করোনার সংক্রমণের ওঠানামা অনিশ্চয়তার মধ্যে শিক্ষা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ করোনা পরিস্থিতিতে থমকে আছে শিক্ষা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা। ১৫ মাসের ছুটিতে সরাসরি পাঠদান হয়নি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। নেওয়া যায়নি কোনো পাবলিক ও অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা। অনলাইন ও দূরশিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার এবং অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মধ্যে রাখার চেষ্টা করছে সরকার।

এরপরও সরাসরি পাঠদান ও আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের অভাবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের শিখন-ঘাটতি। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর সেই ঘাটতি পূরণে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে সেই পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত করা হয়নি।

এদিকে এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ব্যাপারে সরকার আরও অপেক্ষা করতে চাচ্ছে। এখন পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ন্যূনতম ৬০দিন আর এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ৮৪ দিন ক্লাস করিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

২০২২ সালের এই দুটি পরীক্ষার্থীদের ব্যাপারে ইতোমধ্যে বিকল্প পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পরীক্ষার বিকল্প হিসাবে মূল্যায়নের ব্যবস্থা রেখে তাদের দেওয়া হয়েছে অ্যাসাইনমেন্ট। পরীক্ষা নিতে না পারলে অ্যাসাইনমেন্টের ওপরে ২৫ শতাংশ জোর দিয়ে ফল দেওয়া হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

শিক্ষার পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সচিব মো. মাহবুব হোসেন রোববার যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো পরিকল্পনা করা হয় বাস্তবায়নের জন্য। আর শিক্ষা কার্যক্রমের পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণরূপে ক্লাস কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

কবে নাগাদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা যাবে সেটা কেউই বলতে পারছেন না। এমন অনিশ্চয়তার কারণে কোনো পরিকল্পনাও তৈরি করা যাচ্ছে না। তবে এই পরিস্থিতির মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম যতটা পরিমাণে স্বাভাবিক রাখা যায় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, যদিও সবকিছুতেই অনিশ্চয়তা আছে, এরপরও আমরা একটা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা (রিকভারি প্ল্যান) করছি। এ ব্যাপারে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিক (নেপ) কাজ করছে।

সর্বশেষ ২৫ মে সংবাদ সম্মেলনে আসেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কাজ সংক্রান্ত পরিকল্পনার কথা তিনি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ১৩ জুন খুলে দেওয়া সম্ভব হলে প্রথমে কেবল ৬ দিনই স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় যাবে এ বছর ও আগামী বছরের এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরা।

এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ৬০ এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ৮৪ কর্মদিবস ক্লাস হবে। ক্লাস যেদিন শেষ হবে তারপর দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে নেওয়া হবে পরীক্ষা। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে একদিন করে ক্লাসে যাবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী পরে দিনের সংখ্যা বাড়বে।

এই একই পন্থা প্রাথমিক স্তরের চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে বলে জানান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তবে পিইসি পরীক্ষার্থীরা ৬ দিনই স্কুলে যাবে। এই পরিকল্পনা সরকারের এখনো আছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্ত্রী যেটা প্রকাশ করেছেন সেটা ক্লাস করার পরিকল্পনা। কিন্তু ক্লাসে কী পড়ানো হবে সেটা নির্ধারণ করতে হবে- শিক্ষার্থীরা কতটুকু পড়তে পেরেছে আর কী ঘাটতি আছে সেটির ওপরে বিবেচনায় রেখে। কিন্তু পরিকল্পনাটি এখনো করা হয়নি। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে অনেকটাই উদ্দেশ্যহীন চলবে পাঠদান।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এ বছরের জানুয়ারিতে ক্লাস শুরুর লক্ষ্য রেখে গত বছরের শেষে আমরা একটি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলায় সেটি এখন অকার্যকর হয়ে গেছে।

আর এখন যেভাবে ছুটি বেড়ে যাচ্ছে তাতে কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসবে না। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার শিক্ষার্থীদের ঘাটতি মূল্যায়ন করে সেটা অনুযায়ী পরিকল্পনা করলে ভালো হবে। কেননা, বিকল্প পাঠদানে কতটুকু শিখেছে আর কী ঘাটতি রয়ে গেছে দেড় বছরে, তা পরিমাপ না করে পরিকল্পনা করা হলে সেটা শিক্ষার্থীদের জন্য উপকারী হবে না।

তিনি আরও বলেন, পরপর দুটি শিক্ষাবর্ষে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম না চলায় ঘাটতি পূরণ একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই ঘাটতি কেবল একটি শিক্ষাবর্ষে পূরণ করা সম্ভব হবে না। এজন্য হয়তো ২ থেকে ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে হয়তো এ বছর বিদ্যমান পাঠ্যবই শেষ করা হবে।

ঘাটতি পূরণের কাজ আগামী বছর (২০২২) শুরু করা হবে। আর এ ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাই থাকবে মুখ্য। কেননা, প্রতিটি ক্লাসের আগের প্রয়োজনীয় ঘাটতি পাঠ তাকে দিতে হবে। কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণটা নিশ্চিত না করলে জাতি বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়বে।

উল্লেখ্য, করোনা পরিস্থিতির কারণে সর্বশেষ চলাচলে বিধিনিষেধ আগামী ১৫ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা আছে ৩০ জুন পর্যন্ত। সেই হিসাবে মধ্য জুলাই পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটিও বাড়ছে বলে জানান শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ আছে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ছুটির ১৬ মাস পূর্ণ হচ্ছে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদিও সরকার বিভিন্ন উপায়ে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু তা ততটা কার্যকর নয়। বিশেষ করে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রমের সুবিধাভোগী কেবল শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। এর বাইরে বৃহত্তর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা খুব কমই সুবিধাটি ভোগ করতে পারছে।

অন্যদিকে বেতার ও টেলিভিশনে যে পাঠদান চলছে, সেখানেও অনেকটাই অনলাইনের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায়ও এই চিত্র উঠে এসেছে। ওই গবেষণা অনুযায়ী, করোনার কারণে প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে আছে।

এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা : মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ক্লাস চালুর পাশাপাশি বড় ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে চারটি পাবলিক এবং এবারের পিইসি পরীক্ষা। চারটি পাবলিক পরীক্ষার মধ্যে আছে এবারের এসএসসি ও এইচএসসি এবং আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি।

সরকার এবারের পরীক্ষা দুটি অনলাইনে নেওয়ার চিন্তা থেকে কমিটি করেছিল। কিন্তু কমিটি ইতিবাচক মতামত দেয়নি। এ অবস্থায় পরীক্ষা নিয়ে সরকার বিকল্প ভাবছে। তবে সেটি কি এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। অবশ্য আগামী বছরের পরীক্ষা দুটি বিকল্প পন্থায় নেওয়ার চিন্তা অনেকটাই চূড়ান্ত বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করে এনসিটিবির একটি সূত্র জানায়, আগামী বছরের এসএসসি ফেব্রুয়ারিতে আর এইচএসসি এপ্রিলে নেওয়ার কথা। তাদের এখন অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। এই অ্যাসাইনমেন্ট সংক্রান্ত পরিকল্পনা তৈরি করে এনসিটিবি। পাবলিক পরীক্ষার বিকল্প ভাবনায় রেখে এই অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করা হয়েছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।

এ ক্ষেত্রে এসএসসির ফলাফলের ওপর ৫০ শতাংশ, জেএসসির ফলাফলের ওপর ২৫ এবং অ্যাসাইনমেন্টের ওপর ২৫ শতাংশ জোর দেওয়া হয়েছে। সেই কারণে আগামী বছর পরীক্ষা নিতে না পারলে কেবল মূল্যায়নে ফল দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে সরকার। এ নিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের নেতৃত্বে কাজ চলছে বলে জানা গেছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর