এমপিদের ব্যবসায় রেকর্ড

জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। দেশের এই এমপিদের (সংসদ সদস্য) বেশির ভাগেরই পেশা ব্যবসায়। এই এমপিরা শুধু বাংলাদেশের রেকর্ড ছাড়াননি, উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকেও পেছনে ফেলেছেন। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে, এ দেশে ব্যবসায়ী এমপির হার উন্নত বিশ্বের চেয়েও দুই-তিনগুণ বেশি। জাতীয় সংসদ সচিবালয়কে এমপিদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানানো তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বর্তমান দশম সংসদের মূল ৩০০ এমপির মধ্যে ২০৬ জনেরই পেশা ব্যবসা। অর্থাৎ ব্যবসায়ী এমপির হার ৬৯ শতাংশ। সংরক্ষিত নারী আসনসহ ব্যবসায়ী এমপির মোট সংখ্যা হিসাব করলে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ২১৪ জনে। অবশ্য শুধু পেশা ব্যবসার দিক থেকেই নয়, অর্থ-সম্পদের মালিকানার দিক থেকেও বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা বিশ্বে অনন্য। হাতেগোনা কয়েকজন এমপি ছাড়া বাকি সবাই কোটিপতি।

রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর হাত ধরে বাংলাদেশে শুরু হওয়া রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ও অব্যাহত আছে। এ কারণেই রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে গেছে। অনেকেই রাজনীতিকে ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করছেন। অর্থলিপ্সার এ সুযোগে তৈরি হচ্ছে গডফাদার, টেন্ডারবাজ ও সুবিধাভোগী নেতা। স্বার্থের কারণে হচ্ছে রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাস। ক্রমেই বর্বরতার দিকে চলে যাচ্ছে সমাজ। চারপাশে অহরহ ঘটছে নৃশংস ঘটনা। আইন প্রণয়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের স্বার্থই চলে আসছে সামনে। ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপক অনুপ্রবেশের কারণেই গণতন্ত্রের মূল চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও লিবিয়ার মতো দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে গগনচুম্বী সফলতা অর্জন করলেও তাদের পতন ঠেকানো যায়নি কোনোভাবেই। সংসদ সচিবালয়কে এমপিদের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দশম সংসদের এমপিদের মধ্যে ব্যবসা পেশার সংখ্যাই বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে আইন ও তৃতীয়তে আছেন রাজনীতি পেশার সদস্যরা। স্বল্পসংখ্যক সদস্যের পেশা কৃষি, শিক্ষকতা ও চিকিৎসা। কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাও এমপি হয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এমপিদের মধ্যে ব্যবসাকে পেশা দেখিয়েছেন ২১৪ জন, আইনজীবী ৪৮ জন, রাজনীতিকে পেশা বলেছেন মাত্র ২২ জন। ব্যবসায়ী মোট ২১৪ জন এমপির মধ্যে আওয়ামী লীগেরই ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৪ জন, স্বতন্ত্র ১৪ জন এবং জাসদ, তরিকত ফেডারেশন,ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপি মিলিয়ে ৬ জন। মোট ৯ জন এমপির পেশার বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি সংসদ সচিবালয়ের কাছে।

অবশ্য এ সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে। কারণ একজন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ‘গ্রুপ অব কোম্পানি’র মালিক হলেও তার পেশা হিসেবে রাজনীতিকেই দেখানো হয়েছে। একইভাবে আরেকজন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নেতা ও বর্তমান এমপির কোনো পেশা দেখানো হয়নি। জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর যে হার ১৫% ছিল তা এখন অতীতের সব রেকর্ড পেছনে ফেলে ৬৯%-এ এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য সংসদগুলোর ধারাবাহিক পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেই বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৫৪ সালে এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। পরে ধারাবাহিকভাবেই এটি বেড়েছে। স্বাধীনতার দুই বছর পর প্রথম নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে ১৫% ব্যবসায়ী ছিলেন সংসদে।

এরপরে সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় ব্যবসায়ী, সম্পদশালী ও প্রভাবশালীদের ডেকে ডেকে করা হয়েছে এমপি। মাত্র ৬ বছরে ১৯৭৯ সালে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৫%। এরপর শুধুই বেড়েছে দুর্বৃত্তায়ন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পুনঃ প্রবর্তনের পরও সেই একই ধারা অব্যাহত ছিল। ১৯৯৬ সালে এসে ব্যবসায়ী এমপির হার হয়েছে ৪৮%, পরে ২০০১ সালের সংসদে এ হার হয় ৫১% এবং ২০০৮ সালে মোট এমপির ৬৩ শতাংশই ছিল ব্যবসায়ী। সেসব রেকর্ডও এখন ভঙ্গ হলো। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ও অতীতের ধারাবাহিকতায় সরকারের চারভাগের প্রায় তিনভাগই দখল করেছেন পেশায় ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, সদ্য নিম্ন মধ্যমআয়ের দেশের তালিকায় স্থান পাওয়া বাংলাদেশের ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। যেমন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের মধ্যে ৩৮% ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউস অব কমন্সে এই হার ২৫%। প্রতিবেশী ভারতের রাজনীতি বাংলাদেশের থেকে গুণগতভাবে খুব একটা এগিয়ে না থাকলেও সেখানে ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যা প্রায় তিন ভাগের একভাগ। ভারতের বর্তমান লোকসভায় মাত্র ২০% ব্যবসায়ী এমপি রয়েছেন। সেখানে সর্বোচ্চ ২৭% এমপি কৃষি এবং ২৪% রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।

তবে বাংলাদেশে রীতিমতো কোটিপতি এমপির ছড়াছড়ি। দুই বছর আগের নির্বাচনী হলফনামা নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের একটি গবেষণা অনুসারে, দশম সংসদের ২২৬ জন অর্থাৎ ৬৫% এমপির কোটি টাকার উপরে সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৯৪ জন এমপি অর্থাৎ ৭১%ই কোটিপতি। জাতীয় পার্টির ১৮ জন বা ৪৫% এমপির কোটি টাকার উপরে সম্পদ রয়েছে। জাসদের ৬ জন এবং ওয়ার্কার্স পার্টির একজন এমপি কোটিপতি। তরিকত ফেডারেশনের দুই এমপির দুজনই কোটিপতি। স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে ৮ জন কোটিপতি। সম্পদের বাইরে আয়ের বিবেচনায় ৫৫ জন এমপির বার্ষিক আয় কোটি টাকার উপরে বলে জানিয়েছিল সুজন। প্রচলিত ধারা অনুসারে, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের সম্পদের পরিমাণ সব সময়ই বৃদ্ধি পায়। সে হিসাবে কোটিপতি এমপিদের ঘোষিত সম্পদ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা জানতে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাংবিধানিকভাবে কে সংসদ সদস্য হতে পারবেন, আর কে পারবেন না এমন কোনো বিষয় নেই। থাকলে সেটা অবশ্যই বৈষম্যমূলক আচরণ হতো। এ সুযোগেই রাজনীতিকদের পিঠে বন্দুক রেখে ব্যবসায়ীরা এ পেশায় ঢুকে পড়ছেন। ফলে জনসেবা নয়, রাজনীতি এখন সবচেয়ে বড় ব্যবসা। যেখানেই লাভ সেখানেই ব্যবসায়ীদের উৎসাহ। তাদের কাছে রাজনীতি করার অর্থ হচ্ছে ‘নিজের আরও উন্নতি কর।’ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কোনো ছোট ব্যবসায়ী রাজনীতিতে আসছেন না। মধ্যম সারির বা বড় ব্যবসায়ীরাই রাজনীতিতে আসছেন। অর্থাৎ রাজনীতি ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় ব্যবসায়ীরাই এখন এর প্রতি আকর্ষণ বোধ করছেন। আগে জ্ঞান ও নীতির জায়গা থেকে রাজনীতি চর্চা হতো। কিন্তু এখন সেই ধারার রাজনীতি আর নেই। এ জন্য আদর্শ ও সৎ চিন্তার চর্চাকারী মানুষগুলো এখন আর রাজনীতিতে আসছেন না।

ব্যবসায়ী এমপির আধিক্যে কোন ধরনের সমস্যা হয়— এমন প্রশ্নে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ড. আতাউর রহমান বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি যখন ব্যবসায় জড়িত থাকেন তখন জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ একজন এমপি যে কিনা ব্যবসায়ীও তিনি জনগণের স্বার্থের চেয়ে তার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেন। তখন রাষ্ট্রীয় সম্পদের বণ্টন যথাযথভাবে হয় না। এমপিরা ব্যবসায়ী হলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টন না হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, রাজনীতি এখন আর তৃণমূলে নেই। জাতীয় নির্বাচন এখন আর টাকা ছাড়া হয় না। বর্তমানের এমপিরা জাতীয় স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেন। পরিস্থিতি উত্তরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা জনগণের। যে প্রতিনিধিরা জনকল্যাণকে প্রাধান্য দেন তাদেরই নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের মধ্যে ইচ্ছাশক্তি আসতে হবে। যদিও এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবে অসম্ভব নয়। রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশের মূল দায় রাজনীতিকদের বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কে এম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় রাজনৈতিক ক্যারিয়ার না থাকার পরও হঠাৎ করে ব্যবসায়ীরা দলে এসেই এমপি হয়ে যাচ্ছেন। দল ও দলীয় মনোনয়নের প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক না হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা সুযোগ পাচ্ছেন। রাজনীতিকরা যখন এমপি পদে দলীয় নমিনেশন দিচ্ছেন তখন রাজনীতির কথা না ভেবে অর্থ-প্রতিপত্তির জন্য ব্যবসায়ীদের দিয়ে দিচ্ছেন। কারণ নির্বাচনে জয়ের জন্য এখন টাকা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আবার দলীয় কর্মকাণ্ডের জন্যও সারা বছরই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। মুনাফা প্রত্যাশী ব্যবসায়ীরাও একে বিনিয়োগ হিসেবে গ্রহণ করে নির্বাচনের সময় এসে এমপি হয়ে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণে ক্ষমতাকে ব্যবহার করছেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর