যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গনি তালুকদারের গল্প

বিজয় দাস নেত্রকোনাঃ যোদধাহত মুক্তিযোদ্ধা । নেত্রকোনা পৌরশহরের নাগড়া এলাকায় বাসা। তাঁর নাম ওসমান গণি তালুকদার। দাদা আব্দুল আলীম তালুকদারের ছিল অগাধ জমিজমা। আর বাবা আব্দুল মজিদ তালুকদার ছিলেন মাতব্বর প্রকৃতির লোক। গরীব মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। এলাকার মানুষ তাই মান্য করতেন। চৌদ্দ পুরুষের ছিল তালুক সম্পত্তি। তাই নামের শেষে বসেছে ‘তালুকদার।

স্বাধীনতার আগের নানা ঘটনা নিয়ে কথা হচ্ছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. ওসমান গণি তালুকদারের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার গাভারকান্দা গ্রামে। আব্দুল মজিদ তালুকদার ও আয়শা মজিদ তালুকদারের পঞ্চম সন্তান ওসমান গণি। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি দেওপুর প্রাইমারি স্কুলে। অতঃপর ভর্তি হন বারহাট্টা সিকেপি (কোরেন্যাশন কৃষ্ণ প্রসাদ) উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর নেত্রকোণা কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর তিনি ওই কলেজেই ডিগ্রিতে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ডিগ্রি পরীক্ষার্থী।

নেত্রকোণায় সে সময়কার রাজনৈতিক অবস্থার কথা জানালেন এই যোদ্ধা। তাঁর ভাষায়:

“নেত্রকোণায় তখন মুসলিম লীগবিরোধী একটা রাজনীতি চলত, বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ছিল শক্তিশালী। তৃণমূল পর্যায়ে স্কুলগুলোতে গিয়ে ওরা ছাত্রদের সচেতন করত। কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা ছিলেন কমরেড মনি সিংহ। ন্যাপের ছিলেন আজিজুর রহমান ও ওয়াজেদ আলী। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ করতেন ফজলুল কাদের, ফজলুর রহমান খান, আব্দুল খালেক, মমিন সাহেব প্রমুখ। সত্তরের নির্বাচনে আমাদের ওখানে আব্দুল মমিন সাহেব এমএনএ এবং এমপিএ হন আব্বাস আলী খান। কিন্তু তবু ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানের শাসকরা।”

বিএ ফাইনালের প্রস্তুতি চলছে তখন। ওসমান গণি নেত্রকোণা কলেজ হোস্টেলে। সারা দেশ উত্তপ্ত। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দিলে যেন যুদ্ধ শুরু হবে। সে ঘোষণারই অপেক্ষায় আছে সবাই। ল হোস্টেলের রেডিওতে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি। বঙ্গবন্ধু বললেন: “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম…।”

২৫ মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা শুরু করে। ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। ফলে মানুষ জীবন বাঁচাতে মানুষ চলে যেতে থাকে সীমান্তের ওপারে, ভারতে। নেত্রকোণায় পাকিস্তানি সেনারা প্রবেশ করে এপ্রিলের শেষে। এর আগেই ওসমান গণিরা শহর ছেড়ে চলে যায় গ্রামে।

“ছাত্র ছিলাম। বাঙালি চেতনাবোধটাও প্রবল ছিল। পশ্চিমা অনেকেই তখন নেত্রকোণায় কাজ করত। তারা বাঙালিদের মানুষই মনে করত না। এসব অবহেলা দেখেছি নিজ চোখে। শহরের এসেই পাকিস্তানি সেনারা হিন্দু ও আওয়ামী লীগের লোকদের বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে শান্তি কমিটির লোকেরা। ফজলুল হক ছিলেন শান্তি কমিটির নেতা। আমাদের পেলেই তো ওরা মেরে ফেলবে। তাই বাঁচলে হলে লড়াই করেই বাঁচব। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাই একদিন ঘর ছাড়ি।”

“মে মাসের কথা। মা জানত ফুপুর বাড়িতে গিয়েছি। আমার সঙ্গে ছিল আব্দুল হাকিম। বিজয়পুরের বর্ডার পাড় হয়েই নাম লেখাই ভারতের মোহাদেও ইয়ুথ ক্যাম্পে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান খান। সেখানে এক মাস চলে লেফট-রাইট। পরে এক মাসের হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় তুরাতে।

ট্রেনিং শেষে  পাঠিয়ে দেওয়া হয় রণক্ষেত্রে।  ১২০ জনের কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন ইসলাম উদ্দিন খান আর টোয়াইছি আবুল হোসেন। শেষে কোম্পানি ভেঙে তাঁরা দু-তিনটি গ্রুপে অপারেশন চালায়। এভাবে তিনি গেরিলা অপারেশন করেন ১১ নং সেক্টরের ধর্মপাশা, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, বিজয়পুর প্রভৃতি এলাকায়।

১৯৭১ সালের ৩ডিসেমবর দেশের স্বাধীনতার জন্য এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন এই সূর্যসন্তান। পাকিস্তানি সেনাদের পুতে রাখা মাইনের আঘাতে তাঁর ডান পা উড়ে যায়। স্প্লিনটারে বিদ্ধ হয় তাঁর বাঁ পা ও ডান হাতের আঙুলও। সেদিনের দুঃখ-স্মৃতি আজও তাঁকে আনমনা করে দেয়। রক্তাক্ত ওইদিনের যুদ্ধ-স্মৃতি শুনি মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণির জবানিতে–

“তখন আমরা বাগমারায়, হাইট আউটে। সঙ্গে ছিল ৬০-৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে অপারেশন করে আবার বাগমারা ক্যাম্পে ফিরে আসতাম। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারতীয় সেনারাও যোগ দেন আমাদের সঙ্গে। গঠিত হয় যৌথ বাহিনী। আমাদের ওখানে যৌথ বাহিনীর কমান্ডে ছিলেন মেজর মুরারি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর