চার বছর আগে সাকিব আল হাসানের চোখের জলে ভেসেছিল গোটা বাংলাদেশ। চার বছর পর সেই অশ্রু মুছে দিলেন সৌম্যরা। সেই এশিয়া কাপ, সেই মিরপুর, সেই মাহমুদউল্লাহ, সেই অগ্নিঝরা মার্চ। এবার শোনা গেল বাঘের গর্জন। পরাভূত পাকিস্তান। স্বপ্নের ফাইনালে বাংলাদেশ। আহা, কী সুন্দর আগুনঝরা ফাল্গুন। শিমুল, পলাশ ফোটার দিনে বিজয়ের রেণু উড়ল।
২০১২ ফিরে এলো ২০১৬ তে। চার বছর আগে এক ফাইনালে আশাভঙ্গের অশ্রু ঝরেছিল দুই রানের পরাজয়ে। আরেক মার্চে বাংলাদেশ আবারও ফাইনালে। প্রতিশোধের আগুনে পাকিস্তানকে ছারখার করে এবার শেষ মহারণে ভারতের মুখোমুখি। বুধবার এশিয়া কাপের অষ্টম ম্যাচে স্বাগতিক বাংলাদেশ পাঁচ উইকেটে পাকিস্তানকে হারিয়ে এই মহাদেশীয় আসরে দ্বিতীয়বার ফাইনালে চলে গেল। কাল মিরপুর হয়ে উঠেছিল লাল-সবুজ উদ্যান। থরে থরে কেঁপে উঠেছে গ্যালারি যৌবন গর্জনে। প্রথমে বল হাতে আল-আমিন ও আরাফাত সানি পাঁচ উইকেট ভাগাভাগি করে নিলে পাকিস্তান ২০ ওভারে সাত উইকেটে ১২৯ রানে আটকে যায়। একটি করে উইকেট নেন দুই পেসার তাসকিন আহমেদ ও মাশরাফি মুর্তজা।
দ্বিতীয় ওভারেই উইকেট হারানোর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের শুরু। পাঁচ ওভারের মধ্যে তারা তিন উইকেট হারায় মাত্র ১৮ রানে। সরফরাজ আহমেদের ৪২ বলে অপরাজিত ৫৮ এবং শোয়েব মালিকের ৩০ বলে ৪১ রানে তারা ১২৯-এ পৌঁছে।
১৩০ তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশ ভালোই শুরু করে। দ্বিতীয় ওভারে ওপেনার তামিম ইকবালকে (৭) হারালেও সৌম্য ও সাব্বির টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন দলকে। ফর্মে থাকা সাব্বির রহমান ১৫ বলে ১৪ রান করে আফ্রিদির শিকার হন। আর সৌম্য হাফ সেঞ্চুরি থেকে দুই রান দূরে আউট হন। পরের ওভারে মুশফিকুর রহিমও (১২) বিদায় নেন। বাংলাদেশ তখন ৪/৮৮। এরপর হাল ধরেন সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ। সাকিব ১৩ বলে আট রান করে মোহাম্মদ আমিরের বলে বোল্ড হন। মাশরাফি ওই ওভারে আমিরকে পরপর দুটি চার মারলে শেষ ১২ বলে বাংলাদেশের প্রয়োজন হয় ১৮ রান। শেষ ছয় বলে তিন রান। আনোয়ার আলীকে প্রথম বলেই চার মেরে মাহমুদউল্লাহ পাঁচ উইকেটে জেতালেন বাংলাদেশকে। এবার ফাইনাল। এবার ভারত। রোববার মিরপুর আবার লাল-সবুজের গর্জনে প্রকম্পিত হবে।
শেষ ওভারে জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল তিন রান। আনোয়ার আলীকে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে চার মেরে মাহমুদউল্লাহ উড়লেন মিরপুরে। ৩০ হাজার দর্শকের গগনবিদারী চিৎকারের মাাঝে মাঠে লুটোপুটি খেয়ে আরেকটি ফাইনালে ওঠার উৎসব করে নিলেন মাশরাফি-মাহমুদউল্লাহরা। ২০১২ সালে ফাইনালে হারের হতাশা এবার সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে ভুলল স্বাগতিকরা। সাকিব ড্রেসিংরুম থেকে ছুটে মাঠে এলেন এক গাল হাসি নিয়ে। এদিন প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে বাংলাদেশের ফাইনালে ওঠার সাক্ষী হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জ্বলে উঠলেন সৌম্য সরকার। তামিম ইকবাল দলে ফিরেই কী তাহলে সৌম্যর ব্যাটিংয়ে ধার ফিরিয়ে আনলেন। ১৩০ রানের লক্ষ্যট প্রথম ওভারেই আট রান তুলে সহজ করার ইঙ্গিত দেন তামিম। পরের ওভারে তামিম আউট হয়ে ফেরেন মোহাম্মদ ইরফানের বলে এলবিডব্লু হয়ে। বাংলাদেশের তবুও ভালো শুরু বলা যায়। সৌম্য সরকারের ব্যাটে প্রাণ ফিরে এলো। সেরা টি ২০ ব্যাটসম্যান সাব্বির রহমানকে নিয়ে দ্বিতীয় উইকেটে ৩৩ রান তুলে ফেলেন সৌম্য। আগের ম্যাচে ৮০ করা সাব্বির এদিন আউট হয়েছেন মাত্র ১৪ রানে। বাংলাদেশ চাপে রয়েছে, এমনটি মনে হয়েছে কিছুক্ষণের জন্য, যখন সৌম্য ও মুশফিকুর পাঁচ রানের ব্যবধানে আউট হয়ে ফেরেন। ৮৮ রানে তখন বাংলাদেশের চার উইকেট। সৌম্য ফেরেন টি ২০-তে ক্যারিয়ারসেরা ৪৮ বলে ৪৮ রান করে। এরপর সাকিব স্কুপ শট খেলতে গিয়ে আমিরের বলে বোল্ড হন। রাগে-ক্ষোভে সাকিব উইকেটে ব্যাট দিয়ে আঘাত করেন। রাগটা যে নিজের বাজে শট খেলার জন্য সেটাও হাত উঁচু করে বুঝিয়ে দেন আম্পায়ারকে। পরের দুটি বলেই মাশরাফির বীরোচিত দুটি চারে আবার উত্তাল গ্যালারি। উৎসবের অপেক্ষা শুরু তখন থেকেই। শেষ দুই ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ১৮ রান। মোহাম্মদ সামির দুটি নো বল ও একটি চার ছোট করে ফেলে লক্ষ্য। শেষ ওভারে দরকার ছিল তিন। ২০১২ সালের ব্যর্থতার সাক্ষী হওয়া মাহমুদউল্লাহ আনোয়ার আলীকে প্রথম বলে চার মেরে জয় নিশ্চিত করেন। নতুন ইতিহাসের পথে পা বাড়ায় টাইগাররা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্রিকেট প্রেম সবার জানা। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ যে তিনি দেখতে যাবেন সেটা দুপুরের পরই স্টেডিয়ামের সবাই বুঝেছিলেন। আইনশৃংখলা বাহিনী পুরো স্টেডিয়াম নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে ফেলে। বাংলাদেশের সমর্থকরা আগে থেকে জয় ধরে নিয়েই এই ম্যাচ দেখার জন্য উত্তাল হয়ে ওঠে। টিকিটের দাম ছিল আকাশচুম্বি। ১৫০ টাকার টিকিট বিক্রি হয় ১৫০০ টাকারও বেশি দামে। এরআগে টসে হেরে ফিল্ডিং করে দুর্দান্ত বোলিংয়ের আরেকটি ধারাবাহিকতার পরিচয় দিলেন তাসকিন ও আল-আমিনরা। পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের দীর্ঘসময় থিতু হতে দেননি স্বাগতিক বোলাররা। ফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ের আফ্রিদিদের মাত্র ১২৯ রানে বেঁধে ফেলে টাইগাররা। শেষ পাঁচ ওভারে ৫১ রানের সুবাদে সাত উইকেটে এই রান করে তারা।
মিরপুরের উইকেটে সবুজ ঘাস, পেসারদের রাজত্ব ছিল। এদিন উইকেট বদলে গেল। উইকেটে ঘাস নেই। শুকনো দেখে মনে হয়েছিল স্পিনারদের জন্য তৈরি বুঝি। মুস্তাফিজুর রহমান ইনজুরির কারণে নেই। তার জায়গায় একাদশে ফিরেছেন আরাফাত সানি। তামিম ফিরেছেন নুরুল হাসান সোহানের জায়গায়। আফ্রিদি টস জিতে ব্যাট নেয়ার পর মাশরাফি মুর্তজা বলেন, ‘আমিও টস জিতলে ব্যাটিংই নিতাম।’ ফিল্ডিংয়ে আক্রমণাত্মক ছিল বাংলাদেশ। তাসকিন শুরুটা করেন অসাধারণ। প্রথম বলেই খুররুম মনজুরকে দারুণ বাউন্স দিয়ে ভড়কে দেন। এরপর শট বল, বাউন্স দিয়ে মাত্র এক রান দেন প্রথম ওভারে। বোলিংয়ে এসে প্রথম ওভারেই উইকেট পাওয়া নিয়ম বানিয়ে ফেলেছেন আল-আমিন হোসেন। এদিনও প্রথম বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ বানিয়ে ফিরিয়ে দিলেন খুররুমকে। তাসকিন পরের ওভারটা দিয়েছেন মেডেন। এরপর আরাফাত সানি ও মাশরাফি এসে একটি করে উইকেট তুলে নেন। ১০ ওভার শেষে চার উইকেট হারিয়ে পাকিস্তানের রান তখন ৩৪! তখন মনে হয়েছিল, পাকিস্তানকে ১০০-র মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব। সরফরাজ আহমেদ ও শোয়েব মালিক সেটি হতে দেননি ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাট করে। পাকিস্তান শেষ পাঁচ ওভারে নিয়েছে ৫০ রান।
মালিক ৩০ বলে পাঁচ চার ও এক ছয়ে ৪২ রান করে আউট হন। আফ্রিদিকে শূন্য রানে ফেরান ডেথ ওভারের সেরা বোলার আল-আমিন। সরফরাজকে আউট করতে পারেনি বাংলাদেশ। ৪২ বলে পাঁচ চার ও দুই ছয়ে অপরাজিত ৫৮ করেন তিনি। তার ব্যাটেই শেষ পর্যন্ত সাত উইকেটে ১২৯ রানের লড়াইয়ের পুঁজি পায় পাকিস্তান। কালও তিনটি উইকেট নিয়ে সেরা বোলার আল-আমিন। টুর্নামেন্টে চার ম্যাচে আল-আমিন তিনবার তিনটি করে উইকেট নিয়েছেন। এদিন দুটি উইকেট নেন আরাফাত সানি, একটি করে তাসকিন ও মাশরাফি।
সংবাদ শিরোনাম
স্বপ্নের বাংলাদেশ ফাইনালে
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ০৯:৪২:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ ২০১৬
- ২৪৩ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ