বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বহুল আলোড়িত কথিত ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নিয়ে বিতর্কের নতুন ঝড় উঠেছে। দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদকের সে সময় শেখ হাসিনার দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশিত একটি সংবাদের ব্যাপারে ‘ভুল স্বীকার’কে কেন্দ্র করে ওঠা এই বিতর্ক নানাদিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তো বটেই, উঠে আসছে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন দৈনিকের সম্পাদকদের ভূমিকার কথাও। আলোচনা ও সমালোচনায় উঠে আসছে সে সময় মাইনাস টু ফর্মুলার সঙ্গে জড়িত কুশীলবদের প্রসঙ্গও।
শুরুতেই সে সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আলোচনায় এলেও গত কয়েকদিনে সে আলোচনা রুপ নিয়েছে ওয়ান ইলেভেনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে। সে সময় দুই নেত্রীকে গ্রেফতার, তাদের উপর নিযাতন, সে সময়ের সেনা শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গনের সখ্য- উঠে আসতে শুরু করেছে অনেককিছুই।
জাতীয় সংসদ, আলোচনা মঞ্চ ও বিভিন্ন টেলিভিশনে টকশো থেকে শুরু করে ব্যক্তি পযায়েও ওয়ান ইলেভেন বিতর্ক নতুন ঝড় তুলেছে। সমালোচনায় জড়িয়ে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য ও নেতানেত্রীরাও।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বড় পরিবর্তনগুলোর একটি ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। আমেরিকার টু ইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাবহুল নাইন-ইলেভেনের (৯/১১) সঙ্গে মিলিয়েই রাখা হয় দিনটির নাম।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সে সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হয়। এক চরম রাজনৈতিক সংঘাত, অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতার মাঝে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাতে আকস্মিক দেশে ঘোষনা হয় জরুরি অবস্থা। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। তারপর টানা দু’বছর এ সরকার ক্ষমতায় থাকে। চলতে থাকে রাজনৈতিক নিপীড়ন। প্রকাশ্যে ও গোপনে সে সরকারের পক্ষ নেয় বিভিন্ন মহল।
সম্প্রতি টেলিভিশনের এক আলোচনায় মাহফুজ আনাম বলেন, ২০০৭-০৮ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের পাঠানো ‘শেখ হাসিনার কথিত দুর্নীতির তথ্য’ কোনোরকম যাচাই না করে প্রকাশ করাটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত এবং এএজন্য তিনি দু:খিত।
এই স্বীকারোক্তির পর থেকেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহল থেকে মাহফুজ আনামের শাস্তি দাবি করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬৬টিরও বেশি মামলা হয়েছে। ৮২ হাজার ৬৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে। এমনকি এই মামলা দাযের অব্যাহত রয়েছে।
মাহফুজ আনামের এই স্বীকারোক্তির পরপরই গোটা দেশে ওয়ান ইলেভেন নতুন করে আলোচনায় আসে। পক্ষে বিপক্ষে আলোচনার ঝড় ওঠে। শুধু সম্পাদকরাই নয়, উঠে আসেন সে সময়ে বিভিন্ন মহল ও কুশীলবদের নাম ও কর্মকান্ড।
শুরুটা হয়েছিল মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের মধ্য দিয়ে। একের পর এক মামলার পাশাপাশি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও বাইরে নেতাকর্মীসহ সরকার সমর্থিত সুশীল সমাজও ওয়া্ন ইলেভেনে দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সে সময় ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনতে থাকেন।
অন্যদিকে, সম্পাদক পরিষদসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলার সমালোচনা করেন। মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সভা-সেমিনার ও মানববন্ধন হতে শুরু করে। তোপের মুখে পড়ে সরকারও।
কিন্তু বিষয়টি আর শেষ পযন্ত মাহফুজ আনামেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিভিন্ন টকশোতে ধীরে ধীরে উঠে আসতে থাকে ওয়ান ইলেভেন প্রেক্ষাপট।
সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সাবেক সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দাদের দেয়া খবর প্রকাশের অভিযোগে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের তীব্র সমালোচনা করেন। সে অনুষ্ঠানে তিনি স্পষ্টই বলেন, ‘সাবেক সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুইটি পত্রিকা ডিজিএফআইয়ের লিখে দেওয়া মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে সে সময় রাজনীতি থেকে আমাকে এবং খালেদা জিয়াকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়েছে।’
একই সঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা মিথ্যা তথ্য প্রচারের ষড়যন্ত্রে জড়িত সম্পাদকদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
এমনকি মাহফুজ আনামকে সাংবাদিকতা ছেড়ে দেওয়ার আহ্বানও জানান শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনাও দেন। ফলে ওয়ান ইলেভেন নতুন করে বিতর্কের ঝড় তোলো।
গত কয়েকদিনের টকশো বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, মাহফুজ আনাম ও প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানসহ আরও কিছু দৈনিকের সম্পাদকের সে সময়ের ভুমিকাও আলোচনায় উঠে আসছে। শোনা যাচ্ছে সে সময় সেনা সমর্থিত সরকারের পক্ষে বিভিন্ন সম্পাদক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নামও।
ফলে ওয়ান ইলেভেন বিতর্কি এই মুহূর্তে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করেছে দেশে। কখন কোন আলেচনায় কার নাম চলে আসে, এ নিয়ে বিব্রত অবস্থায় রয়েছেন নানাজন।
অবশ্য গত কয়েকদিনে এসব আলোচনা ব্যাপকতা পেলেও মুখ খুলছেন না কেউই। মাহফুজ আনামকে ফোন করলে তিনি বরাবরই বলছেন এ নিয়ে কথা বলতে চান না। অন্যরাও মুখ খুলছেন না। অর্থাৎ এক ধরনের চাপা বিব্রতকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে বিভিন্ন অঙ্গনে।