কাজী নজরুল ইসলাম। সমগ্র বাংলায় খ্যাতি পেয়েছেন বিদ্রোহী কবির। অভিষিক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায়। তার সৃষ্টিকর্ম বাঙালি মুসলমানদের জীবনে আজও জুগিয়ে চলেছে নিরন্তর প্রেরণা। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা এবং সাংবাদিকতা করলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই খ্যাতিমান। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন যুগ সৃষ্টি করেন। বলা চলে, ইসলামি সঙ্গীত তথা বাংলা গজল রচনার পথিকৃৎ তিনি। নজরুল প্রায় তিন হাজার গান রচনা এবং সুর করেছেন। সঙ্গত কারণেই তার কবিতার বিশাল অংশজুড়ে স্থান পেয়েছে ইসলাম প্রসঙ্গও।
নজরুল তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ দিয়েই বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন করে নেন। এ কাব্যগ্রন্থের অর্ধেক কবিতাই ছিল ইসলামি কবিতা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘রণভেরী’, ‘খেয়াপারের তরুণী’, ‘মোহররম’, ‘কোরবানী’, ‘শাত-ইল-আরব’ ‘কামালপাশা’, ‘আনোয়ার’ প্রভৃতি কবিতা। এছাড়াও ‘বিশের বাঁশী’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম’ ‘জিঞ্জির, ‘ঈদ-মোবারক’, ‘আয় বেহেশতে কে যাবি আয়’, ‘চিরঞ্জীব জগলুল’, ‘খালেদ’, ‘ওমর ফারুক’, ‘সুবহে সাদেক’, ‘আমানুল্লাহ’ এবং হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবননির্ভর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘মরু-ভাস্কর’ ও ‘নবযুগ’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং কাব্যগ্রন্থসমূহের আরো অনেক উজ্জ্বল কবিতা ইসলামি ঐতিহ্য, ইসলামি ভাব, ইসলামি জাগরণ, আল্লাহ ও রাসূল ভক্তি নির্ভর প্রচুর কবিতা রয়েছে।
মানবতাবাদী, সৌন্দর্যদীপ্ত, প্রকৃতিনির্ভর যেকোনো নিটোল কবিতাই ইসলামি কবিতা। ইসলাম মূলত শান্তি ও সৌন্দর্যের ধর্ম। তাই শান্তি ও সুন্দরকে উপজীব্য করে সে কেউ যে কবিতা রচনা করবে তাই ইসলামি কবিতা। এ অর্থে নজরুলের প্রায় সব কবিতাই ইসলামি কবিতা। সত্য ও সুন্দরের পক্ষে মানবতার পক্ষে যে কবিতা তৌহিদবাদ অর্থাৎ একত্ববাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, এমন কবিতাই ইসলামি কবিতা।
কবি নজরুল ধ্যানে-জ্ঞানে, নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, চিন্তাচেতনায় ছিলেন পুরোদস্তুর মানবতাবাদী মুসলিম কবি। কবিতায়, গানে, গদ্যে সর্বত্র তার এই দৃষ্টিভঙ্গি উৎকীর্ণ। শোষিত বঞ্চিত মানুষকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন সাম্য ও ন্যায়ের বন্ধনে এক হয়ে শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হতে।
১৩০৬ থেকে ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ। অঙ্কের হিসাবে তার জীবনকাল ৭৭ বছরের। সৃষ্টিশীল ছিলেন মাত্র ২৩ বছর। এই ২৩ বছরের সাহিত্যজীবনে তার বিপুল সৃজনকর্ম বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তার ছড়ানো দ্রোহী চেতনা কাঁপিয়ে দেয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত।
ইসলামি ঐতিহ্য কাজী নজরুল ইসলামকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। ইসলামের পুনর্জাগরণ বা মুসলিম ঐতিহ্য নজরুলের কবিতায় বিপুলভাবে সংবর্ধিত হয়েছিল। তিনি সুফিতত্ত্ব বা সুফিবাদ দ্বারাও প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। ইসলামকে নজরুল তার বিশ্বাসে মণ্ডিত করে প্রকাশ করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম যেমন শোষিত মানুষের কবি, বিদ্রোহের কবি, মানবিকতার কবি, তেমনি ইসলামি আকিদা-বিশ্বাস ও ইসলামি সাম্যবাদেরও কবি। ইসলামকে কবি মনে প্রাণে গ্রহণ করেছেন। ‘আবির্ভাব’ ও ‘তিরোভাব’ এই দু’টি কবিতার সমন্বয়ে তিনি রচনা করেন ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম’ কবিতাটি। ইসলামি জোশ সঞ্জীবিত রাখার ক্ষেত্রে নজরুল তার কবিতা ও অন্যান্য রচনার মাধ্যমে অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছেন। ইসলামের ঝাণ্ডাকে নজরুল সবার ঊর্ধ্বে ঠাঁই দিয়েছিলেন। আন্তরিক উচ্চারণে তিনি ছিলেন আল্লাহর রাহে নিবেদিত।
নজরুল কাব্যে অধ্যাত্মবাদ এবং ইসলামি সাম্য সূচিত হয়েছে মানবিকতায়। তার ইসলামি কবিতা মানবাত্মার বিকাশ ও মানবিকতার উদ্বোধন। আধ্যাত্মিক শক্তি তার আপন আত্মার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মানবিক ধর্ম হচ্ছে আত্মত্যাগ। এই আত্মত্যাগে ইসলাম আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। ভোগীদের সংহার করার প্রেরণা নজরুল কবিতায় উচ্চারিত।
নজরুলের ইসলামি গানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য আমাদের দারুণভাবে মুগ্ধ করে এবং ধর্মীয় ভাবাবেগে আপ্লুত করে। তার ইসলামি চৈতন্য আমাদের আলোড়িত করে। তিনি তার বিশ্বাসকেই মণ্ডিত করেছেন ইসলামি গানে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ও কর্মভাষিক কাঠামো পেয়েছে তার কবিতায়—
‘কত যে রূপে তুমি এলে হযরত এই দুনিয়ায়।
তোমার ভেদ যে জানে আখেরি নবী কয় না তোমায়।
আদমের আগে ছিলে আরশ পাকে তার আগে খোদায়।
আদমের পেশানীতে দেখেছি তব জ্যোতি চমকায়।
ছিলে ইব্রাহিমের মধ্যে তুমি ফুল হলো তাই নমরুদের আগুন।
নুহের মধ্যে ছিলে তাই কিশতী তার ডুবলো না দারিয়ায়’
নজরুল তার কবিতায় দেখিয়েছেন যে, ইসলামের যে ধর্মীয় অনুশাসন, সেই অনুশাসনই প্রকৃত পক্ষে মানুষের ধর্ম। নজরুলের কবিতায় যে আত্মোপলব্ধি, সেই আত্মোপলব্ধিই হচ্ছে অধ্যাত্মবাদের মূল কথা; যা ইসলাম ধর্মের শান্তির উপলব্ধির সাথে একাত্ম।
ইসলাম অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো কাজী নজরুল ইসলামের অন্তরের অন্তঃস্তলে প্রবহমান ছিল। আর তাই ইসলামের অনুশাসনে তিনি তার যাপিত জীবনের আলো হিসেবে ভেবেছেন। আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলার অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বিশ্বাসে, কর্মে তার জীবনে ইসলাম ছিল অবিকল্প।
‘খেয়াপাড়ের তরণী’ কবিতায় নজরুল তাই উচ্চারণ করেন—
‘কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা
দাড়ি মুখে সারি গান লা-শরিক আল্লাহ।’
‘মহররম’ কবিতায় নজরুল উচ্চারণ করেন-
১. ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা,
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’
২. ‘লাল শিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া,
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।’
পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার প্রতি প্রত্যয়ী হওয়াই নজরুলের ইসলামি গানের বৈশিষ্ট্য। নজরুলের কাব্যজীবন স্বভাব ও সচেতনতায় অসাধারণ স্বচ্ছ। কোনো অবস্থাতেই তিনি স্বজাতি ও স্বধর্মকে ভুলে যাননি। বরং রেনেসাঁসী মানুষ হিসেবে নজরুল মুসলিম রেনেসাঁর জন্য অকৃপণভাবে কবিতা ও গান রচনা করেছেন।
নজরুল হামদ ও নাত অসংখ্য রচনা করেছেন। আল্লাহর নৈকট্য লাভের ইচ্ছা, প্রার্থনা ও ক্ষমা ভিক্ষাই হচ্ছে হামদের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য। ক্ষমা ভিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি যে বিচিত্র কৌশল প্রয়োগ করেছেন, তা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। হামদে নজরুল নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছেন পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে। এ ক্ষেত্রে তার মনে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ও সংশয় ছিল না। কায়মনোবাক্যে নজরুল আল্লাহতায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করে উচ্চারণ করেন—
১. ‘করিও ক্ষমা হে খোদা আমি গোনাহগার অসহায়।’
২. ‘ইয়া আল্লাহ, তোমার দয়া কত, তাই দেখাবে বলে রোজ-হাশরে দেখা দেবে বিচার করার স্থলে।’
৩. ‘দীন-ভিখারী বলে আমি ভিক্ষা যখন চাইবো স্বামী, শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে পারবে নাকো আর।’
মুসলমানদের সামাজিক তামুদ্দুনিক মননের ঐতিহ্যভিত্তিক রূপায়ণে অনির্বাণ প্রেরণার মশাল জ্বালিয়েছেন নজরুল। মুমূর্ষু সমাজের নিপীড়িত মানুষের আলেখ্য রচনার পাশাপাশি সমকালীন যুগসমস্যা ও ইসলামের আদর্শকে সমুন্নত করেছেন তিনি কবিতায়। কালের করালস্রোতে যা কোনো দিনই ভেসে যাওয়া তো দূরে থাক, ম্লানও হবে না। নজরুল তার ঈমান রক্ষা ও সুদৃঢ় করার জন্য সমর্পিতচিত্তে ও আন্তরিক উচ্চারণে ইসলামি গান রচনা করেছেন—
১. ‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান।
দাওয়াত এসেছে নয়া জমানার
ভাঙা কিল্লায় ওড়ে নিশান।
মুখেতে কলেমা হাতে তলোয়ার
বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার
হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহর
চল আগে চল বাজে বিষাণ।’
নবীর শহর ও প্রেমের শহর পবিত্র মদিনা মোনওয়ারা। সেই মদিনা নজরুলের কাছে কল্পনার প্রতীক নয়, আকাঙ্খা ও স্বপ্নের প্রতীক। তিনি আল্লাহকে নৌকা ভেবে সেই নৌকায় চড়ে মদিনায় যাবার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন—
‘আল্লাহ নামের নায়ে চড়ি যাব মদিনায়
মোহাম্মদের নাম হবে মোর
ও ভাই নদী পথে পূবাল বায়।।
চার ইয়ারের নাম হবে- মোর সেই তরণীর দাঁড়
কলমা শাহাদাতের বাণী হাল ধরিবে তাঁর।
খোদার শত নামের গুণ টানিব
ও ভাই নাও যদি না যেতে চায়।’
মদিনাকে নিয়ে নজরুলের গুণগানের শেষ নেই। দ্বীনের দাওয়াত, দ্বীন প্রতিষ্ঠায় মদিনার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সে দেশে হিজরত করছিলেন। নবী দৌহিত্র হজরত হাসান-হোসাইন (রা.) ও নবী কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.) সহ অসংখ্য সাহাবির পুণ্যস্মৃতিময় এই মদিনায় ভেসে বেড়ায় তৌহিদের বাণী। নজরুল তার কবিতায় এভাবেই মদিনাকে লালন ও ধারণ করেছেন।
নজরুলকে বাংলার মুসলিম রেনেসাঁর প্রাণপুরুষ বলা হয়। রেনেসাঁর একটা প্রধান ধর্ম হলো- যাবতীয় কুসংস্কার, ভন্ডামি, গোঁড়ামি, নিষ্প্রাণ গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতা ও সকল প্রকার সঙ্কীর্ণতাকে আক্রমণ করে তার জায়গায় সত্য, ন্যায়, উদার মানবিকতা ও চিন্তার স্বাধীনতার জয় ঘোষণা করা। নজরুল তার কবিতায় এটা করে দেখিয়েছেন অত্যন্ত সফলভাবে। তাই তো আমরা দেখি, কবির বহু ইসলামি গান ও কবিতায় এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ক্ষুরধার তরবারি বারবার ঝলসে উঠেছে।
ইসলামি অনুষঙ্গ নিয়ে লেখা নজরুলের কবিতাবলী অবশ্য সব সমান উচ্চমানের নয়। প্রত্যেক কবির ক্ষেত্রেই একথা সত্য। মাঝে মাঝে নজরুল একটু বেশি উচ্চকক্ত, একটু বেশি প্রচারধর্মী। কবি এ সম্পর্কে অসচেতন ছিলেন না, কিন্তু চারদিকের অন্যায়-অবিচার, শঠতা-ধূর্ততা, দুর্বলের ওপর অত্যাচার নির্যাতন, ধর্মের নামে অধর্ম তাকে অস্থির ও চঞ্চল করে তুলতো। এ জন্যই তার রচনায় মানের উত্থান-পতন ও অসমতা। কিন্তু এসত্ত্বেও তার সামগ্রিক সাহিত্যকর্মে একটা মৌলিক ঐক্যবদ্ধ সুর নিরন্তর অনুরণিত।
এভাবে নজরুল শুধু কবিতায় নয়, তার গীতি কবিতা, হামদ-নাত, গজল, ভক্তি সঙ্গীত ও ইসলামি সৌন্দর্যরসে পরিসিক্ত ছিল। নজরুলের ইসলামি কবিতা রচনার মূলে ছিল খোদাপ্রেম এবং রাসূলপ্রেম। আল্লাহ ও রাসূলপ্রেমে পাগল ছিলেন বলেই তার পক্ষে এমন অসাধারণ সব ইসলামি কবিতা রচনা করা সম্ভব হয়েছে।