বাড়তি জনসংখ্যার চাপ, ব্যাপক হারে বন উজাড়, বন্যপ্রাণী শিকার, নদীর নাব্যতা হ্রাস, ভারসাম্যহীন পরিবেশ, অবহেলা ও অযত্নের কারণেই বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে নানা প্রজাতির প্রাণী। হারিয়ে যাচ্ছে নানা জাতের গাছ ও মাছ।
পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে একটা সময় জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে পড়বে দেশ। এতে দেখা দিতে পারে বিশাল প্রাকৃতিক শূন্যতা। আইইউসিএনের বন্যপ্রাণীবিদ ও গবেষকদের মতে, সংরক্ষণ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে মোট বন্যপ্রজাতির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আগামী কয়েক বছরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
তাদের মতে, বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যে হাজারখানেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী টিকে আছে; পরিবর্তিত পরিবেশে তারাও বিপন্ন। অর্ধেক প্রজাতিই এখন কোনো না কোনো হুমকির সম্মুখীন।
নানা কারণ, বিশেষত খাবারের চাহিদাসহ বিভিন্ন উপলক্ষে যথেচ্ছ শিকারের ফলে অনেক প্রাণীই আজ বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যে প্রথমেই যার কথা আসে সেটা হলো গ্রিজলি ভালুক, মেক্সিকোর সিয়েরা মাদ্রে থেকে শুরু করে কানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে কিছুদিন আগেও এদের বিপুল সংখ্যায় দেখা মিলত। কিন্তু বর্তমানে মাত্র কয়েকশ অবশিষ্ট আছে। নুবিয়া মরুভূমির বুনো গাধা, উত্তর-পূর্ব সুদানে বিপুল সংখ্যায় দেখা মিলত এদের। এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। দুর্ভিক্ষপীড়িত ওই অঞ্চলে মূলত খাবারের প্রয়োজনে এদের মেরে শেষ করে ফেলা হয়েছে।
ব্রান্ডেরস সেয়োম্প হরিণ— বর্তমানে শুধু ভারতের মধ্য প্রদেশের কানহা অভয়ারণ্যে কোনোমতে টিকে আছে। সংখ্যায় দু-একশর বেশি হবে না। সোমালি বুনো গাধা— ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ায় এদের প্রচুর পরিমাণে দেখা পাওয়া যেত। এদের নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কুসংস্কার ছিল যে, এদের চর্বি হচ্ছে যক্ষ্মার ওষুধ। আর যায় কোথায়? কাজেই চলেছিল ব্যাপক হত্যা। এছাড়া পানির অভাবেও মারা গেছে এসব বুনো গাধা । বর্তমানে অল্প কয়েকশ অবশিষ্ট আছে।
ম্যাকলিনস হরিণ— তিব্বতের মালভূমিতে এরা চরে বেড়াত হাজারে হাজারে। আজ এ প্রাণী বিলুপ্তির পথে। ড্যাম্পিং হরিণ— ভারতের মনিপুরে পাওয়া যেত। মূলত মাংসের প্রয়োজনে এদের ব্যাপক হারে শিকার করা হয়েছে। পশ্চিমা ট্রাগোপান বা মতিলাল পাখি; আগে এদের ভারতে দেখা যেত। আজকাল আর তেমন দেখা যায় না। কিট শিয়াল— কানাডার দক্ষিণ-পশ্চিম সাসকাচিউয়ান প্রদেশের সাইপ্রাস পাহাড়ে এককালে প্রচুর পাওয়া যেত। বর্তমানে দেখাই যায় না এদের।
মূলত চামড়ার লোভে মেরে শেষ করে ফেলা হয়েছে এদের। লিমিয়েন শিয়াল, ইথিওপিয়ার সিমিয়েন পার্বত্যাঞ্চলে পাওয়া যেত। এখন আর দেখা যায় না। স্যান জোয়াকিন শিয়াল, উত্তর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় দু-একটার দেখা মেলে আজো। এরাও মূলত দামি চামড়ার কারণেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। সোনালি সিংহমুখো মারমসেট বানর। ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলে পাওয়া যায়। কলা আর আখক্ষেতে হামলা চালাত বলে মেরে মেরে শেষ করে আনা হয়েছে। আর বড়জোর শ’পাঁচেক জীবিত আছে ওরা।
রোমশ মাকড়সা বানর, এদেরকেও দক্ষিণ ব্রাজিলে দেখা যেত। এরাও ফসলের ক্ষতি করত বলে মেরে মেরে এদেরও শেষ করে আনা হয়েছে। অতিকায় ভোঁদড়— দক্ষিণ আমেরিকার পেরু, ব্রাজিল, কলাম্বিয়ায় দেখা মেলে আজো। তবে শেষ হয়ে এসেছে। মরেছে দামি চামড়ার অধিকারী বলে। বল্গা হরিণ— রাশিয়া ও ফিনল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় এরা একসময় হাজারে হাজারে চরে বেড়াত। মূলত গোশতের চাহিদা পূরণের জন্যই মারা হয়েছে এদের।
সামান্য সংখ্যকই অবশিষ্ট আছে। জাভা ও সুমাত্রার গণ্ডার— চামড়া ও ওষুধের (ভুল বিশ্বাস) প্রয়োজনে খড়গ, পায়ের নখ, রক্ত ইত্যাদির জন্য এদের মারা হয়েছে। সব মিলিয়ে কয়েকশ মাত্র অবশিষ্ট আছে। আফ্রিকান গণ্ডার— সুদান, উগান্ডা ও কঙ্গোতে পাওয়া যায়। বর্তমানে সামান্যই অবশিষ্ট আছে। জাপানের টাকসিমা দ্বীপের সি-লায়ন— এরা মূলত এক জাতের সিল। কোরিয়ার যুদ্ধের সময়ে এবং পরে উদ্বাস্তুদের গোশতের প্রয়োজনে শেষ হয়েছে। দু-একটাকে দেখা যায় আজো। ক্যারিবিয়ান মংকসিল; চর্বির জন্য এদের মারা হয়েছে। বর্তমানে অল্প কয়েকটাই বেঁচে আছে। নীলতিমি, বর্তমানে কয়েক হাজার বেঁচে আছে। তবে পেশাদার শিকারিদের হাতে পড়ে এরাও বিপন্নদের তালিকায়।
এভাবে যদি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে শিকারিদের হামলায় ও মানুষের বাসস্থানের কারণে বন উজাড় হয়, তাহলে পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন ও নানা বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই বাস্তবায়ন দরকার সঠিক আইন প্রয়োগের আর জনসচেতনতার।
লেখক: নিবন্ধকার