অভিযুক্ত ধর্ষক সাহসীই বটে!

রফিকুল ইসলামঃ তুমি কি ভালো মানুষের ঘরে জন্ম সাহস থাকলে ফোনটা রিসিভ করো তোর ঘরে কি মা বোন নাই একজনের ইজ্জত নিয়ে খেলাধুলা করস দাড়ি রাইখা হুজুর সাজাও শালা রাজাকারের বাচ্চা’

পত্রিকায় লেখার কারণে আমার মুঠোফোনে গত ১৫ জুলাই সকাল ০৮:৫২:৪৭ টায় উপরিউক্ত ক্ষুদে বার্তাটি পাঠান অভিযুক্ত ধর্ষক। তিনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে বর্তমানে ঢাকায় ডিএমপি পিওএম-দক্ষিণ বিভাগে (কং-১০২০১) কর্মরত আছেন।

ভিকটিম ষোড়শী মোছা. লিজা আক্তারের দায়ের করা ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী/০৩) এর ৯(১) ধারায় কিশোরগঞ্জ জজ কোর্টে ১নং ট্রাইব্যুনালে ৭৬/২০২১ নং মোকদ্দমার একমাত্র আসামি তিনি। পিতা- মো. রইছ মিয়া, গ্রাম- মামুদপুর, ইউনিয়ন ঢাকী, উপজেলা- মিঠামইন, জেলা- কিশোরগঞ্জ।

যৌন নিপীড়নের এ ঘটনাটি ঘটে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নের নতুন বগাদিয়া গ্রামের নিভৃত এক পল্লীতে। বিয়ের অ্যাঙ্গেজমেন্টের আংটি পরোয়া কনস্টেবল রুবেল হবু স্ত্রীকে ধর্ষণের নজিরবিহীন এ ঘটনা হাওরের সমাজব্যবস্থাকে অরক্ষিত ও শঙ্কিত করে তুলেছে। গুরুত্ববিচারে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) মামলাটি দু’দফা তদন্ত করেছে।

মৃত্যুদন্দের বিধান থাকা সত্ত্বেও দেশে যৌন ও নারী সহিংসতা থামছে না। প্রত্যেকটা পেশায় এখন নৈতিকতা-মূল্যবোধের ধস নেমেছে। মনুষ্য মনন থেকে বিবেক যেন উধাও! ধর্ষিতারও তাই বিস্ময়ের শেষ নেই, ধর্ষক পুলিশ রুবেল মানুষ কি না! ধর্ষিতার মতে, গৌরবোজ্জ্বল পুলিশ বাহিনীর এই সদস্য পুরুষ হয়ে থাকতে পারেনি, ধর্ষক হয়েছে। বিবেক হারালে মানুষের থাকেইবা কি?

এ যৌন নিগৃহীতা তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে বলেছেন, এতকাল জেনে আসছি পুরুষের তো কত মধুর পরিচয় রয়েছে — বাবা, ভাই, চাচা, মামা। আবার কারো বন্ধু, কারো প্রেমিক, কারোবা স্বামী। কিন্তু সেই পুরুষই কিনা হয়ে উঠছে কারো কারোর জন্য ধর্ষক, যা খুনের চাইতেও নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য। খুন মানে মানুষটি আর থাকল না। আর ধর্ষণ মানে মানুষটি থাকল, আরো আরো ধর্ষিতা হবার জন্য এবং সেটা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও; সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর জন্য। এই ধর্ষিতা দুঃখে, অপমানে, লজ্জায় ও মনোকষ্টে এ অপাঙক্তেয় জীবন না রাখতে মাটিকে বারবার মিনতি করছে দুভাগ হয়ে তাকে ফিরিয়ে নিতে।

ধর্ষিতার এই অসহায়ত্ববোধ মনে করিয়ে দেয় রামায়ণের সেই বিখ্যাত বাগধারাটির কথা, যা বাংলায় এসেছে — ‘হে ধরণী, দ্বিধা হও!’

রাবণের কাছ থেকে প্রিয়তমা পত্নীকে উদ্ধার করে আনার পর সীতার সাথে সুখের সংসার করে রাম। কিন্তু সেই সুখ স্থায়ী হলো না। কেননা, অযোধ্যায় সীতাকে নিয়ে নানান কুৎসা ছড়াতে শুরু করে। ক্ষিপ্ত প্রজারা দাবি করেন, সীতাকে তার সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হবে। রামও এখানে সীতাকে কোনো সহায়তা না করে প্রায় বিনা বাক্যে প্রজাদের দাবিই বরং মেনে নিলেন। তাতে অপমানে, লজ্জায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় সীতা মাটিকে বলেন তাকে ফিরিয়ে নিতে। পৃথিবী দুভাগ হয়ে সীতাকে ফিরিয়ে নিলো। সেই থেকে ‘হে ধরণী, দ্বিধা হও’ বাংলায় অপমানসংক্রান্ত লজ্জার প্রতিশব্দে পরিণত হয়।

মাসল, ম্যান, মানি — এই তিন ম’তে বিক্ষত নারী। অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। একটি সুন্দর জীবনযাপনে এক ‘ম’ এর অভাব হলেই জীবনের স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আজ আমাদের নারীরা এই তিন ‘ম’ এর পৈশাচিকীতে পিষ্ট। নারী মানে সদ্য জন্ম নেয়া পুংলিঙ্গের বিপরীত স্ত্রী লিঙ্গের অধিকারী মানবশিশু থেকে সাত সন্তানের জননী, কেউ বাদ পড়ছে না এ অনিয়ন্ত্রিত দংশিত যৌনাচার থেকে।

এটি বিহ্যাভিয়ার ডিজিজ বা আচরণবাহিত রোগ। আদর্শবিচ্যুতি। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, নৈতিক অবক্ষয়ই সামাজিক ব্যাধি। প্রমথ চৌধুরীও বই পড়া প্রবন্ধে বলেছেন- ‘ব্যাধিই সংক্রমণ, স্বাস্থ্য নয়।’

তা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মোক্ষম প্রতিবিধান হতে পারে যৌন শিক্ষায় নৈতিকতা বিষয়ক বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ভিডিও বক্তব্যশিরোনাম- ‘শিশুকে গুড টাচ এবং ব্যাড টাচ শেখান’। সেসঙ্গে সন্তানকে পঙ্কিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে যে লেসনও অত্যাবশ্যকীয়, তা হলো–‘হেলথ্ এডুকেশন এবং সেক্স এডুকেশন’।

এ ব্যাপারে যৌন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌন ধারণার অভাবে অনেক শিশু ও কিশোর-কিশোরীরাই জানে না সে পারিবারিক যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। তাছাড়া মা-বাবার যৌন অসাবধানতাও সন্তানদের দিকভ্রান্ত করছে। এক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, ‘অপরাধীরা তাদের ধর্মীয়, নৈতিক, পারিবারিক ও জীবনঘনিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব রয়েছে।’

প্রতিমন্ত্রী জুনাইদের বক্তব্যটি হতে পারে ‘ফাইনাল টাচ’। কোনো সমাজে যৌন ও নারী সহিংসতার উপস্থিতি নি:সন্দেহে সেই সমাজের মানব উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত শুধু নয়, অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সমস্যার চেয়েও অধিক গুরুতর সমস্যা। সেজন্যই মূল্যবোধ পরিপন্থী কোনো কার্যক্রম সমাজে গৃহীত হয় না। যে কারণে মানবজাতি মহাবিপর্যয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অন্বেষণ করে।

পুলিশী বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। যৌন নিপীড়নরোধে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। যৌনতা থাকবে কিন্তু হিংস্রতা ও অবাধ নয়। যৌন সহিংসতা বর্বরতার কুৎসিত রূপ। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতার সংকীর্ণতা যৌনতায় হিংস্ররূপ পেয়েছে। বিবাহবহির্ভূত যেকোন যৌন-সংযোগই অনৈতিক। নৈতিকতা যৌনতার রক্ষাকবচ।

ধর্ষণ হিংস্রতা এমনই একটা বিকৃত যৌনক্ষুধা ও নৈতিক বিপর্যয় যে– আদর্শ পরিবার, কল্যাণরাষ্ট্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রীতিমূলক সমাজব্যবস্থা, মন্দের ওপর কল্যাণ ও দুষ্টের ওপর শিষ্টের বিজয়চিহ্ন নিশ্চিত করতে জীবনাচরণে নৈতিক চরিত্রে বিকাশ সাধনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ছাড়া শুধু আইন আর শাসন দিয়ে সম্পূর্ণ শোধরানো সম্ভব নয়।

মানবজাতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তিনটি– রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার। এর মধ্যে রাষ্ট্র এগিয়ে এসে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলেও সংকটের স্থায়ী সমাধানে সমভাবে এগিয়ে আসতে হবে সমাজ ও পরিবারকেও, যা প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ ও পুলিশী বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে।

যেকোনো সমস্যার সমাধানে কেবল বিচার নয়, কঠিন সাজা দেয়াও নয়; সমস্যাটি যাতে সমাজে উৎপত্তি না হয় তার পদক্ষেপ নেয়া অধিক জরুরি। এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। চিরস্থায়ী এই সামাজিক সংগঠন থেকেই মানবজাতির বিকাশ লাভ হয়েছে। শিশুকে উপযুক্ত সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রাথমিক কেন্দ্রবিন্দু হলো সুগঠিত পরিবার, যা সমাজ জীবনের ভিত্তিস্বরুপ।

প্রতিটি শিশু একটি জীবন্ত সত্তা। পারিবারিক পরিবেশে শিশুরা মৌলিক শিক্ষা লাভ করে থাকে। এক্ষেত্রে যৌনতা অতি স্পর্শকাতর বিষয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ, শিষ্টাচার ও শালীনতাসহ নারীর মর্যাদা ও অধিকার চিত্ত জাগরূকের মোক্ষম ক্ষেত্র কিন্তু পরিবারই।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, জন্মের সময় বহু কোষবিশিষ্ট মাংসপিন্ডে মস্তিষ্কে পরিচালিত অনেকটা বংশগত গুণাগুণ নিয়ে পৃথিবীতে আসে শিশু। পরবর্তীতে পরিবেশের প্রভাবে প্রভান্বিত হয়ে ভবিষ্যতের কর্মসূচি নির্বাচিত করে। চেতন, অবচেতন ও অচেতন মনে পরিবেশের স্থায়ী প্রভাব তার জীবনে রয়ে যায়। এ মূল পরিবেশকে কেন্দ্র করে পারিপার্শ্বিকতার পটভূতিতে যে শিশু তাল সামলাতে পারে না, সেই শিশু কালক্রমে পঙ্কিলতায় পা বাড়ায়। অপরাধে ঝুঁকে। এছাড়া বিবাহিত নর-নারীর পরাসক্ততা পরিবারে বাচ্চাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিকারগ্রস্ত করে তুলে।

সর্বোপরি মানুষ প্রকৃতিগতভাবে ষড় রিপুর দ্বারা আক্রান্ত। অর্থাৎ মানবচরিত্রের প্রবৃত্তি ছয়টি– কাম বা যৌনক্ষুধা, রাগ, লোভ, মোহ, মদ বা দম্ভ ও মাৎসর্য বা পরশ্রীকাতরতা। এ প্রবৃত্তিগুলো মানবের জ্ঞান ও বিবেককে বাধাগ্রস্ত করে বলে তা রিপু তথা শত্রু নামে পরিচিত। অন্যদিকে মানবদেহে ১৪টি ইন্দ্রিয় রয়েছে– চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক বা দেহকোষ, বাক বা কথা, হাত, পা, পায়ু বা মলদ্বার, উপস্থ বা জননেন্দ্রিয় মন, বুদ্ধি বা জ্ঞান, অহংকার, আত্মা বা চিত্ত। দেহের এই ১৪টি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও প্রাণশক্তি, যা দিয়ে বাহ্য বা বাইরের বিষয়ের জ্ঞান অনুভূতি উপলব্ধি হয়।

রিপুদমনই আত্মসংযম। এই প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয়ের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সভ্য ও উন্নতর জীবন দেয়। প্রকৃত শিক্ষা পশুকে মানুষ হিসেবে দাঁড় করায়। অন্যদিকে এসব প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয় প্রভাবান্বিতের অপার দৈবযোগে মনুষ্যত্ববোধ লোপ পায়। দিকভ্রান্তিতে যৌনতার যথেচ্ছাচার ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে পশুরও অধম করে দেয়। নিমজ্জিত করে অধঃপতনের অতল তলে।

মানুষও কিন্তু প্রাণি। তবে মানবীয় গুণাবলি বিদ্যমান থাকায় মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। জন্তু ও মানুষের  মধ্যে স্বভাব ও প্রকৃতিগত পার্থক্য বিদ্যমান। জন্তুর সব স্বভাব বিরাজমান মানুষের মধ্যেও। যেমন: হিংসা, বিদ্বেষ, পাশবিকতা, হিংস্রতা, লোলুপতা ইত্যাদি। তবে প্রীতি, মমত্ব, সুস্বভাব, সচ্চরিত্র, বিবেক, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ — এসব গুণাবলির জন্য মানুষ জন্তু থেকে পৃথক। মানুষের মধ্যে মানব সমাজের যে উত্তরণ আছে, জন্তুর মধ্যে তা নেই। সেই স্বভাব বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে বংশগত, পরিবেশগত ও শিক্ষার ওপর। তবে মনোজগতের অধিবাস বন্যের মধ্যে হলে ব্যক্তি কেবল নয়, মানবসমাজও পায় বুনো রূপ।

নতুন ও আগামী প্রজন্ম সুস্থ মস্তিষ্কে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে শিশুকে ‘গুড টাচ ও ব্যাড টাচ’ শেখানোর পাশাপাশি সন্তানকে ‘হেলথ্ এডুকেশন ও সেক্স এডুকেশন এবং বড়দের ক্ষেত্রে আত্মশুদ্ধিও হতে পারে ভেরি মাচ।

এই দুর্দিনে মানুষের ভরসা তো নিজের আত্মোপলব্ধি। তার আত্মবিশ্লেষণ। সেই আত্মজিজ্ঞাসার চিরায়ত কথক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণীতে আহ্বান তাই– ‘মানুষ ফিরুক মানুষের জগতে…’ #

 লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর