ঢাকা ০৭:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মার্কিন নথি: জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড জিয়া হত্যার পরে সেনাবাহিনীতে কী ঘটেছিল

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:২২:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মে ২০১৫
  • ৪৪৫ বার

ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড টি স্নাইডার পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছিলেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বার্তা পাঠিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরেও এভাবে মার্কিন দূতাবাস সক্রিয় হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর ভেতরকার খবর জিয়া হত্যাকাণ্ডের পরে তারা বেশি নির্দিষ্টভাবে জানতে পেরেছিল। দূতাবাসের মূল্যায়নে প্রতীয়মান হয় যে পরিস্থিতি অনুকূল না থাকার কারণে সামরিক বাহিনী জিয়া হত্যার পরপরই ক্ষমতা দখলে বিরত ছিল।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রদূত স্নাইডার বেলছিলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে যেসব খবরাখবর আমরা পেয়েছি, তাতে আমাদের কাছে এ রকম আর কোনো তথ্য নেই যে জেনারেল মঞ্জুরের সমর্থনে অন্য কোনো সামরিক ইউনিট ওই বিদ্রোহে অংশ নিচ্ছে বা তেমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
সেনাবাহিনীর ফরেন লিয়াজোঁ অফিসার ডিএটিটিকে (ঢাকায় মার্কিন প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে) বলেছেন, কুমিল্লার ৩৩ ডিভিশন ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। তারা ঢাকা কমান্ডের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে।
উল্লেখ্য, স্নাইডার এই বার্তায় উল্লেখ করেছিলেন যে চীনা দূতাবাস কর্মকর্তাও আমাদের বলেছেন, একটি বিশ্বস্ত সূত্রমতে তাঁরাও জানতে পেরেছেন, ৩৩ ডিভিশন মঞ্জুরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে যাচ্ছে। চীনাদের মতে, বর্তমান লড়াইয়ের মুখ্য ফ্যাক্টর হচ্ছে ৩৩ ডিভিশন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, যাঁর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ভালো যোগাযোগ আছে, তিনি আমাদের জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করছেন যে বগুড়া কিংবা রংপুর ও ঢাকার বাইরে থাকা নবম ডিভিশনের সৈন্যদের আনুগত্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাঁদের অধিকাংশই অনুগত। তবে জেনারেল মীর শওকত আলীর নেতৃত্বাধীন ডিভিশনের মনোভাব সম্পর্কে তিনি কম নিশ্চিত।
মীর শওকত আলীকে কয়েক মাস আগে ঢাকায় স্থানান্তর করা হলেও তাঁর যথেষ্ট প্রভাব রয়ে গেছে। তাঁর মতে, নৌবাহিনী পুরোপুরি অনুগত। কিন্তু বিমানবাহিনী বিভ্রান্ত। কারণ, বর্তমান বিমানবাহিনীর প্রধানের নেতৃত্ব দুর্বল। এ ছাড়া ১৯৭৭ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সমস্যাও কিছুটা রয়ে গেছে। এই একই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন যে চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর ভেতরকার সরকার অনুগত ও জেনারেল মঞ্জুরের অনুগত ব্যক্তিদের মধ্যে ‘জটিলতা’ রয়ে গেছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরও উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আক্রমণ চালানো হলেও বিএনপির মহাসচিব বদরুদ্দোজা চৌধুরী অক্ষত ছিলেন। যদিও কথিতমতে, আক্রমণকারীরা সংখ্যায় ছিল প্রায় ২০০ এবং তাঁরা গৃহভৃত্যসহ প্রত্যেককে হত্যা করেছেন। এ ঘটনার বাইরে একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় আমাদের নজরে এসেছে। আমরা অবগত হয়েছি, জিয়াকে এই সময়ে চট্টগ্রাম সফর থেকে বিরত থাকতে সামরিক গোয়েন্দারা উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সতর্কতা তিনি অগ্রাহ্য করেন।
১৯৮১ সালের ৩১ মে মার্কিন দূতাবাসের ৭ নম্বর পরিস্থিতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এরশাদ মেজর জেনারেল মঞ্জুরসহ সব ‘দুর্বৃত্ত এবং তাঁদের কমান্ডিং অফিসারদের’ আজ দুপুরের মধ্যে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যথায় সশস্ত্র বাহিনী চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। স্নাইডার উল্লেখ করেন যে সরকারের প্রতি কুমিল্লার গুরুত্বপূর্ণ ৩৩ ডিভিশনের আনুগত্য সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর, বর্তমানে বিজিবি) প্রধান এবং মন্ত্রিসভার সচিব মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করেন যে ৩৩ ডিভিশন সরকারের সঙ্গেই রয়েছে। বিডিআর প্রধানের মতে, ৩৩ ডিভিশন দেশের অবশিষ্ট অংশ থেকে ফেনী নদীর (চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার সীমান্ত) কাছে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আমাদের কাছে এ খবরও এসেছে যে কুমিল্লা থেকে সড়ক ও রেলপথে উল্লেখযোগ্য সৈন্য রওনা দিয়েছে। রাষ্ট্রদূত এরপর লিখেছেন, আমাদের জানামতে, চট্টগ্রামে মঞ্জুরের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হতে সৈন্য প্রেরণে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। আমরা অনুমান করছি যে এই সৈন্যদের গন্তব্য হচ্ছে ফেনী নদী পর্যন্ত। রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, আমরা আরও ইঙ্গিত পেয়েছি যে চট্টগ্রামের কতিপয় সামরিক ইউনিট সরকারের প্রতি অনুগত। মন্ত্রিসভার সচিব দাবি করেছেন যে সৈন্যরা ব্যাপক সংখ্যায় সরকারের কাছে ছুটে আসছে এবং বিডিআরের প্রধান চট্টগ্রামের অনুগত সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। এরপর সূত্র অবমুক্ত না করা এক প্রতিবেদনের বরাতে বলা হয়েছে, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী ইউনিট চট্টগ্রামে সরকারের প্রতি অনুগত রয়েছে। এরপরের কিছুটা জায়গা অবমুক্ত করা হয়নি।
রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেন যে জেনারেল এরশাদ যদিও ফাইনাল অ্যাকশন গ্রহণের হুমকি দিয়েছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের ভেতরে কৌশল গ্রহণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ অবিলম্বে আক্রমণ করতে চাইছেন আর অন্যরা একটি কৌশল গ্রহণের কথা ভাবছেন। কারণ, তাঁরা একটা জাতীয় ঐক্য দেখাতে চাইছেন। তাই মঞ্জুরকে পরিত্যাগ করে সরকারের প্রতি সমর্থনকারী সেনাসংখ্যা যাতে আরও বাড়ে, সে জন্য তাঁরা অপেক্ষা করতে চাইছেন। যাঁরা একটি শক্তিক্ষয়ের (এট্রিশন) কৌশল অবলম্বনের পক্ষে, তাঁদের যুক্তি—দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে মঞ্জুর সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে এবং তাঁরা যখন ওই অভিযানে নামবেন, তখন সরকার অনুগত সৈন্যদের দিক থেকেও স্বপক্ষ ত্যাগের বিষয়েও উদ্বেগ রয়েছে। আর সে কারণেই অধিকতর সতর্ক কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর প্রতি এরশাদের সমর্থন রয়েছে আর সেটাই প্রাধান্য পাচ্ছে।
২০ দিন পরে: ১৯৮১ সালের ২০ জুন এক সিক্রেট তারবার্তায় জিয়া ও মঞ্জুর হত্যার পরপরই কেন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেনি, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সৈন্যদের আনুগত্য নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকাটাই উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের সংযত করতে পারে। মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেও অসন্তোষ রয়েছে কিন্তু আমাদের কাছে এমন রিপোর্ট নেই যে এই গ্রুপ এই সময়ে নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। চূড়ান্তভাবে, সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে জনগণের মনোভাব অনুকূল নয়। আর সেটাই হয়তো তাদের সংযত করতে পারে। যদিও সম্ভাব্য একাধিক ঘটনার পরে আমাদের এই অনুমান বদলে যেতে পারে।
ঢাকায় ব্যাপক সংশয় রয়েছে যে সামরিক বাহিনী কোনো না কোনোভাবে চলতি সাংবিধানিক ক্রান্তিকালকে নস্যাৎ করতে পারে। আশঙ্কা দুটি। প্রথমত, বর্তমান সামরিক নেতৃত্ব সরকারকে সামরিক আইন জারি করতে বাধ্য করবে কিংবা অন্য উপায়ে ক্ষমতা নিয়ে নেবে। কিংবা দ্বিতীয়ত, সামরিক বাহিনীর মধ্যকার একটি অসন্তুষ্ট গ্রুপ বর্তমান সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাত করতে পারে। এবং সম্ভবত সরকারকেও। পরের ভয়টি অনেক বেশি অনড়, যদিও তা অস্পষ্ট। এর মূল কথা হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর ‘পরিস্থিতি ভালো নয়’। এই আশঙ্কাটা জীবন্ত থাকছে পৌনঃপুনিক গুজবের কারণে। আর সেটা হলো সামরিক বাহিনীর মধ্যে ‘হট্টগোল’ রয়েছে। এক গুজবে বলা হয়েছে, ৮ কিংবা ৯ জুন রাতে ঢাকা সেনানিবাসে একধরনের হইচই ঘটেছে। তবে এই গুজব ও আতঙ্ক সত্ত্বেও গত দুই সপ্তাহে সামরিক বাহিনীর ভেতরকার অবস্থার লক্ষণীয় উন্নতি ঘটেছে। এবং জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পরপরই যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, এখন আর ততটা করা হচ্ছে না।
জাসদের ষড়যন্ত্র: ১৯৭৫ সালের পরে ১৯৮১ সালে আবারও জাসদ প্রসঙ্গ আসে। ওই একই বার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন যে যদিও একাধিক সূত্র সন্দেহ প্রকাশ করেছে, এ মুহূর্তে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ একটি মারাত্মক হুমকি। অনুকূল পরিবেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সৈন্যদের মধ্যকার রেডিক্যাল অংশের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু ১৯৮০ সালের ১৭ জুনের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যে জাসদের অবলম্বন করা কৌশল শৌখিন। তদুপরি সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে আনুগত্যের অনিশ্চয়তা, আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে অনিশ্চয়তার একটি উপকরণ হিসেবেই রয়ে গেছে।
অন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও লক্ষ করা যায় যে এনসিও (নন-কমিশনড অফিসার) এবং সৈনিকদের মধ্যকার শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে। যেমনটা একজন বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন যে সরকারের সৌভাগ্য যে উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তারা তাঁদের সৈন্যদের আনুগত্য লাভ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। জেনারেল মঞ্জুরের বিদ্রোহ সমর্থনে সাধারণ সৈনিকদের অস্বীকৃতি, সেনাবাহিনীতে জিয়ার জনপ্রিয়তা এবং কর্মকর্তাদের প্রতি সৈন্যদের অন্ধভাবে অনুসরণ না করার মনোভাব—এই ক্রান্তিকালে (ক্ষমতা দখলে) উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের সংযত করেছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

মার্কিন নথি: জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড জিয়া হত্যার পরে সেনাবাহিনীতে কী ঘটেছিল

আপডেট টাইম : ০৪:২২:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মে ২০১৫

ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড টি স্নাইডার পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছিলেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বার্তা পাঠিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরেও এভাবে মার্কিন দূতাবাস সক্রিয় হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর ভেতরকার খবর জিয়া হত্যাকাণ্ডের পরে তারা বেশি নির্দিষ্টভাবে জানতে পেরেছিল। দূতাবাসের মূল্যায়নে প্রতীয়মান হয় যে পরিস্থিতি অনুকূল না থাকার কারণে সামরিক বাহিনী জিয়া হত্যার পরপরই ক্ষমতা দখলে বিরত ছিল।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রদূত স্নাইডার বেলছিলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে যেসব খবরাখবর আমরা পেয়েছি, তাতে আমাদের কাছে এ রকম আর কোনো তথ্য নেই যে জেনারেল মঞ্জুরের সমর্থনে অন্য কোনো সামরিক ইউনিট ওই বিদ্রোহে অংশ নিচ্ছে বা তেমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
সেনাবাহিনীর ফরেন লিয়াজোঁ অফিসার ডিএটিটিকে (ঢাকায় মার্কিন প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে) বলেছেন, কুমিল্লার ৩৩ ডিভিশন ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। তারা ঢাকা কমান্ডের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে।
উল্লেখ্য, স্নাইডার এই বার্তায় উল্লেখ করেছিলেন যে চীনা দূতাবাস কর্মকর্তাও আমাদের বলেছেন, একটি বিশ্বস্ত সূত্রমতে তাঁরাও জানতে পেরেছেন, ৩৩ ডিভিশন মঞ্জুরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে যাচ্ছে। চীনাদের মতে, বর্তমান লড়াইয়ের মুখ্য ফ্যাক্টর হচ্ছে ৩৩ ডিভিশন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, যাঁর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ভালো যোগাযোগ আছে, তিনি আমাদের জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করছেন যে বগুড়া কিংবা রংপুর ও ঢাকার বাইরে থাকা নবম ডিভিশনের সৈন্যদের আনুগত্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাঁদের অধিকাংশই অনুগত। তবে জেনারেল মীর শওকত আলীর নেতৃত্বাধীন ডিভিশনের মনোভাব সম্পর্কে তিনি কম নিশ্চিত।
মীর শওকত আলীকে কয়েক মাস আগে ঢাকায় স্থানান্তর করা হলেও তাঁর যথেষ্ট প্রভাব রয়ে গেছে। তাঁর মতে, নৌবাহিনী পুরোপুরি অনুগত। কিন্তু বিমানবাহিনী বিভ্রান্ত। কারণ, বর্তমান বিমানবাহিনীর প্রধানের নেতৃত্ব দুর্বল। এ ছাড়া ১৯৭৭ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সমস্যাও কিছুটা রয়ে গেছে। এই একই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন যে চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর ভেতরকার সরকার অনুগত ও জেনারেল মঞ্জুরের অনুগত ব্যক্তিদের মধ্যে ‘জটিলতা’ রয়ে গেছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরও উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আক্রমণ চালানো হলেও বিএনপির মহাসচিব বদরুদ্দোজা চৌধুরী অক্ষত ছিলেন। যদিও কথিতমতে, আক্রমণকারীরা সংখ্যায় ছিল প্রায় ২০০ এবং তাঁরা গৃহভৃত্যসহ প্রত্যেককে হত্যা করেছেন। এ ঘটনার বাইরে একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় আমাদের নজরে এসেছে। আমরা অবগত হয়েছি, জিয়াকে এই সময়ে চট্টগ্রাম সফর থেকে বিরত থাকতে সামরিক গোয়েন্দারা উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সতর্কতা তিনি অগ্রাহ্য করেন।
১৯৮১ সালের ৩১ মে মার্কিন দূতাবাসের ৭ নম্বর পরিস্থিতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এরশাদ মেজর জেনারেল মঞ্জুরসহ সব ‘দুর্বৃত্ত এবং তাঁদের কমান্ডিং অফিসারদের’ আজ দুপুরের মধ্যে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যথায় সশস্ত্র বাহিনী চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। স্নাইডার উল্লেখ করেন যে সরকারের প্রতি কুমিল্লার গুরুত্বপূর্ণ ৩৩ ডিভিশনের আনুগত্য সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর, বর্তমানে বিজিবি) প্রধান এবং মন্ত্রিসভার সচিব মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করেন যে ৩৩ ডিভিশন সরকারের সঙ্গেই রয়েছে। বিডিআর প্রধানের মতে, ৩৩ ডিভিশন দেশের অবশিষ্ট অংশ থেকে ফেনী নদীর (চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার সীমান্ত) কাছে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আমাদের কাছে এ খবরও এসেছে যে কুমিল্লা থেকে সড়ক ও রেলপথে উল্লেখযোগ্য সৈন্য রওনা দিয়েছে। রাষ্ট্রদূত এরপর লিখেছেন, আমাদের জানামতে, চট্টগ্রামে মঞ্জুরের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হতে সৈন্য প্রেরণে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। আমরা অনুমান করছি যে এই সৈন্যদের গন্তব্য হচ্ছে ফেনী নদী পর্যন্ত। রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, আমরা আরও ইঙ্গিত পেয়েছি যে চট্টগ্রামের কতিপয় সামরিক ইউনিট সরকারের প্রতি অনুগত। মন্ত্রিসভার সচিব দাবি করেছেন যে সৈন্যরা ব্যাপক সংখ্যায় সরকারের কাছে ছুটে আসছে এবং বিডিআরের প্রধান চট্টগ্রামের অনুগত সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। এরপর সূত্র অবমুক্ত না করা এক প্রতিবেদনের বরাতে বলা হয়েছে, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী ইউনিট চট্টগ্রামে সরকারের প্রতি অনুগত রয়েছে। এরপরের কিছুটা জায়গা অবমুক্ত করা হয়নি।
রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেন যে জেনারেল এরশাদ যদিও ফাইনাল অ্যাকশন গ্রহণের হুমকি দিয়েছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের ভেতরে কৌশল গ্রহণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ অবিলম্বে আক্রমণ করতে চাইছেন আর অন্যরা একটি কৌশল গ্রহণের কথা ভাবছেন। কারণ, তাঁরা একটা জাতীয় ঐক্য দেখাতে চাইছেন। তাই মঞ্জুরকে পরিত্যাগ করে সরকারের প্রতি সমর্থনকারী সেনাসংখ্যা যাতে আরও বাড়ে, সে জন্য তাঁরা অপেক্ষা করতে চাইছেন। যাঁরা একটি শক্তিক্ষয়ের (এট্রিশন) কৌশল অবলম্বনের পক্ষে, তাঁদের যুক্তি—দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে মঞ্জুর সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে এবং তাঁরা যখন ওই অভিযানে নামবেন, তখন সরকার অনুগত সৈন্যদের দিক থেকেও স্বপক্ষ ত্যাগের বিষয়েও উদ্বেগ রয়েছে। আর সে কারণেই অধিকতর সতর্ক কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর প্রতি এরশাদের সমর্থন রয়েছে আর সেটাই প্রাধান্য পাচ্ছে।
২০ দিন পরে: ১৯৮১ সালের ২০ জুন এক সিক্রেট তারবার্তায় জিয়া ও মঞ্জুর হত্যার পরপরই কেন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেনি, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সৈন্যদের আনুগত্য নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকাটাই উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের সংযত করতে পারে। মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেও অসন্তোষ রয়েছে কিন্তু আমাদের কাছে এমন রিপোর্ট নেই যে এই গ্রুপ এই সময়ে নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। চূড়ান্তভাবে, সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে জনগণের মনোভাব অনুকূল নয়। আর সেটাই হয়তো তাদের সংযত করতে পারে। যদিও সম্ভাব্য একাধিক ঘটনার পরে আমাদের এই অনুমান বদলে যেতে পারে।
ঢাকায় ব্যাপক সংশয় রয়েছে যে সামরিক বাহিনী কোনো না কোনোভাবে চলতি সাংবিধানিক ক্রান্তিকালকে নস্যাৎ করতে পারে। আশঙ্কা দুটি। প্রথমত, বর্তমান সামরিক নেতৃত্ব সরকারকে সামরিক আইন জারি করতে বাধ্য করবে কিংবা অন্য উপায়ে ক্ষমতা নিয়ে নেবে। কিংবা দ্বিতীয়ত, সামরিক বাহিনীর মধ্যকার একটি অসন্তুষ্ট গ্রুপ বর্তমান সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাত করতে পারে। এবং সম্ভবত সরকারকেও। পরের ভয়টি অনেক বেশি অনড়, যদিও তা অস্পষ্ট। এর মূল কথা হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর ‘পরিস্থিতি ভালো নয়’। এই আশঙ্কাটা জীবন্ত থাকছে পৌনঃপুনিক গুজবের কারণে। আর সেটা হলো সামরিক বাহিনীর মধ্যে ‘হট্টগোল’ রয়েছে। এক গুজবে বলা হয়েছে, ৮ কিংবা ৯ জুন রাতে ঢাকা সেনানিবাসে একধরনের হইচই ঘটেছে। তবে এই গুজব ও আতঙ্ক সত্ত্বেও গত দুই সপ্তাহে সামরিক বাহিনীর ভেতরকার অবস্থার লক্ষণীয় উন্নতি ঘটেছে। এবং জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পরপরই যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, এখন আর ততটা করা হচ্ছে না।
জাসদের ষড়যন্ত্র: ১৯৭৫ সালের পরে ১৯৮১ সালে আবারও জাসদ প্রসঙ্গ আসে। ওই একই বার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন যে যদিও একাধিক সূত্র সন্দেহ প্রকাশ করেছে, এ মুহূর্তে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ একটি মারাত্মক হুমকি। অনুকূল পরিবেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সৈন্যদের মধ্যকার রেডিক্যাল অংশের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু ১৯৮০ সালের ১৭ জুনের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যে জাসদের অবলম্বন করা কৌশল শৌখিন। তদুপরি সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে আনুগত্যের অনিশ্চয়তা, আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে অনিশ্চয়তার একটি উপকরণ হিসেবেই রয়ে গেছে।
অন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও লক্ষ করা যায় যে এনসিও (নন-কমিশনড অফিসার) এবং সৈনিকদের মধ্যকার শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে। যেমনটা একজন বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন যে সরকারের সৌভাগ্য যে উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তারা তাঁদের সৈন্যদের আনুগত্য লাভ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। জেনারেল মঞ্জুরের বিদ্রোহ সমর্থনে সাধারণ সৈনিকদের অস্বীকৃতি, সেনাবাহিনীতে জিয়ার জনপ্রিয়তা এবং কর্মকর্তাদের প্রতি সৈন্যদের অন্ধভাবে অনুসরণ না করার মনোভাব—এই ক্রান্তিকালে (ক্ষমতা দখলে) উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের সংযত করেছে।