ঢাকা ০৬:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সময়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৫২:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ মার্চ ২০২০
  • ২১১ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালে, রাজনীতিতে তার সংশ্লিষ্টতা ১৯৩৯-এ। এই সময়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষে রাজনীতির ধারা প্রবাহিত হয়েছিল কয়েকটি ধারায়।  গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা এবং কর্মীদের সহিংস আচরণের ফলে সেই আন্দোলন প্রত্যাহার একটি বড় ঘটনা। কংগ্রেসের নেতৃত্বে আর যে-দুটি বড় আন্দোলন সংঘটিত হয়, তার একটি ছিল ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলন এবং অন্যটি ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলন।

ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের বদলে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলার প্রস্তাব কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করায় চিত্তরঞ্জন দাশ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ১৯২২ সালে মতিলাল নেহরুর সহযোগে স্বরাজ পার্টি গঠন করেন। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির লক্ষ্যে চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৩ সালে একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ বাংলার মুসলমান নেতাদের সঙ্গে বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদন করেন। ১৯২৫-এ চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে হিন্দু-মুসলমান মিলনের আশা সুদূরপরাহত হয়ে পড়ে। কাকতালীয়ভাবে এর পরের বছরেই সংঘটিত হয় বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। চিত্তরঞ্জনের রাজনৈতিক শিষ্য সুভাষচন্দ্র বসুও ছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপনের এবং হিন্দু-মুসলমানের একযোগে কাজের পক্ষে। ১৯৩৯-এ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেও গান্ধীর বিরোধিতার কারণে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কংগ্রেসের মধ্যেই ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করলে তিনি কিছুকালের জন্য কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন। তখন ফরোয়ার্ড ব্লক স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

তুরস্কের সুলতানের ভাগ্য নিয়ে অসন্তুষ্ট ভারতীয় মুসলমানরা অসহযোগ আন্দোলনের সমকালেই গড়ে তুলেছিল খিলাফত আন্দোলন। গান্ধীর সমর্থনলব্ধ খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন কিছুকাল হাত ধরাধরি করে চলেছিল, তারপর তা থেমে যায়। প্রায় পাঁচ বছর নিষ্ক্রিয়তার পরে ১৯২৪ সালে পুনরুজ্জীবিত হয় মুসলিম লীগ। ১৯৩০ সালে ইকবাল উপস্থাপন করেন ভারতীয় মুসলমানদের পৃথক বাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি। জিন্নাহ লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসন থাকা অবস্থায় ১৯২৪ সালে গৃহীত হয় লাহোর প্রস্তাব।

১৯২৫-এ নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ঘটে। অন্যদিকে স্বদেশী বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত কর্মীরা সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৩৯ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদের যুদ্ধ ছিল এদের গৌরবময় মুহূর্ত। তার পরও বাংলায় ও বাংলার বাইরে রাজকর্মচারী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা অব্যাহত থাকে।

কংগ্রেস ও বৃহত্তর হিন্দু সমাজের আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়লাভ করে একে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টি। মুসলিম লীগের সঙ্গে তিনি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন এবং ১৯৪০ সালে লীগের অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৪১ সালে মুসলিম লীগ এই কোয়ালিশন থেকে বেরিয়ে আসে। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার সঙ্গে মিলে তিনি আবার মন্ত্রিসভা গঠন করেন; কিন্তু গভর্নরের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে ১৯৪৩-এ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (ঢাকা, ২০১২) পড়ে আমরা জানতে পারি, ১৯৩৬ সালে তিনি স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত হন। তার ভাষায়—

তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। (পৃ. ৯)

এই পূর্ণচন্দ্র দাস ছিলেন বাঘা যতীনের সহকর্মী। মাদারীপুরে একসময় তিনি নিজেই একটি বিপ্লবী দল গড়েছিলেন। ১৯১৪ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। পরে তিনি ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন। আবার ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত কারাগারে থাকেন। শেখ মুজিব বলছেন, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে স্বদেশীদের সভায় তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকেন। ফলে তিনি মনে-প্রাণে ইংরেজ শাসনবিরোধী হয়ে ওঠেন এবং সুভাষচন্দ্র বসুর একজন ভক্তে পরিণত হন।

১৯৩৮ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে আসেন। তাদের আগমনের সম্ভাবনায় বেশ আলোড়নের সৃষ্টি হয়। সভা ও প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দলমত নির্বিশেষে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। পরে দেখা যায়, হিন্দু ছাত্ররা এই বাহিনী থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। কংগ্রেস থেকে নাকি তাদের নিষেধ করা হয়েছে এতে যোগ দিতে। এমনকি এদের বিরূপ সংবর্ধনা দেয়ারও একটা প্রস্তুতির খবর পাওয়া যায়। শেখ মুজিব লিখেছেন—

আমি এ-খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো—সবই চলত।

আমাদের নেতারা বললেন, হক সাহেব মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন বলে হিন্দুরা ক্ষেপে গিয়েছে। এতে আমার মনে বেশ একটা রেখাপাত করল। হক সাহেব ও শহীদ সাহেবকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। তার জন্য যা কিছু প্রয়োজন আমাদের করতে হবে। আমি মুসলমান ছেলেদের নিয়েই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম, তবে কিছু সংখ্যক নমঃশূদ্র শ্রেণীর হিন্দু যোগদান করল। কারণ, মুকুন্দবিহারী মল্লিক তখন মন্ত্রী ছিলেন এবং তিনিও হক সাহেবের সাথে আসবেন। শহরে হিন্দুরা সংখ্যায় খুবই বেশি, গ্রাম থেকে যথেষ্ট লোক এল, বিশেষ করে নানা রকম অস্ত্র নিয়ে, যদি কেউ বাধা দেয়! যা কিছু হয়, হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হতে পারত। [পৃ. ১১]

সৌভাগ্যবশত শান্তিপূর্ণভাবে সবকিছুর সমাধা হয়। এই উপলক্ষেই সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার পরিচয় এবং পত্র-বিনিময় ঘটে।

এই সময়েই ‘হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটু আড়াআড়ি’র পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল মালেক নামে শেখ মুজিবের এক সহপাঠীকে স্থানীয় হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে মুজিব তার দলবল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে ছেড়ে দিতে বলেন। শেষে দু-পক্ষ মারামারি লেগে যায়। মুজিবের দল ঘরের দরজা ভেঙে মালেককে উদ্ধার করে আনেন। স্বভাবতই এতে মামলা হয় এবং শেখ মুজিবকে সাতদিন জেলহাজতে থাকতে হয়। ‘এই আমার জীবনে প্রথম জেল।’

সময়ের উল্লেখ নেই, তবে ছুঁতমার্গের একটি ঘটনা যে তাকে খুব পীড়িত করেছিল, তা তিনি বলেছেন—

একদিনের একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমার সাথে কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকিমাও আমাকে ভালোবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম, ‘ননী কী হয়েছে?’ ননী আমাকে বলল, ‘তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পরে কাকিমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকে ঘর ধুতে বাধ্য করেছে।’ বললাম, ‘যাব না, তুই আসিস।’ আরো অনেক হিন্দু ছেলের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু আমার সহপাঠীরা আমাকে কোনোদিন এ কথা বলে নাই। অনেকের মা ও বাবা আমাকে আদরও করেছেন। এই ধরনের ব্যবহারের জন্য জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে বাঙালি মুসলমান যুবকদের ও ছাত্রদের মধ্যে। শহরে এসেই এই ব্যবহার দেখেছি। [পৃ. ২৩]

এই ভেদাভেদের জন্য পরে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তার মনে হয়েছে, হিন্দু-মুসলমান বিরোধের অন্তর্নিহিত কারণ যেমন করে রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষ বসু অনুধাবন করেছিলেন, আর কেউ তেমনটা করেননি।

সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সেই সামান্য পরিচয়ের সূত্র ধরে শেখ মুজিব ১৯৩৯ সালে কলকাতায় গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ফিরে এসে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠন করেন। ছাত্রলীগের সম্পাদক হন তিনি নিজে, মুসলিম লীগের সম্পাদক আরেকজন হলেও মূল কাজ তাকেই করতে হতো। মাদারীপুরেও মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয় তারই প্রচেষ্টায়।

১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাস করে শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন, থাকেন বেকার হোস্টেলে, সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন রাজনীতি নিয়ে। তখন লাহোর প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে, সুতরাং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়ে ওঠে তার ধ্যানজ্ঞান। পাকিস্তান বলতে তিনি বোঝেন দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র—একটি পুবে, অন্যটি পশ্চিমে। আবুল হাশিম তাদের বুঝিয়েছেন, ‘পাকিস্তান দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দু মুসলমানদের মিলানোর জন্য এবং দুই ভাই যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সুখে বাস করতে পারে তারই জন্য।’ এদিকে জিন্নাহর সঙ্গে মনোমালিন্যের ফলে পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপক একে ফজলুল হক মুসলিম লীগ ত্যাগ করে গেছেন। সুতরাং মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে শেখ মুজিবও তার বিরোধিতায় মুখর হন। তার পিতামাতা তাকে নিষেধ করেছিলেন হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে। সে-নিষেধ তিনি শোনেননি। এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন এই ভাষায়—

শেরেবাংলা মিছামিছিই ‘শেরেবাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়ই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন—দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব।’ এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাই বললাম। শুধু এইটুকু না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, মার খেয়ে। কয়েকবার মার খেয়ে আমাদের বক্তৃতার মোড় ঘুরিয়ে দিলাম। [পৃ. ২২]

পরে ফজলুল হকের আমন্ত্রণে ইসলামিয়া কলেজের কয়েকজন ছাত্র-প্রতিনিধিকে নিয়ে শেখ মুজিব দেখা করেন তার সঙ্গে। ফজলুল হক বলেন, তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করেননি, মুসলিম লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জিন্নাহ তার জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারেন না। ছাত্র-প্রতিনিধিরা ফজলুল হককে আবার মুসলিম লীগে ফিরে আসার অনুরোধ জানিয়ে বিদায় নেন। ফজলুল হক অবশ্য মুসলিম লীগে ফিরে আসেন, তবে ১৯৪৬ সালের আগে।

দুই.

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনা হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সহযোগিতা কামনা করে এবং যুদ্ধ শেষ হলে ভারতের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন বিবেচনার আশ্বাস দেয়।

১৯৪১ সালে কলকাতায় অন্তরীণ-অবস্থা থেকে পালিয়ে কাবুল ও মস্কো হয়ে সুভাষচন্দ্র বসু পৌঁছান বার্লিনে। সেখানে হিটলারের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়, তিনি বার্লিন বেতার থেকে ভাষণ দেন। এ-বছরেই জাপানে ব্রিটিশ ভারতীয় বন্দি সৈন্যদের নিয়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) গঠিত হয়। ১৯৪৩-এ সুভাষ জার্মানি থেকে সাবমেরিনে করে সাবাঙে পৌঁছান, সেখান থেকে যান টোকিওতে। তিনি তখন আইএনএর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, আজাদ হিন্দ ফৌজ সরকার গঠন করেন এবং জাপান থেকে ভারতের উদ্দেশে বেতার-ভাষণ দিতে থাকেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ একসময়ে ভারতের মাটিতে পৌঁছে যায় এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপগুলোকে স্বাধীন ঘোষণা করে তার শাসনভার গ্রহণ করে। দ্বীপ দুটির নতুন নামকরণ হয় যথাক্রমে শহীদ ও স্বরাজ। পরে অবশ্য আজাদ হিন্দ ফৌজ পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। জাপানের আত্মসমর্পণের পর এদের সব তৎপরতার অবসান হয়, ১৯৪৫-এর ১৭ আগস্ট সুভাষ অন্তর্ধান করেন। ভারতে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের বিচার হয়, তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন রশিদ আলীর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই সূত্র ধরে দেখা দেয় ভারতীয় নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ—তার ছোঁয়ায় বিমান বাহিনীতেও বিদ্রোহ ঘটে। তা ব্রিটিশ সরকারের জন্য বেশ বিব্রতকর হয়ে ওঠে।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে মুসলমানদের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪২ সালে চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারি দল থেকে পদত্যাগ করেন। এই বছরেই কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন গড়ে তোলে। গণ সত্যাগ্রহ ছিল এর একটা বৈশিষ্ট্য। পরের বছর মুসলিম লীগ ধ্বনি তোলে ‘ভাগ করো এবং দেশ ছাড়ো’।

১৯৪২ সালে বাংলায় দেখা দেয় ভয়াবহ মন্বন্তর। সরকারি হিসাবে ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়, বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা দাবি করা হয় ৩৫ লাখ।

খাজা নাজিমুদ্দিন তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী, সোহরাওয়ার্দী বেসামরিক সরবরাহমন্ত্রী—খাদ্যের দায়িত্ব তার। ১৯৪৫ সালের মার্চে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা আস্থা হারিয়েছেন গণ্য করে প্রদেশে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করা হয়। ১৯৪৬ সালের মার্চ-এপ্রিলে হয় প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচন। বাংলায় মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।

১৯৪৩ সালে ভারতীয় সমস্যার সমাধানে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ চেষ্টা করে। যুদ্ধের শেষে ভারতে আসে ক্যাবিনেট মিশন। তার প্রস্তাব যখন লীগ ও কংগ্রেস উভয় পক্ষ স্বীকার করে নেয়, তখন জওহরলাল নেহরুর এক বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব গ্রহণে আপত্তি জানায়। এই সূত্র ধরেই মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করে। সেদিন সূচনা হয় কলকাতার বৃহত্তম সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের। পরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী ও বিহারে। ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যে ভারতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে কংগ্রেস ও লীগকে সম্মত করায়। ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। নতুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগের সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে কংগ্রেস নেতারা দেশ বিভাগকেই সমাধান বলে মেনে নেন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত বিভাগ এবং সেই সঙ্গে বাংলা ও লাহোর বিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের বিরোধিতা করেন জিন্নাহ। তাকে যখন বলা হয়, যে-যুক্তিতে তিনি এই দুই প্রদেশ বিভাগের বিরোধিতা করছেন, তা ভারত বিভাগ সম্পর্কেও প্রযোজ্য, তখন তিনি চুপ করে যান। মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ এগিয়ে নিয়ে আসেন ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে। লীগ-কংগ্রেস মাউন্টব্যাটেন-পরিকল্পনা মেনে নেয়। মাউন্টব্যাটেন-পরিকল্পনা ঘোষণার আগেই সোহরাওয়ার্দী অখণ্ড সার্বভৌম বাংলা গঠনের প্রস্তাব করেন দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে। পরে লীগের সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের শরত্চন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায় মিলিতভাবে বাংলাকে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের বাইরে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে রাখার প্রয়াস চালান। শেষ পর্যন্ত তারা সফল হননি। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে ২০ জুন বঙ্গ বিভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ও ১৫ আগস্ট ভারতের রাষ্ট্রীয় সত্তার প্রতিষ্ঠা ঘটে।

একটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়নি। ১৯৪৬-এর ডিসেম্বরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির, বিশেষ করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার কমিউনিস্ট নেতাদের উদ্যোগে তেভাগা আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে কৃষকদের মধ্য থেকেও এর নেতাদের আবির্ভাব ঘটে। উত্তরে দিনাজপুর থেকে দক্ষিণে চব্বিশ পরগনা পর্যন্ত বাংলার ১৯টি জেলায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রাদেশিক পরিষদে সরকার একটি বর্গা বিল আনেন ১৯৪৭ সালে। তাতে আন্দোলন থেমে যায়, কিন্তু বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার আগে বঙ্গ বিভাগ ঘটে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে অনেক জায়গায় নতুন করে তেভাগা আন্দোলন দেখা দেয়। এই আন্দোলন দমিত হলেও কৃষকরা এর থেকে কিছু সুবিধা পেয়েছিল।

এখন আমরা ফিরে যাব শেখ মুজিবুর রহমানের কথায়। যেখানে তার প্রসঙ্গ থেমে গিয়েছিল, শুরু করতে হবে সেখান থেকে।

আবুল হাশিমের প্রেরণায় কলকাতায় শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের সার্বক্ষণিক কর্মী (‘হোলটাইম ওয়ার্কার’) হয়ে ওঠেন। আবুল হাশিমের কাছে তিনি রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো কেমন হবে, জনসাধারণকে সে-কথা জানানো প্রয়োজন, এই উপলব্ধি থেকে আবুল হাশিম একটি ম্যানিফেস্টো তৈরি করেন। তাতে জমিদারি প্রথা বিলোপের প্রতিশ্রুতি ছিল। এই ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিব খুব উত্সাহী ছিলেন। তবে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতাদের কারণে এটি প্রচারিত হতে পারেনি। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের উপদলীয় দ্বন্দ্বে মুজিব ছিলেন পুরোপুরি সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের পক্ষে। এই উপদলীয় দ্বন্দ্ব মুসলিম ছাত্রলীগেও সংক্রমিত হয়। এই দ্বন্দ্বে শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উপদল দুটিকে তিনি অভিহিত করেন প্রগতিবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বলে। তার দৃষ্টিতে—

শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় নাই, জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। কাউকে লীগে আসতে দিত না। জেলায় জেলায় খান বাহাদুররাই লীগকে পকেটে করে রেখেছিল। [পৃ. ১৭]

এখানে জনপ্রতিনিধিদের আচরণ সম্পর্কে তার এক অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করার মতো। নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা ব্যবস্থাপক পরিষদে এক ভোটে পরাজিত হয়েছিল। সন্দেহ করা হয়েছিল যে এমএলএ কেনাবেচা হচ্ছে। তখন তাদের ওপর নজরদারির দায়িত্ব শেখ মুজিব ও তার মতো আরো কয়েকজনের ওপর বর্তেছিল। তিনি লিখেছেন—

একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হলো। তিনি বারবার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে, কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে বললেন, ‘আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি, আমাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব।’ আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্য দলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের! এই ভদ্রলোককে একবার রাস্তা থেকে আমাদের ধরে আনতে হয়েছিল। শুধু সুযোগ খুঁজছিলেন কেমন করে অন্য দলের কাছে যাবেন। [পৃ. ৩৩-৩৪]

জনসাধারণের প্রতি শেখ মুজিবের মতো মানুষের অঙ্গীকার ছিল সুস্পষ্ট। তার পরিচয় পাওয়া যায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময়ে ত্রাণকার্যে, প্রাদেশিক নির্বাচনের কালে প্রচারকার্যে এবং কলকাতার সেই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিনগুলোতে বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করার কাজে। দুর্ভিক্ষের সময়ে শেখ মুজিব দিনভর লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন, রাতে কখনো হোস্টেলে ফিরে এসেছেন, কখনো মুসলিম লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে রাত কাটিয়েছেন। এরই মধ্যে ত্রাণকার্যে তিনি গোপালগঞ্জেও এসেছেন। নির্বাচনের সময় মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদেরও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে, তিনি পিছু হটেননি। দাঙ্গার সময়ে মুসলমান ছাত্রীদের উদ্ধার করা, আহতদের শুশ্রূষার ব্যবস্থা করা, এলাকা পাহারা দেয়া—এমন বহুবিধ দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়েছে। মুসলমানদের যেমন উদ্ধার করেছেন, তেমনি মুসলমান এলাকা থেকে হিন্দুদের উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছেন।

এসব নিয়ে দু-একবার আক্রান্তও হতে হয়েছে তাকে। তার কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত অনেক পরে নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে, সে-সময়ে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্র অনেকদিন ধরে তাকে বিপত্সংকুল এলাকা পার করে নিরাপদ অঞ্চলের সীমানায় পৌঁছে দিয়েছে। পরে, বিহার দাঙ্গার সময়েও, তিনি এবং তার বন্ধুরা দুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন এবং বঙ্গীয় সরকারের সহযোগিতায় অনেক বাস্তুত্যাগী পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

এখানে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে শেখ মুজিবের মনোভাবের বিষয়টা উদ্ধৃত করি—

আমাদেরও ইংরেজের বিরুদ্ধে একটা জাত ক্রোধ ছিল। হিটলারের ফ্যাসিস্ট নীতি আমরা সমর্থন করতাম না, তথাপি যেন ইংরেজের পরাজিত হওয়ার খবর পেলেই একটু আনন্দ লাগত। এই সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যদের নিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। মনে হতো, ইংরেজের থেকে জাপানই বোধ হয় আমাদের আপন। আবার ভাবতাম, ইংরেজ যেয়ে জাপান আসলে স্বাধীনতা কোনোদিনই দিবে না। জাপানের চীন আক্রমণ আমাদের ব্যথাই দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর থেকে সুভাষ বাবুর বক্তৃতা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। মনে হতো, সুভাষ বাবু একবার বাংলাদেশে আসতে পারলে ইংরেজকে তাড়ানো সহজ হবে। আবার মনে হতো, সুভাষ বাবু আসলে তো পাকিস্তান হবে না। পাকিস্তান না হলে দশ কোটি মুসলমানের কী হবে? আবার মনে হতো, যে নেতা দেশ ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন তিনি কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। মনে মনে সুভাষ বাবুকে তাই শ্রদ্ধা করতাম। [পৃ. ৩৫-৩৬]

যে-স্বপ্নের পাকিস্তান নিয়ে এত আবেগ, তারই রূপান্তর ঘটে গেল স্বপ্ন বাস্তবায়নেরও আগে। ১৯৪৭-এর এপ্রিলে দিল্লিতে জিন্নাহ ডাকলেন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের লীগ-দলীয় সদস্যদের কনভেনশন। বাংলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে শেখ মুজিবসহ দশ-পনেরো জন ছাত্রকর্মীও চললেন বিশেষ ট্রেনে। বাংলায় স্লোগান দিতে দিতে সভায় যোগ দিলেন তারা। জিন্নাহর নির্দেশে সেখানে ‘লাহোর প্রস্তাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে ছোট কিন্তু মৌলিক রদবদল করা হলো।’ যেখানে আগে ‘স্টেটস’ বলা হয়েছিল, সেখানে হলো ‘স্টেট’। এই প্রস্তাব উত্থাপন করলেন সোহরাওয়ার্দী। তাতে আবুল হাশিম ‘আর সামান্য কয়েকজন’ প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু প্রস্তাব পাস হয়ে গেল। শেখ মুজিব লিখেছেন—

১৯৪০ সালে লাহোরে যে প্রস্তাব কাউন্সিল পাস করে সে প্রস্তাব আইনসভার সদস্যদের কনভেনশনে পরিবর্তন করতে পারে কিনা এবং সেটা করার অধিকার আছে কি না, এটা চিন্তাবিদরা ভেবে দেখবেন। কাউন্সিলই মুসলিম লীগের সুপ্রিম ক্ষমতার মালিক। পরে আমাদের বলা হয়, এটা কনভেনশনের প্রস্তাব, লাহোর প্রস্তাব পরিবর্তন করা হয় নাই। [পৃ. ৬২]

এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার কথা হয়েছিল কিনা, তা জানা যায় না।

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস সম্পর্কে সোহরাওয়ার্দী কর্মীদের বলে দিয়েছিলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে যেন এই দিনটা পালন করা হয়। কোনো গোলমাল হলে মুসলিম লীগ সরকারের বদনাম হবে।’ আবুল হাশিমের বক্তব্য ছিল আরো তাত্পর্যপূর্ণ: ‘তোমাদের মহল্লায় মহল্লায় যেতে হবে, হিন্দু মহল্লায়ও তোমরা যাবে। তোমরা বলবে, আমাদের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, আসুন আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই দিনটা পালন করি।’ ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতারা এসব কথা শুনে মুসলিম লীগ অফিসে এসে দিনটি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করার প্রস্তাব দেন; কিন্তু কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার বিরোধিতা অপরিবর্তিত রয়ে যায়। তারা বলেন, এই কর্মসূচি হিন্দুর বিরুদ্ধে। ১৬ আগস্ট সরকারি ছুটি ঘোষিত হওয়ায় তাদের ক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পায়। শেখ মুজিব সাক্ষ্য দিয়েছেন, শান্তিরক্ষার জন্য সোহরাওয়ার্দী রাতদিন পরিশ্রম করেছেন।

সার্বভৌম বাংলার দাবি সম্পর্কে শেখ মুজিবের অভিমত, বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এই ফর্মুলা গ্রহণ করেছিল। মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন, নাজিমুদ্দিনও বলেছিলেন, যুক্ত বাংলা হলে হিন্দু-মুসলমানের মঙ্গলই হবে। এই ফর্মুলা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও শরত্ বসু জিন্নাহ ও গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। শরত্ বসুকে শেখ মুজিব উদ্ধৃত করেছেন এই বলে যে, জিন্নাহ বলেছিলেন, এতে মুসলিম লীগের আপত্তি নেই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। গান্ধী ও নেহরু শরত্ বসুকে পাঠিয়ে দেন সরদার প্যাটেলের কাছে, ‘খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন’ শরত্ বসুকে। শেখ মুজিব নিজে যে এ প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন, তা খুবই স্পষ্ট।

সিলেট গণভোটে বিজয়ী হয়ে কলকাতায় ফিরে শেখ মুজিব জানতে পারলেন, পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচনে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। দুদেশের মধ্যে সম্পদের ন্যায্য ভাগ-বাঁটোয়ারার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সবাই নেতা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। সোহরাওয়ার্দী কারো কাছে ভোট চাইলেন না, টাকা-পয়সা খরচ করতে অস্বীকার করলেন এবং কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিলেন না। তিনি জমিদারি প্রথা বিলোপ করে দেবেন—এ আশঙ্কায় নাকি সিলেটের ১৭ জন সদস্যের ১৪ জনই খাজা নাজিমুদ্দিনকে ভোট দেন। ফলে সেদিকেই পাল্লা ভারী হয়।

শেখ মুজিব এটাকে দেখেন সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের কিছুসংখ্যক নেতার ষড়যন্ত্র বলে। ভারতীয় লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, পূর্ব পাঞ্জাবের মাসদোত পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী হবে, শুধু পশ্চিমবঙ্গের লোক বলে সোহরাওয়ার্দীকে—যিনি বাংলাদেশের এমএলএদের দ্বারা সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত নেতা, তাকে—পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হতে হলে আবার নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে। শেখ মুজিবের মতে, পাকিস্তানে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সেই শুরু।

তিন

প্রথম থেকেই পাকিস্তানে গণতন্ত্রচর্চার অভাব ছিল। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নেতারা কোনো রকম বিরোধিতা সহ্য করতে পারতেন না। বিরোধী দলের সবাইকে রাষ্ট্রবিরোধী বলার প্রবণতা ছিল ব্যাপক। কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস এবং নবপ্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ—সবাই ছিল এই প্রচারণার শিকার। পূর্ব বাংলায় একটি উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয়ের পর যতদিন সম্ভব নির্বাচন বা উপনির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা হয়। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সম্পর্কে দেশের কোনো মতৈক্য গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে প্রথম গণপরিষদের পক্ষে সংবিধান প্রণয়ন সম্ভবপর হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতালিপ্সা ও সুবিধাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আঁতাত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জনপ্রতিনিধিদের অনৈতিক দলবদলের ফলে একের পর এক সরকার স্থিতিশীলতা হারাতে থাকে। এ সুযোগে গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়। সামরিক শাসন যে গণতন্ত্রের বিকল্প নয়, সে কথা বুঝতে মানুষের কিছু সময় লাগে। ততদিনে দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণে সমর্থ হয়।

কেন্দ্র ও প্রদেশের সম্পর্ক ছিল পাকিস্তানের একটি বড় সমস্যা। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি মুসলিম লীগ ভুলে গিয়েছিল ক্ষমতায় এসে। পাকিস্তানের দুই অংশের দূরত্বের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে শক্তিশালী কেন্দ্র অপরিহার্য, এমন একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা চলছিল। পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের দাবি যেমন ক্রমশ প্রবল হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকে এক ইউনিটভুক্ত করলে পাঞ্জাব ছাড়া বাকি তিন প্রদেশেই অসন্তোষ দেখা দেয়। অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব বাংলা যে বৈষম্যের শিকার, এ-সত্য ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ছয় দফা প্রস্তাব অভিহিত হয় পূর্ব বাংলার বাঁচার দাবি হিসেবে।

আরেকটি সমস্যা ছিল রাষ্ট্রে ধর্মের স্থান নিয়ে। পাকিস্তান গণপরিষদের উদ্বোধনী ভাষণে জিন্নাহ বলেছিলেন, ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, তার সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক থাকবে না। তার উত্তরসূরিরা সে কথা মানেননি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহারের খেলায় তারা মেতে ওঠেন। যে-জামাতে ইসলামী দল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল, তারাই এখন রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে দেশে ইসলামী শাসন প্রবর্তনের দাবিদার হয়ে উঠল। সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক লক্ষ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে তারা কাদিয়ানি-বিরোধী দাঙ্গা বাধিয়ে ফেলে। মুসলিম লীগের রাজনীতি অধিকতর সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করে। পূর্ব বাংলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যেসব দাঙ্গা ঘটে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি লোকজনের উসকানি ছিল।

১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে দেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬২ সালের দ্বিতীয় সংবিধানের খসড়ায় পাকিস্তানকে কেবল প্রজাতন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়, পরে নানা আপত্তির মুখে ইসলামী প্রজাতন্ত্র কথাটা ফিরে আসে। এর ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যা ছিল, তা এই: রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলিম; কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না; অনুরূপ কোনো আইন বিদ্যমান থাকলে তা যথোপযুক্তরূপে সংশোধিত হবে; সরকারকে এসব বিষয়ে উপদেশ দেয়ার জন্য একটা ওলামা পরিষদ থাকবে। তবে এর ফলে আইনকানুনের ব্যাপক কোনো পরিবর্তন হয়নি, ওলামাদের ক্ষমতাও তেমন বৃদ্ধি পায়নি।

বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তান প্রথম থেকেই ছিল পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর অনুসারী। পরে দেশটি একাধিক মার্কিন সামরিক জোটের অংশীদার হয়। ভারতের সঙ্গে বৈরিতা ছিল পররাষ্ট্রনীতির একটা মূল স্তম্ভ। তা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের রূপ নেয় দুবার। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময়ে পূর্ব বাংলা অরক্ষিত থাকে বলে দেখা যায়। তাতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রবল হয়। শান্তি চুক্তির বলে যুদ্ধের অবসান ঘটে বটে, কিন্তু সে-চুক্তি পশ্চিম পাকিস্তানে অসন্তোষের কারণ হয় এবং শাসনকর্তার লৌহমানব ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে।

কিছুকাল পরে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেশকিছু সামরিক-বেসামরিক বাঙালি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এতে সরকারের অভিপ্রায়ের বিপরীত ফল ফলে। দেশব্যাপী গণ-অভ্যুত্থানের ফলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে বিদায় নিতে হয়, কিন্তু তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন আরেক সামরিক শাসকের কাছে। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে দেন এবং ‘একজন এক ভোটে’র ভিত্তিতে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের অনুষ্ঠান করেন। তাতে সরকারের অভিপ্রেত ফল লাভ হয়নি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ক্ষমতাসীন চক্রের অস্বীকৃতি শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় পূর্ব বাংলায় গণহত্যায়। তা অনিবার্য করে তোলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান তার পূর্বাঞ্চল হারায়, আমরা লাভ করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

ফিরে যাই ১৯৪৭ সালে। শেখ মুজিব যখন কলকাতার সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে বিদায় নেন, তখন তাকে সোহরাওয়ার্দী উপদেশ দিয়েছিলেন, পাকিস্তানে যেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা না হয়, তা দেখতে। সেখানে দাঙ্গা হলে ভারতে মুসলমানরা বিপদগ্রস্ত হবে। তাই ঢাকায় আসার পূর্বক্ষণে মুজিবের ভাবনা ছিল এ রকম: ‘পাকিস্তান হয়েছে, আর চিন্তা কি? এখন ঢাকায় যেয়ে ল ক্লাসে ভর্তি হয়ে কিছুদিন মন দিয়ে লেখাপড়া করা যাবে। চেষ্টা করব, সমস্ত লীগ কর্মীদের নিয়ে, যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়।’ সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় এসে তিনি শোনেন, শামসুল হকের উদ্যোগে মুসলিম লীগ কর্মীদের একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে একটি যুব সংগঠন করার উদ্দেশ্যে, তবে সরকার সেটা ভালো চোখে দেখছে না। মুজিব বললেন, ‘যুব প্রতিষ্ঠান একটা করা যায়, তবে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত হবে কিনা চিন্তা করে দেখেন। আমরা এখনো মুসলিম লীগের সভ্য আছি।’ শামসুল হক তাকে আশ্বস্ত করেন যে রাজনৈতিক সংগঠন গড়া হচ্ছে না। অধিবেশনে গিয়ে মুজিব মতপ্রকাশ করলেন যে এ প্রতিষ্ঠানের একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়। কিন্তু তার দৃষ্টিতে, কিছু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন কর্মী অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেয়ার প্রস্তাব করলেন। মুজিবের মনে হলো, তাহলে তো একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে যাবে। তার আরো মনে হলো, ‘দুই মাস হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন কোনো দাবি করা উচিত হবে না।’ বরঞ্চ এখন বিশেষ প্রয়োজন সাম্প্রদায়িক মিলনের কথা বলা। শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠার এই উদযোগের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক রাখলেন না। মোগলটুলিতে যেখানে মুসলিম লীগের অফিস ছিল, সেখানে যুবলীগেরও অফিস খোলা হয়েছিল। শেখ মুজিব ও তার বন্ধুরা সেখান থেকে যুবলীগের সাইনবোর্ড নামিয়ে দিলেন, তাদের জিনিসপত্র নিয়ে চলে যেতে বললেন। তা হওয়ার আগেই সে-বাড়ি তল্লাশি হলো, আইবির খাতায় তাদের নাম উঠল। যে অফিস থেকে পাকিস্তান আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে এখন গোপনে গোয়েন্দা পাহারা বসল। তার কারণ, তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমরা সকলে শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলাম।’ ১৫০ মোগলটুলিতে ন্যাশনাল গার্ডের দপ্তরও খোলা হয়েছিল, সরকারি চাপে সেই প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে গেল। ওদিকে কেন্দ্র থেকে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ভেঙে দেয়া হলো। ক্ষোভ ও বিস্ময়ের সঙ্গে মুজিব জানতে পারলেন, তারা আর লীগ কাউন্সিলের সদস্য নেই, প্রকৃতপক্ষে বিতাড়িত হয়েছেন মুসলিম লীগ থেকেই।

এসব কথা বিস্তারিত করে বললাম শুধু এটি বোঝাতে যে উপদলীয় সংঘাত সত্ত্বেও তখন পর্যন্ত শেখ মুজিব মুসলিম লীগকেই তার রাজনৈতিক সংগঠন ও কর্মক্ষেত্র বলে গণ্য করেছিলেন। তার সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি তখনো রাজনৈতিক নেতা নন, কর্মীমাত্র। আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, নইমউদ্দীন আহমদ—তুলনামূলকভাবে এরাই নেতৃস্থানীয়। এদের মধ্যে কাউকে তিনি চিনতেন, কাউকে চিনতেন না। বরঞ্চ কর্মীদের মধ্যে শওকত মিয়া, আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, দবিরুল ইসলাম, আবদুল হামিদ চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মতিন খান চৌধুরী—এদের অনেকের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিল। শেখ মুজিব বরাবর কলকাতাকে কেন্দ্র করে কাজ করেছেন। ঢাকায় তার কোনো নিজস্ব ভিত্তি ছিল না, সমর্থকগোষ্ঠীও ছিল না। তবে কলকাতা থেকে যেসব কর্মী দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, তাদের অনেকেই তাকে জানতেন। তিনি চেষ্টা করলেন সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমপন্থী সক্রিয় নেতাদের সঙ্গে মিশে কাজ করতে। এর প্রকৃত সূচনা ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। সরকার পৃষ্ঠপোষিত এবং শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বিপরীতপক্ষে সেদিন প্রতিষ্ঠিত হলো পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ—নইমউদ্দীন আহমদ হলেন তার আহ্বায়ক। অলি আহাদ ও মোহাম্মদ তোয়াহা ‘মুসলিম’ শব্দটি সংগঠনের নাম থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন, মুজিব তার বিরোধিতা করেন এই বলে যে তাহলে সরকার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নতুন সংগঠন সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। এ থেকেও শেখ মুজিবের তখনকার মানসিকতা সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। উল্লেখযোগ্য যে ওই মুসলিম শব্দ রাখার কারণেই অলি আহাদ এ সংগঠনে যুক্ত হতে অস্বীকার করেন। শেখ মুজিব জানিয়েছেন যে নইমউদ্দীন আহ্বায়ক হলেও সংগঠনের প্রায় সবকিছু তাকেই করতে হতো।

ফেব্রুয়ারি মাসেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যোগ দেয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ১১ মার্চে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সামনে পিকেটিং হয় এবং সেসব জায়গায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে, পরে কিছুসংখ্যক কর্মীকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। ছাত্রদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীর একটি চুক্তিস্বাক্ষর হলে চারদিন পর তিনি মুক্তি পান। ১৯ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর বক্তব্যের তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ যারা করেন, মুজিব ছিলেন তাদের একজন।

এরপর তাকে দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে ভূমিকা পালন করতে। ফলে প্রথমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন, পরে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তিনি জেলে থাকতেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় সরকারবিরোধী নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। কারাবন্দি শেখ মুজিবকে তার যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। তিনি মুক্তি পান জুলাই মাসে, আবার গ্রেফতার হন ডিসেম্বরে। এবার প্রায় আড়াই বছরের কারাবাস। তার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। শেখ মুজিব লিখেছেন যে সেই আন্দোলনের কিছু আগে বন্দি অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় আন্দোলন সম্পর্কে তিনি পরামর্শ দেন অলি আহাদ ও মোহাম্মদ তোয়াহাকে—তারা গোপনে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। নিজেদের মুক্তির দাবিতে শেখ মুজিব ও মোহাম্মদ তোয়াহা ফরিদপুর জেলে অনশন করতে শুরু করেন ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পরে এর সঙ্গে যুক্ত করেন তারা। সেই মর্মে মুজিব একটি টেলিগ্রাম পাঠান পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে। যুবলীগ অফিস তখন তালাবদ্ধ। নিতান্ত অর্বাচীন অবস্থায় আমি তার দপ্তর সম্পাদক ছিলাম—টেলিগ্রামটা আমার কাছে আসে। আমিই খবরটা লিখে দৈনিক আজাদে পৌঁছাই। খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। অনশনরত বন্দিদের অবস্থার অবনতি হলে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। তার পরও কতবার যে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, তার বিবরণ নিতান্তই একঘেয়ে লাগবে।

১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জেলের বাইরে থাকলে তিনি সারা প্রদেশ সফর করেছেন, জনসংযোগ করেছেন। তার সাংগঠনিক প্রতিভা ছিল অসাধারণ। ফলে আওয়ামী লীগ দ্রুত জনসাধারণের মধ্যে স্থান করে নেয়, মুজিবও কর্মী থেকে নেতায় উপনীত হন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচনে আগে বিরোধী দলগুলোর একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব উঠতে তিনি তার বিরোধিতা করেন, কেননা আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করতেন না। মওলানা ভাসানীকেও তিনি যুক্তফ্রন্ট গঠন থেকে বিরত থাকতে সম্মত করেছিলেন। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে একে ফজলুল হকের সঙ্গে মওলানা ভাসানী যুক্তফ্রন্ট গঠনে সম্মতিদান করেন। এতে মুজিব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। পরে সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করলে মুজিব তা মেনে নেন, কিন্তু এ-বিষয়ে তার দ্বিধা ও ক্ষোভের অবসান হয়নি। তাই পরে যখন কেন্দ্রীয় সরকারের কৌশলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়, তখন মুজিব খুশিই হয়েছিলেন।

যুক্তফ্রন্ট ভাঙার জন্য মুজিবের যে খানিক দায়িত্ব ছিল, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন আতাউর রহমান খান তার ‘ওজারতির দুই বছর’ (ঢাকা, ১৯৬৩) গ্রন্থে। এর সত্যতা নিরূপণ করা দুরূহ। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিত্ব পদে অধিষ্ঠিত হয়েও মুজিব তা ত্যাগ করেছিলেন সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের জন্য। এতে যেমন একটি প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, তেমনি তার লোভহীনতার পরিচয় মেলে।

১৯৫৫ সালে শেখ মুজিব পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তখন দেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হচ্ছিল। তিনি প্রদেশের নাম পূর্ব বাংলা রাখার পক্ষে, দেশের নাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার বিপক্ষে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান রাখার জন্য জোরালো বক্তব্য দেন। এ সময়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে যে মুসলিম শব্দ বর্জিত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে যুক্ত নির্বাচন প্রথার সুপারিশ করে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার পেছনেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্যে তিনি ক্রমশ পাকিস্তানের অখণ্ডতায় আস্থা হারিয়ে ফেলছিলেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে তার পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে বলে দাবি করা হয়েছে। সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক ‘নিউক্লিয়াস’ নামে একটি গোপন সংস্থা গঠন করে স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা গঠনের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, তার প্রতি তার সমর্থন ছিল বলেও দাবি করা হয়।

আইয়ুব খানের সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হলে বিরোধীদলীয় নেতারা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে মনঃস্থ করেন। আমরা আগেই দেখেছি, যুক্তফ্রন্ট গঠনে মুজিবের অনীহা ছিল, এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে সোহরাওয়ার্দীর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে তিনি এ ফ্রন্ট মেনে নেন। সোহরাওয়ার্দীর প্রতি অনুরাগ ও আনুগত্য থেকে তিনি যে নিজের ইচ্ছাকে অনেক সময়ে চেপে রেখেছেন, তা আমরা দেখেছি। পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মতবিরোধের ফলে মওলানা ভাসানী যখন ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন, তখন কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে মুজিবকে প্রকাশ্যে কিছু বলতে দেখা যায়নি। তবে ১৯৫৫ সালে সোহরাওয়ার্দী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী মন্ত্রিসভায় যোগদান করলে মুজিব তাকে অভিনন্দন জানাননি এবং সাক্ষাত্ হলে তাকে একরকম তিরস্কার করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরই কিন্তু শেখ মুজিব ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে সভাপতি করে। এই সময়ে পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে তার ভূমিকা এবং আরো পরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুবের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহর প্রার্থিতার পক্ষে তার প্রচারকার্য উল্লেখযোগ্য।

১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিব ছয় দফা দাবিনামা পেশ করেন। তার মতে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে এ দাবিনামা প্রণীত হয়। সরকার এর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থা গ্রহণ করলে মুজিব ছয় দফা নিয়ে পূর্ব বাংলার সর্বত্র জনসভা করে এর লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেন এবং এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। এরই মধ্যে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাজউদ্দীন আহমদ হন দলের সাধারণ সম্পাদক। মুজিবের জনপ্রিয়তা ও প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তা সত্ত্বেও সরকার তাকে বারবার গ্রেফতার করতে থাকে। তার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রজু হয় ১৯৬৮ সালে। আরো ৩৪ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে এ মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার অভিপ্রায়ে শেখ মুজিব যে আগরতলায় গিয়ে ভারতের সমর্থনলাভে ব্যর্থ হন এবং অনেক বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা যে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভে পরিকল্পনা করেছিলেন, তা আমরা অনেক পরে জানতে পারি। ঢাকা সেনানিবাসে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হয়। এর প্রতিক্রিয়া হয় সরকারে অভিপ্রায়ের সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানকেই বিদায় নিতে হয় আর মুজিব পরিণত হন বঙ্গবন্ধুতে।

নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আবার সামরিক শাসন জারি করেন। তবে তিনি একজন এক ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের অনুষ্ঠান করেন ১৯৭০ সালের শেষে। ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের স্বাক্ষরে দলের যে ‘নীতি ও কর্মসূচির খসড়া ঘোষণা’ প্রকাশিত হয়, তাতে প্রথমবারের মতো বলা হয় যে ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য।’ সমাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতিকে কাছাকাছি আনার চেষ্টা বলে একে দেখা যেতে পারে। তবে এ নির্বাচনকে শেখ মুজিব অভিহিত করেন ছয় দফার পক্ষে গণভোট হিসেবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত সাফল্য সবাইকে অবাক করে দেয়। আওয়ামী লীগও ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে। ক্ষমতাসীন চক্রের ক্ষমতা হস্তান্তরে অনিচ্ছা স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত করে দেন ইয়াহিয়া খান।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সময়

আপডেট টাইম : ১০:৫২:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ মার্চ ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালে, রাজনীতিতে তার সংশ্লিষ্টতা ১৯৩৯-এ। এই সময়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষে রাজনীতির ধারা প্রবাহিত হয়েছিল কয়েকটি ধারায়।  গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা এবং কর্মীদের সহিংস আচরণের ফলে সেই আন্দোলন প্রত্যাহার একটি বড় ঘটনা। কংগ্রেসের নেতৃত্বে আর যে-দুটি বড় আন্দোলন সংঘটিত হয়, তার একটি ছিল ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলন এবং অন্যটি ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলন।

ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের বদলে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলার প্রস্তাব কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করায় চিত্তরঞ্জন দাশ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ১৯২২ সালে মতিলাল নেহরুর সহযোগে স্বরাজ পার্টি গঠন করেন। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির লক্ষ্যে চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৩ সালে একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ বাংলার মুসলমান নেতাদের সঙ্গে বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদন করেন। ১৯২৫-এ চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে হিন্দু-মুসলমান মিলনের আশা সুদূরপরাহত হয়ে পড়ে। কাকতালীয়ভাবে এর পরের বছরেই সংঘটিত হয় বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। চিত্তরঞ্জনের রাজনৈতিক শিষ্য সুভাষচন্দ্র বসুও ছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপনের এবং হিন্দু-মুসলমানের একযোগে কাজের পক্ষে। ১৯৩৯-এ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেও গান্ধীর বিরোধিতার কারণে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কংগ্রেসের মধ্যেই ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করলে তিনি কিছুকালের জন্য কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন। তখন ফরোয়ার্ড ব্লক স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

তুরস্কের সুলতানের ভাগ্য নিয়ে অসন্তুষ্ট ভারতীয় মুসলমানরা অসহযোগ আন্দোলনের সমকালেই গড়ে তুলেছিল খিলাফত আন্দোলন। গান্ধীর সমর্থনলব্ধ খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন কিছুকাল হাত ধরাধরি করে চলেছিল, তারপর তা থেমে যায়। প্রায় পাঁচ বছর নিষ্ক্রিয়তার পরে ১৯২৪ সালে পুনরুজ্জীবিত হয় মুসলিম লীগ। ১৯৩০ সালে ইকবাল উপস্থাপন করেন ভারতীয় মুসলমানদের পৃথক বাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি। জিন্নাহ লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসন থাকা অবস্থায় ১৯২৪ সালে গৃহীত হয় লাহোর প্রস্তাব।

১৯২৫-এ নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ঘটে। অন্যদিকে স্বদেশী বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত কর্মীরা সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৩৯ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদের যুদ্ধ ছিল এদের গৌরবময় মুহূর্ত। তার পরও বাংলায় ও বাংলার বাইরে রাজকর্মচারী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা অব্যাহত থাকে।

কংগ্রেস ও বৃহত্তর হিন্দু সমাজের আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়লাভ করে একে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টি। মুসলিম লীগের সঙ্গে তিনি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন এবং ১৯৪০ সালে লীগের অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৪১ সালে মুসলিম লীগ এই কোয়ালিশন থেকে বেরিয়ে আসে। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার সঙ্গে মিলে তিনি আবার মন্ত্রিসভা গঠন করেন; কিন্তু গভর্নরের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে ১৯৪৩-এ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (ঢাকা, ২০১২) পড়ে আমরা জানতে পারি, ১৯৩৬ সালে তিনি স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত হন। তার ভাষায়—

তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। (পৃ. ৯)

এই পূর্ণচন্দ্র দাস ছিলেন বাঘা যতীনের সহকর্মী। মাদারীপুরে একসময় তিনি নিজেই একটি বিপ্লবী দল গড়েছিলেন। ১৯১৪ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। পরে তিনি ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন। আবার ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত কারাগারে থাকেন। শেখ মুজিব বলছেন, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে স্বদেশীদের সভায় তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকেন। ফলে তিনি মনে-প্রাণে ইংরেজ শাসনবিরোধী হয়ে ওঠেন এবং সুভাষচন্দ্র বসুর একজন ভক্তে পরিণত হন।

১৯৩৮ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে আসেন। তাদের আগমনের সম্ভাবনায় বেশ আলোড়নের সৃষ্টি হয়। সভা ও প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দলমত নির্বিশেষে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। পরে দেখা যায়, হিন্দু ছাত্ররা এই বাহিনী থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। কংগ্রেস থেকে নাকি তাদের নিষেধ করা হয়েছে এতে যোগ দিতে। এমনকি এদের বিরূপ সংবর্ধনা দেয়ারও একটা প্রস্তুতির খবর পাওয়া যায়। শেখ মুজিব লিখেছেন—

আমি এ-খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো—সবই চলত।

আমাদের নেতারা বললেন, হক সাহেব মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন বলে হিন্দুরা ক্ষেপে গিয়েছে। এতে আমার মনে বেশ একটা রেখাপাত করল। হক সাহেব ও শহীদ সাহেবকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। তার জন্য যা কিছু প্রয়োজন আমাদের করতে হবে। আমি মুসলমান ছেলেদের নিয়েই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম, তবে কিছু সংখ্যক নমঃশূদ্র শ্রেণীর হিন্দু যোগদান করল। কারণ, মুকুন্দবিহারী মল্লিক তখন মন্ত্রী ছিলেন এবং তিনিও হক সাহেবের সাথে আসবেন। শহরে হিন্দুরা সংখ্যায় খুবই বেশি, গ্রাম থেকে যথেষ্ট লোক এল, বিশেষ করে নানা রকম অস্ত্র নিয়ে, যদি কেউ বাধা দেয়! যা কিছু হয়, হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হতে পারত। [পৃ. ১১]

সৌভাগ্যবশত শান্তিপূর্ণভাবে সবকিছুর সমাধা হয়। এই উপলক্ষেই সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার পরিচয় এবং পত্র-বিনিময় ঘটে।

এই সময়েই ‘হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটু আড়াআড়ি’র পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল মালেক নামে শেখ মুজিবের এক সহপাঠীকে স্থানীয় হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে মুজিব তার দলবল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে ছেড়ে দিতে বলেন। শেষে দু-পক্ষ মারামারি লেগে যায়। মুজিবের দল ঘরের দরজা ভেঙে মালেককে উদ্ধার করে আনেন। স্বভাবতই এতে মামলা হয় এবং শেখ মুজিবকে সাতদিন জেলহাজতে থাকতে হয়। ‘এই আমার জীবনে প্রথম জেল।’

সময়ের উল্লেখ নেই, তবে ছুঁতমার্গের একটি ঘটনা যে তাকে খুব পীড়িত করেছিল, তা তিনি বলেছেন—

একদিনের একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমার সাথে কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকিমাও আমাকে ভালোবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম, ‘ননী কী হয়েছে?’ ননী আমাকে বলল, ‘তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পরে কাকিমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকে ঘর ধুতে বাধ্য করেছে।’ বললাম, ‘যাব না, তুই আসিস।’ আরো অনেক হিন্দু ছেলের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু আমার সহপাঠীরা আমাকে কোনোদিন এ কথা বলে নাই। অনেকের মা ও বাবা আমাকে আদরও করেছেন। এই ধরনের ব্যবহারের জন্য জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে বাঙালি মুসলমান যুবকদের ও ছাত্রদের মধ্যে। শহরে এসেই এই ব্যবহার দেখেছি। [পৃ. ২৩]

এই ভেদাভেদের জন্য পরে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তার মনে হয়েছে, হিন্দু-মুসলমান বিরোধের অন্তর্নিহিত কারণ যেমন করে রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষ বসু অনুধাবন করেছিলেন, আর কেউ তেমনটা করেননি।

সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সেই সামান্য পরিচয়ের সূত্র ধরে শেখ মুজিব ১৯৩৯ সালে কলকাতায় গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ফিরে এসে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠন করেন। ছাত্রলীগের সম্পাদক হন তিনি নিজে, মুসলিম লীগের সম্পাদক আরেকজন হলেও মূল কাজ তাকেই করতে হতো। মাদারীপুরেও মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয় তারই প্রচেষ্টায়।

১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাস করে শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন, থাকেন বেকার হোস্টেলে, সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন রাজনীতি নিয়ে। তখন লাহোর প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে, সুতরাং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়ে ওঠে তার ধ্যানজ্ঞান। পাকিস্তান বলতে তিনি বোঝেন দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র—একটি পুবে, অন্যটি পশ্চিমে। আবুল হাশিম তাদের বুঝিয়েছেন, ‘পাকিস্তান দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দু মুসলমানদের মিলানোর জন্য এবং দুই ভাই যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সুখে বাস করতে পারে তারই জন্য।’ এদিকে জিন্নাহর সঙ্গে মনোমালিন্যের ফলে পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপক একে ফজলুল হক মুসলিম লীগ ত্যাগ করে গেছেন। সুতরাং মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে শেখ মুজিবও তার বিরোধিতায় মুখর হন। তার পিতামাতা তাকে নিষেধ করেছিলেন হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে। সে-নিষেধ তিনি শোনেননি। এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন এই ভাষায়—

শেরেবাংলা মিছামিছিই ‘শেরেবাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়ই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন—দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব।’ এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাই বললাম। শুধু এইটুকু না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, মার খেয়ে। কয়েকবার মার খেয়ে আমাদের বক্তৃতার মোড় ঘুরিয়ে দিলাম। [পৃ. ২২]

পরে ফজলুল হকের আমন্ত্রণে ইসলামিয়া কলেজের কয়েকজন ছাত্র-প্রতিনিধিকে নিয়ে শেখ মুজিব দেখা করেন তার সঙ্গে। ফজলুল হক বলেন, তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করেননি, মুসলিম লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জিন্নাহ তার জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারেন না। ছাত্র-প্রতিনিধিরা ফজলুল হককে আবার মুসলিম লীগে ফিরে আসার অনুরোধ জানিয়ে বিদায় নেন। ফজলুল হক অবশ্য মুসলিম লীগে ফিরে আসেন, তবে ১৯৪৬ সালের আগে।

দুই.

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনা হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সহযোগিতা কামনা করে এবং যুদ্ধ শেষ হলে ভারতের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন বিবেচনার আশ্বাস দেয়।

১৯৪১ সালে কলকাতায় অন্তরীণ-অবস্থা থেকে পালিয়ে কাবুল ও মস্কো হয়ে সুভাষচন্দ্র বসু পৌঁছান বার্লিনে। সেখানে হিটলারের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়, তিনি বার্লিন বেতার থেকে ভাষণ দেন। এ-বছরেই জাপানে ব্রিটিশ ভারতীয় বন্দি সৈন্যদের নিয়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) গঠিত হয়। ১৯৪৩-এ সুভাষ জার্মানি থেকে সাবমেরিনে করে সাবাঙে পৌঁছান, সেখান থেকে যান টোকিওতে। তিনি তখন আইএনএর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, আজাদ হিন্দ ফৌজ সরকার গঠন করেন এবং জাপান থেকে ভারতের উদ্দেশে বেতার-ভাষণ দিতে থাকেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ একসময়ে ভারতের মাটিতে পৌঁছে যায় এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপগুলোকে স্বাধীন ঘোষণা করে তার শাসনভার গ্রহণ করে। দ্বীপ দুটির নতুন নামকরণ হয় যথাক্রমে শহীদ ও স্বরাজ। পরে অবশ্য আজাদ হিন্দ ফৌজ পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। জাপানের আত্মসমর্পণের পর এদের সব তৎপরতার অবসান হয়, ১৯৪৫-এর ১৭ আগস্ট সুভাষ অন্তর্ধান করেন। ভারতে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের বিচার হয়, তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন রশিদ আলীর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই সূত্র ধরে দেখা দেয় ভারতীয় নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ—তার ছোঁয়ায় বিমান বাহিনীতেও বিদ্রোহ ঘটে। তা ব্রিটিশ সরকারের জন্য বেশ বিব্রতকর হয়ে ওঠে।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে মুসলমানদের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪২ সালে চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারি দল থেকে পদত্যাগ করেন। এই বছরেই কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন গড়ে তোলে। গণ সত্যাগ্রহ ছিল এর একটা বৈশিষ্ট্য। পরের বছর মুসলিম লীগ ধ্বনি তোলে ‘ভাগ করো এবং দেশ ছাড়ো’।

১৯৪২ সালে বাংলায় দেখা দেয় ভয়াবহ মন্বন্তর। সরকারি হিসাবে ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়, বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা দাবি করা হয় ৩৫ লাখ।

খাজা নাজিমুদ্দিন তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী, সোহরাওয়ার্দী বেসামরিক সরবরাহমন্ত্রী—খাদ্যের দায়িত্ব তার। ১৯৪৫ সালের মার্চে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা আস্থা হারিয়েছেন গণ্য করে প্রদেশে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করা হয়। ১৯৪৬ সালের মার্চ-এপ্রিলে হয় প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচন। বাংলায় মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।

১৯৪৩ সালে ভারতীয় সমস্যার সমাধানে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ চেষ্টা করে। যুদ্ধের শেষে ভারতে আসে ক্যাবিনেট মিশন। তার প্রস্তাব যখন লীগ ও কংগ্রেস উভয় পক্ষ স্বীকার করে নেয়, তখন জওহরলাল নেহরুর এক বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব গ্রহণে আপত্তি জানায়। এই সূত্র ধরেই মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করে। সেদিন সূচনা হয় কলকাতার বৃহত্তম সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের। পরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী ও বিহারে। ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যে ভারতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে কংগ্রেস ও লীগকে সম্মত করায়। ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। নতুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগের সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে কংগ্রেস নেতারা দেশ বিভাগকেই সমাধান বলে মেনে নেন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত বিভাগ এবং সেই সঙ্গে বাংলা ও লাহোর বিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের বিরোধিতা করেন জিন্নাহ। তাকে যখন বলা হয়, যে-যুক্তিতে তিনি এই দুই প্রদেশ বিভাগের বিরোধিতা করছেন, তা ভারত বিভাগ সম্পর্কেও প্রযোজ্য, তখন তিনি চুপ করে যান। মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ এগিয়ে নিয়ে আসেন ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে। লীগ-কংগ্রেস মাউন্টব্যাটেন-পরিকল্পনা মেনে নেয়। মাউন্টব্যাটেন-পরিকল্পনা ঘোষণার আগেই সোহরাওয়ার্দী অখণ্ড সার্বভৌম বাংলা গঠনের প্রস্তাব করেন দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে। পরে লীগের সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের শরত্চন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায় মিলিতভাবে বাংলাকে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের বাইরে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে রাখার প্রয়াস চালান। শেষ পর্যন্ত তারা সফল হননি। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে ২০ জুন বঙ্গ বিভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ও ১৫ আগস্ট ভারতের রাষ্ট্রীয় সত্তার প্রতিষ্ঠা ঘটে।

একটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়নি। ১৯৪৬-এর ডিসেম্বরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির, বিশেষ করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার কমিউনিস্ট নেতাদের উদ্যোগে তেভাগা আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে কৃষকদের মধ্য থেকেও এর নেতাদের আবির্ভাব ঘটে। উত্তরে দিনাজপুর থেকে দক্ষিণে চব্বিশ পরগনা পর্যন্ত বাংলার ১৯টি জেলায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রাদেশিক পরিষদে সরকার একটি বর্গা বিল আনেন ১৯৪৭ সালে। তাতে আন্দোলন থেমে যায়, কিন্তু বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার আগে বঙ্গ বিভাগ ঘটে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে অনেক জায়গায় নতুন করে তেভাগা আন্দোলন দেখা দেয়। এই আন্দোলন দমিত হলেও কৃষকরা এর থেকে কিছু সুবিধা পেয়েছিল।

এখন আমরা ফিরে যাব শেখ মুজিবুর রহমানের কথায়। যেখানে তার প্রসঙ্গ থেমে গিয়েছিল, শুরু করতে হবে সেখান থেকে।

আবুল হাশিমের প্রেরণায় কলকাতায় শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের সার্বক্ষণিক কর্মী (‘হোলটাইম ওয়ার্কার’) হয়ে ওঠেন। আবুল হাশিমের কাছে তিনি রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো কেমন হবে, জনসাধারণকে সে-কথা জানানো প্রয়োজন, এই উপলব্ধি থেকে আবুল হাশিম একটি ম্যানিফেস্টো তৈরি করেন। তাতে জমিদারি প্রথা বিলোপের প্রতিশ্রুতি ছিল। এই ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিব খুব উত্সাহী ছিলেন। তবে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতাদের কারণে এটি প্রচারিত হতে পারেনি। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের উপদলীয় দ্বন্দ্বে মুজিব ছিলেন পুরোপুরি সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের পক্ষে। এই উপদলীয় দ্বন্দ্ব মুসলিম ছাত্রলীগেও সংক্রমিত হয়। এই দ্বন্দ্বে শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উপদল দুটিকে তিনি অভিহিত করেন প্রগতিবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বলে। তার দৃষ্টিতে—

শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় নাই, জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। কাউকে লীগে আসতে দিত না। জেলায় জেলায় খান বাহাদুররাই লীগকে পকেটে করে রেখেছিল। [পৃ. ১৭]

এখানে জনপ্রতিনিধিদের আচরণ সম্পর্কে তার এক অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করার মতো। নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা ব্যবস্থাপক পরিষদে এক ভোটে পরাজিত হয়েছিল। সন্দেহ করা হয়েছিল যে এমএলএ কেনাবেচা হচ্ছে। তখন তাদের ওপর নজরদারির দায়িত্ব শেখ মুজিব ও তার মতো আরো কয়েকজনের ওপর বর্তেছিল। তিনি লিখেছেন—

একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হলো। তিনি বারবার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে, কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে বললেন, ‘আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি, আমাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব।’ আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্য দলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের! এই ভদ্রলোককে একবার রাস্তা থেকে আমাদের ধরে আনতে হয়েছিল। শুধু সুযোগ খুঁজছিলেন কেমন করে অন্য দলের কাছে যাবেন। [পৃ. ৩৩-৩৪]

জনসাধারণের প্রতি শেখ মুজিবের মতো মানুষের অঙ্গীকার ছিল সুস্পষ্ট। তার পরিচয় পাওয়া যায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময়ে ত্রাণকার্যে, প্রাদেশিক নির্বাচনের কালে প্রচারকার্যে এবং কলকাতার সেই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিনগুলোতে বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করার কাজে। দুর্ভিক্ষের সময়ে শেখ মুজিব দিনভর লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন, রাতে কখনো হোস্টেলে ফিরে এসেছেন, কখনো মুসলিম লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে রাত কাটিয়েছেন। এরই মধ্যে ত্রাণকার্যে তিনি গোপালগঞ্জেও এসেছেন। নির্বাচনের সময় মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদেরও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে, তিনি পিছু হটেননি। দাঙ্গার সময়ে মুসলমান ছাত্রীদের উদ্ধার করা, আহতদের শুশ্রূষার ব্যবস্থা করা, এলাকা পাহারা দেয়া—এমন বহুবিধ দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়েছে। মুসলমানদের যেমন উদ্ধার করেছেন, তেমনি মুসলমান এলাকা থেকে হিন্দুদের উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছেন।

এসব নিয়ে দু-একবার আক্রান্তও হতে হয়েছে তাকে। তার কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত অনেক পরে নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে, সে-সময়ে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্র অনেকদিন ধরে তাকে বিপত্সংকুল এলাকা পার করে নিরাপদ অঞ্চলের সীমানায় পৌঁছে দিয়েছে। পরে, বিহার দাঙ্গার সময়েও, তিনি এবং তার বন্ধুরা দুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন এবং বঙ্গীয় সরকারের সহযোগিতায় অনেক বাস্তুত্যাগী পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

এখানে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে শেখ মুজিবের মনোভাবের বিষয়টা উদ্ধৃত করি—

আমাদেরও ইংরেজের বিরুদ্ধে একটা জাত ক্রোধ ছিল। হিটলারের ফ্যাসিস্ট নীতি আমরা সমর্থন করতাম না, তথাপি যেন ইংরেজের পরাজিত হওয়ার খবর পেলেই একটু আনন্দ লাগত। এই সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যদের নিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। মনে হতো, ইংরেজের থেকে জাপানই বোধ হয় আমাদের আপন। আবার ভাবতাম, ইংরেজ যেয়ে জাপান আসলে স্বাধীনতা কোনোদিনই দিবে না। জাপানের চীন আক্রমণ আমাদের ব্যথাই দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর থেকে সুভাষ বাবুর বক্তৃতা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। মনে হতো, সুভাষ বাবু একবার বাংলাদেশে আসতে পারলে ইংরেজকে তাড়ানো সহজ হবে। আবার মনে হতো, সুভাষ বাবু আসলে তো পাকিস্তান হবে না। পাকিস্তান না হলে দশ কোটি মুসলমানের কী হবে? আবার মনে হতো, যে নেতা দেশ ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন তিনি কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। মনে মনে সুভাষ বাবুকে তাই শ্রদ্ধা করতাম। [পৃ. ৩৫-৩৬]

যে-স্বপ্নের পাকিস্তান নিয়ে এত আবেগ, তারই রূপান্তর ঘটে গেল স্বপ্ন বাস্তবায়নেরও আগে। ১৯৪৭-এর এপ্রিলে দিল্লিতে জিন্নাহ ডাকলেন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের লীগ-দলীয় সদস্যদের কনভেনশন। বাংলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে শেখ মুজিবসহ দশ-পনেরো জন ছাত্রকর্মীও চললেন বিশেষ ট্রেনে। বাংলায় স্লোগান দিতে দিতে সভায় যোগ দিলেন তারা। জিন্নাহর নির্দেশে সেখানে ‘লাহোর প্রস্তাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে ছোট কিন্তু মৌলিক রদবদল করা হলো।’ যেখানে আগে ‘স্টেটস’ বলা হয়েছিল, সেখানে হলো ‘স্টেট’। এই প্রস্তাব উত্থাপন করলেন সোহরাওয়ার্দী। তাতে আবুল হাশিম ‘আর সামান্য কয়েকজন’ প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু প্রস্তাব পাস হয়ে গেল। শেখ মুজিব লিখেছেন—

১৯৪০ সালে লাহোরে যে প্রস্তাব কাউন্সিল পাস করে সে প্রস্তাব আইনসভার সদস্যদের কনভেনশনে পরিবর্তন করতে পারে কিনা এবং সেটা করার অধিকার আছে কি না, এটা চিন্তাবিদরা ভেবে দেখবেন। কাউন্সিলই মুসলিম লীগের সুপ্রিম ক্ষমতার মালিক। পরে আমাদের বলা হয়, এটা কনভেনশনের প্রস্তাব, লাহোর প্রস্তাব পরিবর্তন করা হয় নাই। [পৃ. ৬২]

এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার কথা হয়েছিল কিনা, তা জানা যায় না।

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস সম্পর্কে সোহরাওয়ার্দী কর্মীদের বলে দিয়েছিলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে যেন এই দিনটা পালন করা হয়। কোনো গোলমাল হলে মুসলিম লীগ সরকারের বদনাম হবে।’ আবুল হাশিমের বক্তব্য ছিল আরো তাত্পর্যপূর্ণ: ‘তোমাদের মহল্লায় মহল্লায় যেতে হবে, হিন্দু মহল্লায়ও তোমরা যাবে। তোমরা বলবে, আমাদের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, আসুন আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই দিনটা পালন করি।’ ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতারা এসব কথা শুনে মুসলিম লীগ অফিসে এসে দিনটি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করার প্রস্তাব দেন; কিন্তু কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার বিরোধিতা অপরিবর্তিত রয়ে যায়। তারা বলেন, এই কর্মসূচি হিন্দুর বিরুদ্ধে। ১৬ আগস্ট সরকারি ছুটি ঘোষিত হওয়ায় তাদের ক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পায়। শেখ মুজিব সাক্ষ্য দিয়েছেন, শান্তিরক্ষার জন্য সোহরাওয়ার্দী রাতদিন পরিশ্রম করেছেন।

সার্বভৌম বাংলার দাবি সম্পর্কে শেখ মুজিবের অভিমত, বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এই ফর্মুলা গ্রহণ করেছিল। মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন, নাজিমুদ্দিনও বলেছিলেন, যুক্ত বাংলা হলে হিন্দু-মুসলমানের মঙ্গলই হবে। এই ফর্মুলা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও শরত্ বসু জিন্নাহ ও গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। শরত্ বসুকে শেখ মুজিব উদ্ধৃত করেছেন এই বলে যে, জিন্নাহ বলেছিলেন, এতে মুসলিম লীগের আপত্তি নেই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। গান্ধী ও নেহরু শরত্ বসুকে পাঠিয়ে দেন সরদার প্যাটেলের কাছে, ‘খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন’ শরত্ বসুকে। শেখ মুজিব নিজে যে এ প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন, তা খুবই স্পষ্ট।

সিলেট গণভোটে বিজয়ী হয়ে কলকাতায় ফিরে শেখ মুজিব জানতে পারলেন, পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচনে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। দুদেশের মধ্যে সম্পদের ন্যায্য ভাগ-বাঁটোয়ারার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সবাই নেতা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। সোহরাওয়ার্দী কারো কাছে ভোট চাইলেন না, টাকা-পয়সা খরচ করতে অস্বীকার করলেন এবং কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিলেন না। তিনি জমিদারি প্রথা বিলোপ করে দেবেন—এ আশঙ্কায় নাকি সিলেটের ১৭ জন সদস্যের ১৪ জনই খাজা নাজিমুদ্দিনকে ভোট দেন। ফলে সেদিকেই পাল্লা ভারী হয়।

শেখ মুজিব এটাকে দেখেন সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের কিছুসংখ্যক নেতার ষড়যন্ত্র বলে। ভারতীয় লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, পূর্ব পাঞ্জাবের মাসদোত পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী হবে, শুধু পশ্চিমবঙ্গের লোক বলে সোহরাওয়ার্দীকে—যিনি বাংলাদেশের এমএলএদের দ্বারা সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত নেতা, তাকে—পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হতে হলে আবার নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে। শেখ মুজিবের মতে, পাকিস্তানে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সেই শুরু।

তিন

প্রথম থেকেই পাকিস্তানে গণতন্ত্রচর্চার অভাব ছিল। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নেতারা কোনো রকম বিরোধিতা সহ্য করতে পারতেন না। বিরোধী দলের সবাইকে রাষ্ট্রবিরোধী বলার প্রবণতা ছিল ব্যাপক। কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস এবং নবপ্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ—সবাই ছিল এই প্রচারণার শিকার। পূর্ব বাংলায় একটি উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয়ের পর যতদিন সম্ভব নির্বাচন বা উপনির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা হয়। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সম্পর্কে দেশের কোনো মতৈক্য গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে প্রথম গণপরিষদের পক্ষে সংবিধান প্রণয়ন সম্ভবপর হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতালিপ্সা ও সুবিধাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আঁতাত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জনপ্রতিনিধিদের অনৈতিক দলবদলের ফলে একের পর এক সরকার স্থিতিশীলতা হারাতে থাকে। এ সুযোগে গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়। সামরিক শাসন যে গণতন্ত্রের বিকল্প নয়, সে কথা বুঝতে মানুষের কিছু সময় লাগে। ততদিনে দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণে সমর্থ হয়।

কেন্দ্র ও প্রদেশের সম্পর্ক ছিল পাকিস্তানের একটি বড় সমস্যা। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি মুসলিম লীগ ভুলে গিয়েছিল ক্ষমতায় এসে। পাকিস্তানের দুই অংশের দূরত্বের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে শক্তিশালী কেন্দ্র অপরিহার্য, এমন একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা চলছিল। পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের দাবি যেমন ক্রমশ প্রবল হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকে এক ইউনিটভুক্ত করলে পাঞ্জাব ছাড়া বাকি তিন প্রদেশেই অসন্তোষ দেখা দেয়। অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব বাংলা যে বৈষম্যের শিকার, এ-সত্য ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ছয় দফা প্রস্তাব অভিহিত হয় পূর্ব বাংলার বাঁচার দাবি হিসেবে।

আরেকটি সমস্যা ছিল রাষ্ট্রে ধর্মের স্থান নিয়ে। পাকিস্তান গণপরিষদের উদ্বোধনী ভাষণে জিন্নাহ বলেছিলেন, ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, তার সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক থাকবে না। তার উত্তরসূরিরা সে কথা মানেননি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহারের খেলায় তারা মেতে ওঠেন। যে-জামাতে ইসলামী দল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল, তারাই এখন রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে দেশে ইসলামী শাসন প্রবর্তনের দাবিদার হয়ে উঠল। সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক লক্ষ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে তারা কাদিয়ানি-বিরোধী দাঙ্গা বাধিয়ে ফেলে। মুসলিম লীগের রাজনীতি অধিকতর সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করে। পূর্ব বাংলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যেসব দাঙ্গা ঘটে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি লোকজনের উসকানি ছিল।

১৯৫৬ সালে গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে দেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬২ সালের দ্বিতীয় সংবিধানের খসড়ায় পাকিস্তানকে কেবল প্রজাতন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়, পরে নানা আপত্তির মুখে ইসলামী প্রজাতন্ত্র কথাটা ফিরে আসে। এর ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যা ছিল, তা এই: রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলিম; কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না; অনুরূপ কোনো আইন বিদ্যমান থাকলে তা যথোপযুক্তরূপে সংশোধিত হবে; সরকারকে এসব বিষয়ে উপদেশ দেয়ার জন্য একটা ওলামা পরিষদ থাকবে। তবে এর ফলে আইনকানুনের ব্যাপক কোনো পরিবর্তন হয়নি, ওলামাদের ক্ষমতাও তেমন বৃদ্ধি পায়নি।

বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তান প্রথম থেকেই ছিল পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর অনুসারী। পরে দেশটি একাধিক মার্কিন সামরিক জোটের অংশীদার হয়। ভারতের সঙ্গে বৈরিতা ছিল পররাষ্ট্রনীতির একটা মূল স্তম্ভ। তা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের রূপ নেয় দুবার। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময়ে পূর্ব বাংলা অরক্ষিত থাকে বলে দেখা যায়। তাতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রবল হয়। শান্তি চুক্তির বলে যুদ্ধের অবসান ঘটে বটে, কিন্তু সে-চুক্তি পশ্চিম পাকিস্তানে অসন্তোষের কারণ হয় এবং শাসনকর্তার লৌহমানব ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে।

কিছুকাল পরে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেশকিছু সামরিক-বেসামরিক বাঙালি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এতে সরকারের অভিপ্রায়ের বিপরীত ফল ফলে। দেশব্যাপী গণ-অভ্যুত্থানের ফলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে বিদায় নিতে হয়, কিন্তু তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন আরেক সামরিক শাসকের কাছে। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে দেন এবং ‘একজন এক ভোটে’র ভিত্তিতে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের অনুষ্ঠান করেন। তাতে সরকারের অভিপ্রেত ফল লাভ হয়নি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ক্ষমতাসীন চক্রের অস্বীকৃতি শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় পূর্ব বাংলায় গণহত্যায়। তা অনিবার্য করে তোলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান তার পূর্বাঞ্চল হারায়, আমরা লাভ করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

ফিরে যাই ১৯৪৭ সালে। শেখ মুজিব যখন কলকাতার সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে বিদায় নেন, তখন তাকে সোহরাওয়ার্দী উপদেশ দিয়েছিলেন, পাকিস্তানে যেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা না হয়, তা দেখতে। সেখানে দাঙ্গা হলে ভারতে মুসলমানরা বিপদগ্রস্ত হবে। তাই ঢাকায় আসার পূর্বক্ষণে মুজিবের ভাবনা ছিল এ রকম: ‘পাকিস্তান হয়েছে, আর চিন্তা কি? এখন ঢাকায় যেয়ে ল ক্লাসে ভর্তি হয়ে কিছুদিন মন দিয়ে লেখাপড়া করা যাবে। চেষ্টা করব, সমস্ত লীগ কর্মীদের নিয়ে, যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়।’ সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় এসে তিনি শোনেন, শামসুল হকের উদ্যোগে মুসলিম লীগ কর্মীদের একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে একটি যুব সংগঠন করার উদ্দেশ্যে, তবে সরকার সেটা ভালো চোখে দেখছে না। মুজিব বললেন, ‘যুব প্রতিষ্ঠান একটা করা যায়, তবে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত হবে কিনা চিন্তা করে দেখেন। আমরা এখনো মুসলিম লীগের সভ্য আছি।’ শামসুল হক তাকে আশ্বস্ত করেন যে রাজনৈতিক সংগঠন গড়া হচ্ছে না। অধিবেশনে গিয়ে মুজিব মতপ্রকাশ করলেন যে এ প্রতিষ্ঠানের একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়। কিন্তু তার দৃষ্টিতে, কিছু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন কর্মী অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেয়ার প্রস্তাব করলেন। মুজিবের মনে হলো, তাহলে তো একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে যাবে। তার আরো মনে হলো, ‘দুই মাস হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন কোনো দাবি করা উচিত হবে না।’ বরঞ্চ এখন বিশেষ প্রয়োজন সাম্প্রদায়িক মিলনের কথা বলা। শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠার এই উদযোগের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক রাখলেন না। মোগলটুলিতে যেখানে মুসলিম লীগের অফিস ছিল, সেখানে যুবলীগেরও অফিস খোলা হয়েছিল। শেখ মুজিব ও তার বন্ধুরা সেখান থেকে যুবলীগের সাইনবোর্ড নামিয়ে দিলেন, তাদের জিনিসপত্র নিয়ে চলে যেতে বললেন। তা হওয়ার আগেই সে-বাড়ি তল্লাশি হলো, আইবির খাতায় তাদের নাম উঠল। যে অফিস থেকে পাকিস্তান আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে এখন গোপনে গোয়েন্দা পাহারা বসল। তার কারণ, তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমরা সকলে শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলাম।’ ১৫০ মোগলটুলিতে ন্যাশনাল গার্ডের দপ্তরও খোলা হয়েছিল, সরকারি চাপে সেই প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে গেল। ওদিকে কেন্দ্র থেকে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ভেঙে দেয়া হলো। ক্ষোভ ও বিস্ময়ের সঙ্গে মুজিব জানতে পারলেন, তারা আর লীগ কাউন্সিলের সদস্য নেই, প্রকৃতপক্ষে বিতাড়িত হয়েছেন মুসলিম লীগ থেকেই।

এসব কথা বিস্তারিত করে বললাম শুধু এটি বোঝাতে যে উপদলীয় সংঘাত সত্ত্বেও তখন পর্যন্ত শেখ মুজিব মুসলিম লীগকেই তার রাজনৈতিক সংগঠন ও কর্মক্ষেত্র বলে গণ্য করেছিলেন। তার সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি তখনো রাজনৈতিক নেতা নন, কর্মীমাত্র। আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, নইমউদ্দীন আহমদ—তুলনামূলকভাবে এরাই নেতৃস্থানীয়। এদের মধ্যে কাউকে তিনি চিনতেন, কাউকে চিনতেন না। বরঞ্চ কর্মীদের মধ্যে শওকত মিয়া, আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, দবিরুল ইসলাম, আবদুল হামিদ চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মতিন খান চৌধুরী—এদের অনেকের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিল। শেখ মুজিব বরাবর কলকাতাকে কেন্দ্র করে কাজ করেছেন। ঢাকায় তার কোনো নিজস্ব ভিত্তি ছিল না, সমর্থকগোষ্ঠীও ছিল না। তবে কলকাতা থেকে যেসব কর্মী দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, তাদের অনেকেই তাকে জানতেন। তিনি চেষ্টা করলেন সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমপন্থী সক্রিয় নেতাদের সঙ্গে মিশে কাজ করতে। এর প্রকৃত সূচনা ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। সরকার পৃষ্ঠপোষিত এবং শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বিপরীতপক্ষে সেদিন প্রতিষ্ঠিত হলো পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ—নইমউদ্দীন আহমদ হলেন তার আহ্বায়ক। অলি আহাদ ও মোহাম্মদ তোয়াহা ‘মুসলিম’ শব্দটি সংগঠনের নাম থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন, মুজিব তার বিরোধিতা করেন এই বলে যে তাহলে সরকার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নতুন সংগঠন সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। এ থেকেও শেখ মুজিবের তখনকার মানসিকতা সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। উল্লেখযোগ্য যে ওই মুসলিম শব্দ রাখার কারণেই অলি আহাদ এ সংগঠনে যুক্ত হতে অস্বীকার করেন। শেখ মুজিব জানিয়েছেন যে নইমউদ্দীন আহ্বায়ক হলেও সংগঠনের প্রায় সবকিছু তাকেই করতে হতো।

ফেব্রুয়ারি মাসেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যোগ দেয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ১১ মার্চে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সামনে পিকেটিং হয় এবং সেসব জায়গায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে, পরে কিছুসংখ্যক কর্মীকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। ছাত্রদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীর একটি চুক্তিস্বাক্ষর হলে চারদিন পর তিনি মুক্তি পান। ১৯ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর বক্তব্যের তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ যারা করেন, মুজিব ছিলেন তাদের একজন।

এরপর তাকে দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে ভূমিকা পালন করতে। ফলে প্রথমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন, পরে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তিনি জেলে থাকতেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় সরকারবিরোধী নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। কারাবন্দি শেখ মুজিবকে তার যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। তিনি মুক্তি পান জুলাই মাসে, আবার গ্রেফতার হন ডিসেম্বরে। এবার প্রায় আড়াই বছরের কারাবাস। তার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। শেখ মুজিব লিখেছেন যে সেই আন্দোলনের কিছু আগে বন্দি অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় আন্দোলন সম্পর্কে তিনি পরামর্শ দেন অলি আহাদ ও মোহাম্মদ তোয়াহাকে—তারা গোপনে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। নিজেদের মুক্তির দাবিতে শেখ মুজিব ও মোহাম্মদ তোয়াহা ফরিদপুর জেলে অনশন করতে শুরু করেন ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পরে এর সঙ্গে যুক্ত করেন তারা। সেই মর্মে মুজিব একটি টেলিগ্রাম পাঠান পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে। যুবলীগ অফিস তখন তালাবদ্ধ। নিতান্ত অর্বাচীন অবস্থায় আমি তার দপ্তর সম্পাদক ছিলাম—টেলিগ্রামটা আমার কাছে আসে। আমিই খবরটা লিখে দৈনিক আজাদে পৌঁছাই। খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। অনশনরত বন্দিদের অবস্থার অবনতি হলে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। তার পরও কতবার যে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, তার বিবরণ নিতান্তই একঘেয়ে লাগবে।

১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জেলের বাইরে থাকলে তিনি সারা প্রদেশ সফর করেছেন, জনসংযোগ করেছেন। তার সাংগঠনিক প্রতিভা ছিল অসাধারণ। ফলে আওয়ামী লীগ দ্রুত জনসাধারণের মধ্যে স্থান করে নেয়, মুজিবও কর্মী থেকে নেতায় উপনীত হন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচনে আগে বিরোধী দলগুলোর একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব উঠতে তিনি তার বিরোধিতা করেন, কেননা আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করতেন না। মওলানা ভাসানীকেও তিনি যুক্তফ্রন্ট গঠন থেকে বিরত থাকতে সম্মত করেছিলেন। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে একে ফজলুল হকের সঙ্গে মওলানা ভাসানী যুক্তফ্রন্ট গঠনে সম্মতিদান করেন। এতে মুজিব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। পরে সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করলে মুজিব তা মেনে নেন, কিন্তু এ-বিষয়ে তার দ্বিধা ও ক্ষোভের অবসান হয়নি। তাই পরে যখন কেন্দ্রীয় সরকারের কৌশলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়, তখন মুজিব খুশিই হয়েছিলেন।

যুক্তফ্রন্ট ভাঙার জন্য মুজিবের যে খানিক দায়িত্ব ছিল, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন আতাউর রহমান খান তার ‘ওজারতির দুই বছর’ (ঢাকা, ১৯৬৩) গ্রন্থে। এর সত্যতা নিরূপণ করা দুরূহ। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিত্ব পদে অধিষ্ঠিত হয়েও মুজিব তা ত্যাগ করেছিলেন সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের জন্য। এতে যেমন একটি প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, তেমনি তার লোভহীনতার পরিচয় মেলে।

১৯৫৫ সালে শেখ মুজিব পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তখন দেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হচ্ছিল। তিনি প্রদেশের নাম পূর্ব বাংলা রাখার পক্ষে, দেশের নাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার বিপক্ষে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান রাখার জন্য জোরালো বক্তব্য দেন। এ সময়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে যে মুসলিম শব্দ বর্জিত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে যুক্ত নির্বাচন প্রথার সুপারিশ করে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার পেছনেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্যে তিনি ক্রমশ পাকিস্তানের অখণ্ডতায় আস্থা হারিয়ে ফেলছিলেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে তার পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে বলে দাবি করা হয়েছে। সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক ‘নিউক্লিয়াস’ নামে একটি গোপন সংস্থা গঠন করে স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা গঠনের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, তার প্রতি তার সমর্থন ছিল বলেও দাবি করা হয়।

আইয়ুব খানের সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হলে বিরোধীদলীয় নেতারা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে মনঃস্থ করেন। আমরা আগেই দেখেছি, যুক্তফ্রন্ট গঠনে মুজিবের অনীহা ছিল, এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে সোহরাওয়ার্দীর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে তিনি এ ফ্রন্ট মেনে নেন। সোহরাওয়ার্দীর প্রতি অনুরাগ ও আনুগত্য থেকে তিনি যে নিজের ইচ্ছাকে অনেক সময়ে চেপে রেখেছেন, তা আমরা দেখেছি। পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মতবিরোধের ফলে মওলানা ভাসানী যখন ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন, তখন কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে মুজিবকে প্রকাশ্যে কিছু বলতে দেখা যায়নি। তবে ১৯৫৫ সালে সোহরাওয়ার্দী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী মন্ত্রিসভায় যোগদান করলে মুজিব তাকে অভিনন্দন জানাননি এবং সাক্ষাত্ হলে তাকে একরকম তিরস্কার করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরই কিন্তু শেখ মুজিব ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে সভাপতি করে। এই সময়ে পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে তার ভূমিকা এবং আরো পরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুবের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহর প্রার্থিতার পক্ষে তার প্রচারকার্য উল্লেখযোগ্য।

১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিব ছয় দফা দাবিনামা পেশ করেন। তার মতে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে এ দাবিনামা প্রণীত হয়। সরকার এর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থা গ্রহণ করলে মুজিব ছয় দফা নিয়ে পূর্ব বাংলার সর্বত্র জনসভা করে এর লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেন এবং এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। এরই মধ্যে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাজউদ্দীন আহমদ হন দলের সাধারণ সম্পাদক। মুজিবের জনপ্রিয়তা ও প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তা সত্ত্বেও সরকার তাকে বারবার গ্রেফতার করতে থাকে। তার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রজু হয় ১৯৬৮ সালে। আরো ৩৪ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে এ মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার অভিপ্রায়ে শেখ মুজিব যে আগরতলায় গিয়ে ভারতের সমর্থনলাভে ব্যর্থ হন এবং অনেক বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা যে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভে পরিকল্পনা করেছিলেন, তা আমরা অনেক পরে জানতে পারি। ঢাকা সেনানিবাসে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু হয়। এর প্রতিক্রিয়া হয় সরকারে অভিপ্রায়ের সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানকেই বিদায় নিতে হয় আর মুজিব পরিণত হন বঙ্গবন্ধুতে।

নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আবার সামরিক শাসন জারি করেন। তবে তিনি একজন এক ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের অনুষ্ঠান করেন ১৯৭০ সালের শেষে। ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের স্বাক্ষরে দলের যে ‘নীতি ও কর্মসূচির খসড়া ঘোষণা’ প্রকাশিত হয়, তাতে প্রথমবারের মতো বলা হয় যে ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য।’ সমাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতিকে কাছাকাছি আনার চেষ্টা বলে একে দেখা যেতে পারে। তবে এ নির্বাচনকে শেখ মুজিব অভিহিত করেন ছয় দফার পক্ষে গণভোট হিসেবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত সাফল্য সবাইকে অবাক করে দেয়। আওয়ামী লীগও ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে। ক্ষমতাসীন চক্রের ক্ষমতা হস্তান্তরে অনিচ্ছা স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত করে দেন ইয়াহিয়া খান।