যিক ভূমিতল তাঁর কর্ম ও বিকাশের পাটাতন রূপে কাজ করেছে। তাঁর জীবন ও কীর্তি ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির নান্দনিক ত্রিভূজ-বিন্যাসে সমুজ্জ্বল। শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চাকে অবলম্বন করে তিনি সমাজের জন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। ষাটের দশকে প্রফেসর চৌধুরী শিক্ষকতার উদ্দেশে যখন কিশোরগঞ্জে আসেন, তখন এ জনপদে চলছে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের জোয়ার। উত্তর-ঢাকা এবং পূর্ব ময়মনসিংহের আদি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুরুদয়াল কলেজের তখন ভরা যৌবন। উত্তর কুমিল্লার মানুষ অধ্যক্ষ ওয়াসিমুদ্দীনের নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্যমী, নিবেদিতপ্রাণ একদল তরুণ শিক্ষক জড়ো হতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে দেশের রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উপাচার্য, আমলা, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বহু কীর্তিমানের জন্ম হয় এ কলেজ ক্যাম্পাস থেকে। কলেজের শিক্ষকগণও স্থানীয় সমাজ প্রগতি, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এদের মধ্যে নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, জিয়াউদ্দীন আহমেদ, রফিকুর রহমান চৌধুরী ও প্রাণেশ কুমার চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। প্রফেসর ঘোষ স্বকীয় রচনায় বিশিষ্টতার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের প্রণোদনার ক্ষেত্রে স্মরণীয়। প্রফেসর আহমেদ নিজস্ব রচনা, সম্পাদনা, সাংবাদিকতা, সাংগঠনিক দক্ষতায় উজ্জ্বল। প্রফেসর রফিকুর রহমান চৌধুরী মূলত নিভৃতচারী গবেষক। ইংরেজি সাহিত্য ও ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে উচ্চাঙ্গের অনুবাদকর্মে তিনি পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রফেসর প্রাণেশ কুমার চৌধুরী নিজের পেশাগত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের গুণগত রূপান্তরে মনোনিবেশ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ব্যক্তিগত বা একক উদ্যোগ নিয়ে কিছু করেছেন, এমন নয়। সমগ্র গুরুকুলের অংশ হিসেবে তিনি সামষ্টিক তৎপরতায় নিয়োজিত থাকেন। পরবর্তীকালে, যখন তাঁর স্বনামধন্য সহকর্মীদের অনেকেই হয় অবসরপ্রান্ত, নয় লোকান্তরিত, তখন দেখা যায় তিনি একক ব্যক্তিসত্তায় একজন দিকনির্দেশক-অগ্রণী পুরুষ রূপে তাঁর সামাজিক, পেশাগত ও সাহিত্যিক দায় পালন করে চলেছেন। নিজস্ব কর্তব্যবোধের প্রণোদনায় তিনি তাঁর কর্মপ্রবাহে কখনোই শৈথিল্যকে স্থান দেননি। ষাট-সত্তরের উত্তাল আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং বর্তমান সমকালীনতায় তিনি তাঁর দায়িত্বসচেতন কর্মধারাকে প্রাণময় রেখেছেন। এক্ষেত্রে স্পষ্টত মনে হয়, তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ‘সিম্পল লিভিং, হাই থিঙ্কিং’ এবং পরমহংসদেব ও বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য হিসেবে ‘কর্মই ধর্ম’ তত্ত্বের নিষ্ঠাবান সাধক। তাঁর জীবনযাপনের বীজমন্ত্রও এসব উচ্চতর দার্শনিকতার মধ্যেই নিহিত। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে কাউকে স্বভাবতই আর্থসামাজিক-পেশাগত-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ইত্যাদি নানা আঙিক ও ক্ষেত্র থেকে মূল্যায়ন করা হলেই সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিসত্তার রূপ-চারিত্র্যটি উদ্ভাসিত হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় অবশ্যই তিনি একজন দলনিরপেক্ষ মানুষ। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নে তিনি বাঙালি জাতিসত্তার স্বার্থের দিশারী। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের কঠিন রণাঙ্গনকে আলিঙ্গন করতেও তিনি সামান্যতম বিলম্ব করেন নি। প্রগতি, মানবতাবাদ, অহিংসা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মতো আদর্শ তিনি রাজনৈতিকভাবে চর্চা না করলেও আদর্শিকভাবে জীবনবিশ্বাস স্বরূপ পালন করেছেন। জীবনের জন্য কল্যাণকর সকল মহৎ আদর্শের সজীব ছবির অমলিন প্রতিচ্ছবি পড়েছে তাঁর যাপিত জীবনে। রাজনৈতিক সংঘাত ও হিংসার সমকালীন সময়ে তিনি শান্তি, কল্যাণ ও মৈত্রীর সারথী।
সামাজিক জীবনে প্রফেসর চৌধুরী মিষ্টভাষী, বন্ধুবৎসল, পরোপকারী। সমাজের জন্য কল্যাণচিন্তা তাঁর সার্বক্ষণিক আরাধনা, যা তিনি জ্ঞান ও শিক্ষা বিতরণ আর সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে, এবং অধুনা ইংরেজি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অবদানের দ্বারা সুচিহ্নিত করেছেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি একজন সফল পিতা। সন্তানদের দেশে-বিদেশে মর্যাদাপূর্ণ পেশাজীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি যে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন, তা অনুকরণযোগ্য। এসব ক্ষেত্রসমূহে সাফল্য সমাজে আরো অনেক মানুষই দেখান, সেটা বিশেষ কৃতিত্বের বিষয় নয়। তাঁর মূল কৃতিত্ব অধ্যাপনার পেশাগত জীবন এবং মননশীল সাহিত্য সাধনার মধ্যেই নিহিত। তথ্য হিসাবে এটা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য যে, প্রফেসর প্রাণেশকুমার চৌধুরী দেশের একজন রাষ্ট্রপতিরও শিক্ষক। দীর্ঘ অধ্যাপনাকালে তিনি বহুক্ষেত্রে বহু কীর্তিমানকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও তাঁর একজন ছাত্র এবং আমার সকল ভাই-বোনও তাঁর সরাসরি শিক্ষার্থী। সংক্ষেপে শিক্ষক হিসেবে তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়নে বলা যায়, তিনি নানা দিক থেকে আদর্শ শিক্ষক। ষাট, সত্তর ও আশির দশকের কিশোরগঞ্জে যারা বিদ্যার্থী ছিলেন, তারা অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চতর বিদ্যায়তনে সে সময় বহু আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। তারা শিক্ষকতাকে অর্থ উপার্জনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন নি। শ্রেণিকক্ষের বাইরেও যে শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের একটি সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র আছে, তাঁরা সেটা বিশেষভাবে বিশ্বাস করতেন এবং এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকাও পালন করতেন। ফলে একটি শিক্ষামুখী জনপদ হিসেবে সে সময় কিশোরগঞ্জ গড়ে উঠেছিল এবং শিক্ষার্থীরা সামাজিক ও শিক্ষাজীবনে প্রভূত উপকৃত হয়েছিল। বাণিজ্যিক বিবেচনায় বাসায় ব্যাচের-ব্যাচ ছাত্র পড়ানো বা ব্যক্তিগত উন্নতিতে মশগুল থাকা সেসব আদর্শ শিক্ষকগণের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয় নি। তাঁরা শুধুমাত্র ছাত্রদেরই শিক্ষক ছিলেন না, সামাজিক শিক্ষকও ছিলেন। আজকে, দুঃখজনক সত্য হলো, তেমন আদর্শ শিক্ষক দুর্লভ। প্রফেসর প্রাণেশকুমার চৌধুরী ক্লাসিক্যাল আদর্শ শিক্ষকের একজন, যারা সংখ্যায় ক্রমশই কমে আসছেন। সমাজের আলোকায়নের পথে এটি অবশ্যই দুঃসংবাদ। আলোর পথের যাত্রী কমে গেলে আলোকিত সমাজ পাওয়া সত্যিই কঠিন। সর্বসাম্প্রতিক সমাজ বাস্তবতায় এ কথাটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যাচ্ছে।
মননশীল-সৃজনশীল সাহিত্যচর্চা প্রফেসর প্রাণেশকুমার চৌধুরীর আরেক উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে তিনি কর্মজীবনের সূচনা থেকেই নিয়োজিত রয়েছেন। ইংরেজি, ফরাসি, রুশ সাহিত্যের আন্তর্জাতিক জানালা ও সাহিত্যতত্ত্বের নানা ক্ষেত্র উন্মোচন করেছেন তিনি। কিশোরগঞ্জের মতো দূর-মফস্বলের একটি জনপদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্যবোধ ও নান্দনিক তৃষ্ণা জাগ্রত করতে তিনি সফল হয়েছেন। প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতার বই রচনা করে তিনি শ্রেণিকক্ষের বক্তৃতার বাইরেও তাঁর সৃজনী শক্তির পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। জীবনের সপ্তম দশকেও তিনি সচল-সজীব। স্বকীয় কর্ম ও কীর্তির মাধ্যমেই তিনি কিশোরগঞ্জের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

কিশোরগঞ্জের প্রাণেশ !স্যার ড. মাহফুজ পারভেজ

আপডেট টাইম : ০৩:৫১:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ মে ২০১৫

পিকেসি নামে সমধিক পরিচিত প্রফেসর প্রাণেশ কুমার চৌধুরী উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকাল ছাড়া জীবনের বাকি সবটুকু সময়কালই কাটিয়েছেন পূর্ব ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক ভূগোলের জনপদ নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জে। নেত্রকোনার জলমগ্ন সুমৃত্তিকা তাঁর মানস গঠন করেছে আর কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যিক ভূমিতল তাঁর কর্ম ও বিকাশের পাটাতন রূপে কাজ করেছে। তাঁর জীবন ও কীর্তি ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির নান্দনিক ত্রিভূজ-বিন্যাসে সমুজ্জ্বল। শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চাকে অবলম্বন করে তিনি সমাজের জন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। ষাটের দশকে প্রফেসর চৌধুরী শিক্ষকতার উদ্দেশে যখন কিশোরগঞ্জে আসেন, তখন এ জনপদে চলছে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের জোয়ার। উত্তর-ঢাকা এবং পূর্ব ময়মনসিংহের আদি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুরুদয়াল কলেজের তখন ভরা যৌবন। উত্তর কুমিল্লার মানুষ অধ্যক্ষ ওয়াসিমুদ্দীনের নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্যমী, নিবেদিতপ্রাণ একদল তরুণ শিক্ষক জড়ো হতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে দেশের রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উপাচার্য, আমলা, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বহু কীর্তিমানের জন্ম হয় এ কলেজ ক্যাম্পাস থেকে। কলেজের শিক্ষকগণও স্থানীয় সমাজ প্রগতি, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এদের মধ্যে নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, জিয়াউদ্দীন আহমেদ, রফিকুর রহমান চৌধুরী ও প্রাণেশ কুমার চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। প্রফেসর ঘোষ স্বকীয় রচনায় বিশিষ্টতার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের প্রণোদনার ক্ষেত্রে স্মরণীয়। প্রফেসর আহমেদ নিজস্ব রচনা, সম্পাদনা, সাংবাদিকতা, সাংগঠনিক দক্ষতায় উজ্জ্বল। প্রফেসর রফিকুর রহমান চৌধুরী মূলত নিভৃতচারী গবেষক। ইংরেজি সাহিত্য ও ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে উচ্চাঙ্গের অনুবাদকর্মে তিনি পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রফেসর প্রাণেশ কুমার চৌধুরী নিজের পেশাগত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের গুণগত রূপান্তরে মনোনিবেশ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ব্যক্তিগত বা একক উদ্যোগ নিয়ে কিছু করেছেন, এমন নয়। সমগ্র গুরুকুলের অংশ হিসেবে তিনি সামষ্টিক তৎপরতায় নিয়োজিত থাকেন। পরবর্তীকালে, যখন তাঁর স্বনামধন্য সহকর্মীদের অনেকেই হয় অবসরপ্রান্ত, নয় লোকান্তরিত, তখন দেখা যায় তিনি একক ব্যক্তিসত্তায় একজন দিকনির্দেশক-অগ্রণী পুরুষ রূপে তাঁর সামাজিক, পেশাগত ও সাহিত্যিক দায় পালন করে চলেছেন। নিজস্ব কর্তব্যবোধের প্রণোদনায় তিনি তাঁর কর্মপ্রবাহে কখনোই শৈথিল্যকে স্থান দেননি। ষাট-সত্তরের উত্তাল আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং বর্তমান সমকালীনতায় তিনি তাঁর দায়িত্বসচেতন কর্মধারাকে প্রাণময় রেখেছেন। এক্ষেত্রে স্পষ্টত মনে হয়, তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ‘সিম্পল লিভিং, হাই থিঙ্কিং’ এবং পরমহংসদেব ও বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য হিসেবে ‘কর্মই ধর্ম’ তত্ত্বের নিষ্ঠাবান সাধক। তাঁর জীবনযাপনের বীজমন্ত্রও এসব উচ্চতর দার্শনিকতার মধ্যেই নিহিত। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে কাউকে স্বভাবতই আর্থসামাজিক-পেশাগত-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ইত্যাদি নানা আঙিক ও ক্ষেত্র থেকে মূল্যায়ন করা হলেই সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিসত্তার রূপ-চারিত্র্যটি উদ্ভাসিত হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় অবশ্যই তিনি একজন দলনিরপেক্ষ মানুষ। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নে তিনি বাঙালি জাতিসত্তার স্বার্থের দিশারী। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের কঠিন রণাঙ্গনকে আলিঙ্গন করতেও তিনি সামান্যতম বিলম্ব করেন নি। প্রগতি, মানবতাবাদ, অহিংসা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মতো আদর্শ তিনি রাজনৈতিকভাবে চর্চা না করলেও আদর্শিকভাবে জীবনবিশ্বাস স্বরূপ পালন করেছেন। জীবনের জন্য কল্যাণকর সকল মহৎ আদর্শের সজীব ছবির অমলিন প্রতিচ্ছবি পড়েছে তাঁর যাপিত জীবনে। রাজনৈতিক সংঘাত ও হিংসার সমকালীন সময়ে তিনি শান্তি, কল্যাণ ও মৈত্রীর সারথী।
সামাজিক জীবনে প্রফেসর চৌধুরী মিষ্টভাষী, বন্ধুবৎসল, পরোপকারী। সমাজের জন্য কল্যাণচিন্তা তাঁর সার্বক্ষণিক আরাধনা, যা তিনি জ্ঞান ও শিক্ষা বিতরণ আর সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে, এবং অধুনা ইংরেজি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অবদানের দ্বারা সুচিহ্নিত করেছেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি একজন সফল পিতা। সন্তানদের দেশে-বিদেশে মর্যাদাপূর্ণ পেশাজীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি যে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন, তা অনুকরণযোগ্য। এসব ক্ষেত্রসমূহে সাফল্য সমাজে আরো অনেক মানুষই দেখান, সেটা বিশেষ কৃতিত্বের বিষয় নয়। তাঁর মূল কৃতিত্ব অধ্যাপনার পেশাগত জীবন এবং মননশীল সাহিত্য সাধনার মধ্যেই নিহিত। তথ্য হিসাবে এটা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য যে, প্রফেসর প্রাণেশকুমার চৌধুরী দেশের একজন রাষ্ট্রপতিরও শিক্ষক। দীর্ঘ অধ্যাপনাকালে তিনি বহুক্ষেত্রে বহু কীর্তিমানকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও তাঁর একজন ছাত্র এবং আমার সকল ভাই-বোনও তাঁর সরাসরি শিক্ষার্থী। সংক্ষেপে শিক্ষক হিসেবে তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়নে বলা যায়, তিনি নানা দিক থেকে আদর্শ শিক্ষক। ষাট, সত্তর ও আশির দশকের কিশোরগঞ্জে যারা বিদ্যার্থী ছিলেন, তারা অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চতর বিদ্যায়তনে সে সময় বহু আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। তারা শিক্ষকতাকে অর্থ উপার্জনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন নি। শ্রেণিকক্ষের বাইরেও যে শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের একটি সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র আছে, তাঁরা সেটা বিশেষভাবে বিশ্বাস করতেন এবং এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকাও পালন করতেন। ফলে একটি শিক্ষামুখী জনপদ হিসেবে সে সময় কিশোরগঞ্জ গড়ে উঠেছিল এবং শিক্ষার্থীরা সামাজিক ও শিক্ষাজীবনে প্রভূত উপকৃত হয়েছিল। বাণিজ্যিক বিবেচনায় বাসায় ব্যাচের-ব্যাচ ছাত্র পড়ানো বা ব্যক্তিগত উন্নতিতে মশগুল থাকা সেসব আদর্শ শিক্ষকগণের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয় নি। তাঁরা শুধুমাত্র ছাত্রদেরই শিক্ষক ছিলেন না, সামাজিক শিক্ষকও ছিলেন। আজকে, দুঃখজনক সত্য হলো, তেমন আদর্শ শিক্ষক দুর্লভ। প্রফেসর প্রাণেশকুমার চৌধুরী ক্লাসিক্যাল আদর্শ শিক্ষকের একজন, যারা সংখ্যায় ক্রমশই কমে আসছেন। সমাজের আলোকায়নের পথে এটি অবশ্যই দুঃসংবাদ। আলোর পথের যাত্রী কমে গেলে আলোকিত সমাজ পাওয়া সত্যিই কঠিন। সর্বসাম্প্রতিক সমাজ বাস্তবতায় এ কথাটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যাচ্ছে।
মননশীল-সৃজনশীল সাহিত্যচর্চা প্রফেসর প্রাণেশকুমার চৌধুরীর আরেক উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে তিনি কর্মজীবনের সূচনা থেকেই নিয়োজিত রয়েছেন। ইংরেজি, ফরাসি, রুশ সাহিত্যের আন্তর্জাতিক জানালা ও সাহিত্যতত্ত্বের নানা ক্ষেত্র উন্মোচন করেছেন তিনি। কিশোরগঞ্জের মতো দূর-মফস্বলের একটি জনপদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্যবোধ ও নান্দনিক তৃষ্ণা জাগ্রত করতে তিনি সফল হয়েছেন। প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতার বই রচনা করে তিনি শ্রেণিকক্ষের বক্তৃতার বাইরেও তাঁর সৃজনী শক্তির পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। জীবনের সপ্তম দশকেও তিনি সচল-সজীব। স্বকীয় কর্ম ও কীর্তির মাধ্যমেই তিনি কিশোরগঞ্জের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।