আজ ভয়াল ২৫ মে। ছয় বছর আগে ২০০৯ সালের এ দিনে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট ‘আইলা’ আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদে। মুহূর্তের মধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলার উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
দুর্যোগের সাত বছরে এখনও আইলা কবলিত এলাকায় রয়েছে নানা সমস্যা। হাজার হাজার মানুষ স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের সুবিধা পায়নি, চাষাবাদসহ কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে, রয়েছে বিশুদ্ধ পানিরও অভাব। এখনও বেঁচে থাকার দুঃসাহসিক সংগ্রাম চলছে দুর্যোগ কবলিত এলাকায়।
ক্ষতিগ্রস্ত আইলা কবলিত এ বিশাল জনপদে খুবই কমসংখ্যক সাইক্লোন সেন্টার রয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
আইলা’র ভয়াবহতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নে বসবাসরত মানুষের চোখে মুখে এখনও ভয়ঙ্কর সেই স্মৃতি। আইলায় চার কিলোমিটারব্যাপী পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ঠাকরুণতলা সড়কটি ধ্বসে পড়ে। ধ্বসে পড়ে গড়কুমারপুর রাস্তাটিও।
আইলার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এ রাস্তা দু’টি এখনও মেরামত না হওয়ায় চাউলখালী গ্রাম ও কালিতলা গুচ্ছগ্রামের দু’শতাধিক পরিবার জনবিচ্ছিন্ন। নৌকাই তাদের একমাত্র ভরসা। আইলার আঘাতের পর থেকে গোটা এলাকা উদ্ভিদশূন্য হয়ে পড়ে। কৃষি ফসল ও চিংড়ি উৎপাদন বন্ধ থাকায় গোটা এলাকাজুড়ে তীব্র কর্মসংস্থানের সংকট দেখা দিয়েছে। কর্মহীন মানুষ অনেকেই এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে বাইরে চলে গেছে।
অপরদিকে বনদস্যুদের অত্যাচারে সুন্দরবন, কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর উপর নির্ভরশীল এ এলাকার মানুষের জীবন যাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। ফলে বিকল্প কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছেন না উপকূলীয় এ জনপদের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। আইলার পরপরই কিছু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কাজের বিনিময় খাদ্য প্রকল্প চালু হলেও এখন আর কোনো কাজ হচ্ছে না। ফলে দরিদ্র ও হতদরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছেই।
এদিকে, আইলার ছয় বছর অতিবাহিত হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধগুলোর ভয়াবহ ফাটল দেখা দেওয়ায় এবং সংস্কার না করায় সামান্য ঝড় কিংবা বৃষ্টিতে ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হচ্ছে এ জনপদের কয়েক লাখ মানুষের। তাই উপকুলীয় এ জনপদের মানুষের সরকারের কাছে দাবি— যেন টেকসই উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
আইলা বিধ্বস্ত শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জি.এম মাসুদুল আলম জানান, দুর্গত এলাকায় এখনও নানা সমস্যায় জর্জরিত। খাবার পানির তীব্র সংকট। আইলায় মিষ্টি পানির আধারগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে। আজও পুকুর বা জলাশয় খনন করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এলাকায় কাজ নেই। বেড়িবাঁধ দিয়ে নদীর নোনা পানি না চিংড়ি ঘেরে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না বিধায় চিংড়ি হচ্ছে না।
শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামের বাসিন্দা জাকির হোসেন জানান, ২০০৯ সালে আইলার দিন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। পরদিন বাড়ি ফিরে দেখতে পান তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নিজেই চিনতে পারছিলেন না তার নিজ বাড়ি। কোনোরকম বেড়ির ওপরে এসে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নেন। পরবর্তী সরকার ও বেসরকারি সহযোগিতায় কোনোরকম ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বর্তমানে তার এলাকায় দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জুড়ে তিনি নিজ উদ্যোগে সামাজিক বনায়ন করেছেন যাতে দুর্যোগে অন্তত তার এলাকা রক্ষা পায়।
একই উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের আবু মুসা জানান, আইলায় তাদের এলাকার ফসল ও গাছ পালার চরম ক্ষতি হয়। তারপর থেকে মানুষ ফসল নিয়ে চরম সংকটের মধ্যে আছে। এখন সরবারি ও বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় এলাকায় সবজি চাষ করছেন। তবে এসব এলাকায় এখনও সুপেয় পানির চরম সংকট রয়েছে বলে জানান তিনি।
আইলার পর থেকে ওই এলাকায় মানুষের উন্নয়নে কাজ করছে বেসরকারি সংগঠন ‘বারসিক’। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক শাহীন ইসলাম জানান, আইলার পর থেকে তার সংগঠন মুলত ওই এলাকার কৃষি উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লবণ সহিষ্ণু ধানের জাত এনে উপকূলীয় এলাকায় চাষ করার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রজাতির ধান সেখানে সফল হয়েছে বলে জানান তিনি। বর্তমানে ওইসব এলাকায় পাটনাই, তালমুগুর, চিনিকানাই, তারশাইল জাতের ধান ওই এলাকার কৃষকরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বীজ তৈরি করে ভাল ফল পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান জানান, বেড়িবাঁধ, সুপেয় পানিসহ যে সব সমস্যা রয়েছে তা সমাধানের জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। নদী ভাঙনরোধ বা বেড়িবাঁধগুলো স্থায়ীভাবে সংস্কার করার জন্য ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে।