হাওর বার্তা ডেস্কঃ শুষ্ক মৌসুমে গ্রাম বাংলায় খাল-বিলে পানি কমে গেলে দেশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আশ্রয় নেয় জলাশয়ের তলদেশের আগাছাপূর্ণ স্থানে। তখন কম পানিতে পলো দিয়ে মাছ শিকার করা সহজ।
এ সময়টাতে মাছ ধরতে আনন্দ পান সৌখিন সব মৎস্য শিকারিরা। পলো নিয়ে দলে দলে একসঙ্গে খালে-বিলে বা নদীতে মাছ ধরাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় পলো উৎসব। শীতের শুরুতেই শুরু হয় এই উৎসব। আড়াই থেকে তিন ফুট লম্বা আকৃতির এ খাঁচা সদৃশ পলো পানিতে তলদেশে ফেলে ওপরের ফাঁকা অংশ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মাছ শিকার করা হয়।
কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই চিরচেনা গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য পলো উৎসব। গ্রাম বাংলার পুরাতন এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য শুক্রবার নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার ব্রহ্মপুর বিলে পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসবের আয়োজন করা হয়।
জানা গেছে, নলডাঙ্গা উপজেলার আগে প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতেই থাকতো দু-একটি পলো। পলো দিয়ে মাছ ধরার কাজ ছাড়াও হাঁস-মুরগি ধরে রাখার কাজেও ব্যবহার হতো। শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে পৌষ মাস থেকে শুরু করে চৈত্র মাস পর্যন্ত চলে পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসব।পলো উৎসবে যোগ দেওয়া কয়েকজন জানান, বিভিন্ন এলাকার নদ-নদী,খাল- বিল হাওরসহ উন্মুক্ত জলাশয়ে কয়েকদিন পূর্ব থেকেই দিন তারিখ ঠিক করে আশপাশের প্রত্যেক গ্রামের জনসাধারণকে দাওয়াত দেয়া হতো। নির্দিষ্ট দিনে বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন গ্রাম থেকে সৌখিন মৎস্য শিকারীরা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে জড়ো হতেন।
বিলের এক প্রান্ত থেকে সকলে একই সাথে লাইন ধরে লুঙ্গি আটঘাট করে বেধে অথবা কাছা দিয়ে একসঙ্গে দল বেধে নান্দনিক ছন্দের তালে তালে ঝপ ঝপাঝপ শব্দে পলো দিয়ে মাছ ধরা উৎসবে মেতে উঠতেন।
এর অংশ হিসেবে শুক্রবার নলডাঙ্গা উপজেলার ব্রহ্মপুর বিলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ উৎসবে ১০ কিলোমিটার দুরের গ্রাম মোমিনপুর, মির্জাপুর গ্রাম থেকে কয়েক শতাধিক সৌখিন মাছ শিকারীরা অংশ নেয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, হালতি বিলের ব্রহ্মপুর বিলে এক প্রান্ত থেকে সকলে একই সাথে লাইন ধরে লুঙ্গি আটঘাট করে বেধে অথবা কাছা দিয়ে এক সঙ্গে দল বেধে নান্দনিক ছন্দের তালে তালে ঝপ ঝপাঝপ শব্দে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুরু করেছেন এবং সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতেন সামনের দিকে। অনেকেরই মাথায় গামছা বাঁধা।পলো দিয়ে পানিতে একের পর এক চাপ দেওয়া আর হৈহুল্লা করে সামনের দিকে অঘোষিত ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া।
যেন এক নিজস্ব চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় দৃশ্য।পুরনো মাছ শিকারিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পলোয় সাধারণত দেশি মাছই বেশি ধরা পড়তো রুই কাতলা, মৃগেল, চিতল, আইড়, ঘাগট, কালবাউস, বোয়াল, শোল, চিতল, টাকি ও গজার প্রভৃতি মাছ।মাছ দিয়ে মালার মতো তৈরি করে কাঁধে ঝুলিয়ে খুশিতে বাড়ি ফিরতেন। বর্তমানে অনেক হাওর খাল বিল ও উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
ব্রহ্মপুর বিলে মোমিনপুর থেকে আসা মাছ শিকারী আজগর, সুজন, মোজাফর পরিবর্তন ডটকমকে জানান, খাল-বিলে আগের মতো আর মাছ নেই। বিভিন্ন ফাঁস জাল দিয়ে বা অবৈধভাবে বেড়জাল দিয়ে বেড়া দিয়ে মাছ শিকার করায় দেশীয় মাছ আজ হারিয়ে যাচ্ছে।ব্রহ্মপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ঝপ ঝপাঝপ পলো বাও/ মজার মজার মাছ খাও’- সদলবলে পলো দিয়ে মাছ ধরার অভিযানে নামার শ্লোগান এটি। হারিয়ে যাচ্ছে পলো নিয়ে মাছ ধরা। আগামী প্রজন্ম পলো কি তা চিনবে না। নতুন প্রজন্মের জন্য এসব ঐতিহ্য ধরে রাখার উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে দাবি করেন।এছাড়ও সিরাজগঞ্জ তাড়াশে সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের কুন্দইল, বিন্নাবাড়ি, হেমনগর, ইশ্বরপুর, নওখাদা, চরকুশাবাড়ি ও ধামাইচ গ্রামের কিশোর, যুবক ও বয়স্করা দল বেধে পলো দিয়ে মাছ ধরার জন্য খালে ও নদীতে নামছেন। তারা দলবেধে পলো দিয়ে মাছ ধরছেন। এ দলে প্রায় দুই শতাধিক মানুষ উৎসবে মেতে উঠেন।গোমানী নদীতে বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে দল বেধে মাছ ধরার দৃশ্য যেন দেখার মতো। দলবদ্ধভাবে মাছ শিকারের এ দৃশ্য দেখতে নদীর দুই তীরে ভিড় জমায় উৎসুক মানুষজন। উৎসবে অংশ নেয়াদের হাততালি, জোরে জোরে চিৎকার করে উৎসাহ দেন তীরে অবস্থানরত লোকজন। নদীতে বড়দের পাশাপাশি ছোট ছেলেমেয়েদেরও দেখা যায়। মাথা ও কোমরে গামছা বেঁধে অনেকটা আনন্দ নিয়েই মাছ ধরতে দেখা যায় তাদের।তাড়াশ উপজেলার ধামাইচ গ্রামের কলেজ শিক্ষক এম হাসিম খোকন পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, বছরের এদিনের জন্য অধীর আগ্রহে থাকেন এলাকার সৌখিন মানুষেরা। সবাই মিলে একসঙ্গে মাছ ধরার আনন্দটাই আলাদা। দিন দিন পরিবেশ ও আবহাওয়ার কারণে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওরের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি কম ও অধিকাংশ জলাশয় ইজারা দেয়ায় পলো উৎসব এখন অনেকটাই ভাটা পড়েছে।