হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে সাবালিয়া খাল দিয়ে নৌকা চালাইতাম। অনেক মাছ ধরতাম। সাঁতার কাটতাম। দূরে কোথায় গেলে এই সাবালিয়া খাল দিয়ে নৌকা নিয়ে যেতাম। অনেক আত্মীয় স্বজনও নৌকা নিয়ে আমাদের বাড়ি আসতেন।
আমি নৌকা নিয়ে বৈরান নদী হয়ে শহরের নিরালার মোড় যাতায়াত করতাম। কিন্তু সেই খালটি আজ নেই। আগের মতো সাঁতারও কাটতে পারি না। এই খাল দিয়ে নৌকাও চলে না। খালে মাছ তো দূরের কথা পানিই নেই। পানি বা থাকবে কি করে খালটি যে ভরাট হয়ে আছে। কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবালিয়া বটতলা এলাকার মিনহাজ আলী।
তিনি আরো জানান, খালের জায়গা দখল করে কেউ ঘরবাড়ি, কেউ দোকানপাট, আবার কেউ সীমানা প্রাচীর গড়ে তুলেছেন। অন্যদিকে খালের জায়গায় টাঙ্গাইল পৌরসভা ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণ করেছে। বর্তমানে খালের কোনো চিহ্ন নেই।
সাবালিয়া খালের মতো টাঙ্গাইল শহরের বেশিরভাগ খালই প্রভাবশালী দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে। বেশির ভাগ খালের চিহ্ন নেই বললেই চলে। কাগজ কলমে দাগ নম্বর, খতিয়ান, এস এ নম্বর ও সিএস নম্বর থাকলেও বাস্তবে তা দেখানো খুব কষ্টকর। ফলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। একটু বৃষ্টি হলেই কোনো কোনো এলাকায় জলবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এসব খাল উদ্ধার করে পানি প্রবাহের দাবি জানিয়েছেন শহরবাসী। শহরের খালের সংখ্যা ও পরিমাপ সম্পর্কে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) উপমা ফারিসা কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) টাঙ্গাইলের উর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা গৌতম চন্দ্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গাইল পৌরসভার ১৮টি ওয়ার্ডে ২৭টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডের দেওলা ধুল মৌজায় ২৪২ ও ৪৯৯ দাগের দেওলা হতে কান্দিলা পর্যন্ত, ২ নম্বর ওয়ার্ডের এনায়েতপুর মৌজায় ১৮৬০ দাগের মাগুরাটা হতে বৈল্লা হাটখোলা হয়ে হাজেরা ঘাট পর্যন্ত, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাগমারা, পশ্চিম আকুর টাকুর পাড়া মৌজার ৩২২৬, ১০৯৩, ৯০০ দাগের ও ৫৭ সিএস’র লৌহজং নদী হতে বেড়াডোমা পর্যন্ত, বেলকুচি রোড হতে জালাল পন্ডিতের বাড়ি পর্যন্ত, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বেড়াডোমা, দিঘুলিয়া, পাড়দিঘুলিয়া মৌজার ২০৮, ৩৪১, ৮ সিএস এর লৌহজং নদী হতে সাটিয়া পর্যন্ত, বেড়াডোমা নদী হতে কাগমারা পর্যন্ত, দিঘুলিয়া ব্রিজের ঢাল হতে সারুটিয়া পর্যন্ত, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাকরাইল, কালিপুর মৌজার ১৮০ আরওআর এর লৌহজং নদী হতে সাকরাইল পর্যন্ত, সিএস ১৩৩৪ ও হাল ১৩২৯ এর সারাইল নদী হতে সন্তোষ পর্যন্ত, ৫০০ বিএসের সানা মিয়ার বাড়ি হতে বকুল তলী রোড পর্যন্ত, ৫৩৫, ৫৩৮ ও ৯০৭ বিএসের বটতলা হতে সেন বাড়ি পর্যন্ত, ৪২৫ বিএসের মতিন চাকলাদারের বাড়ি হতে বেলতা ভাঙ্গাবাড়ি পর্যন্ত রয়েছে।
১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিশ্বাস বেতকার মৌজার ৮১৫, ৮২০, ৮৩৮, ৮৬১, ৮৬৩ এসএ’র সুতার পাড়া হতে বোরাই বিল পর্যন্ত, ৩০০, ২৩৬ এসএ’র মুন্সিপাড়া মসজিদ হতে প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবালিয়া, কোদালিয়া মৌজার ২৯০, ২৪৬ সিএসের সাবালিয়া বটতলা হতে সদর হাসপাতাল পর্যন্ত, ৬০, ১২১, ১১৭ এসএ’র সদর হাসপাতাল হতে কোদালিয়া শেষ সীমানা পর্যন্ত। এছাড়া ১০, ১২, ১৩ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো খাল নেই।
টাঙ্গাইল পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাগমারা, পশ্চিম আকুর টাকুর পাড়া মৌজায় ৩২২৬, ১০৯৩, ৯০০ দাগের ও ৫৭ সিএস’র লৌহজং নদীর বেলকুচি রোড হতে জালাল পন্ডিতের বাড়ি পর্যন্ত, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কান্দাপাড়া, কচুয়াডাঙ্গা, বেড়বুচনা মৌজার ৩২৮ সিএসের বেড়াবুচনা পানির ট্যাংক হতে লৌহজং পর্যন্ত, ২৩৩ সিএসের দক্ষিণ বেড়াবুচনা মেইন রোড হতে অলোয়া পাইকোস্তা পর্যন্ত ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবালিয়া, কোদালিয়া মৌজার ২৯০, ২৪৬ সিএসের সাবালিয়া বটতলা হতে সদর হাসপাতাল পর্যন্ত, ৬০, ১২১, ১১৭ এসএ’র সদর হাসপাতাল হতে কোদালিয়া খালের তেমন কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
এদিকে সাবালিয়া খালটি টাঙ্গাইল শহরের ময়মনসিংহ সড়কের বায়তুন নূর জামে মসজিদের পাশে সাবালিয়ার আকম মাসুদ মিয়ার বাসার পাশ থেকে সাবালিয়া পাঞ্জাপাড়া হয়ে সাবালিয়া বটতলা কালভার্ট হয়ে বৈরান নদীতে সংযোগ হয়েছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে একটি প্রভাবশালী মহল প্রথমে ময়লা-আর্বজনা দিয়ে খালটি কৌশলে ভরাট করে। এরপর প্রথমে টিন দিয়ে সীমানা প্রাচীর গড়ে তুলে। কিছুদিন যাওয়ার পর সেখানে ইট দিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেন। আর কয়েক বছর যাওয়ার পর সেই সীমানা প্রাচীর ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করে। কিছু জায়গায় আবার টাঙ্গাইল পৌরসভা থেকে ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণ করে খালটিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছেন। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নেই। ফলে একটু বৃষ্টি হলে বসতবাড়িসহ রাস্তায় পানি জমে থাকে। তাই সাবালিয়া খালটির জায়গা চিহ্নিত করে খালটি পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
সরেজমিনে জানা গেছে, সরকারি কুমুদিনী গেট টু সুরুজ সড়কের সাবালিয়া বটতলা এলাকায় খালের ওপর কালভার্ট থাকলেও দক্ষিণ পাশে খাল চেনার কোনো উপায় নেই। যে যার মতো পেরেছেন খালের জায়গা দখল করেছেন। কালভার্টের দক্ষিণ পাশে রফিকুল ইসলাম নামে একজন সীমানা প্রাচীর ও বহুতল ভবন নির্মাণ করায় খালের কোনো চিহ্ন নেই।
শুধু রফিকুল ইসলাম নয়, সাইদুর রহমান, ইদু মিয়া, মো. হারুন মিয়া ও জাহাঙ্গীর মিয়ার মতো অনেকেই খালের জায়গা দখল করে সীমানা প্রাচীরসহ বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। এছাড়াও খালের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করেছে টাঙ্গাইল পৌরসভা। রাস্তার পাশ দিয়ে ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে বেলকুচি রোড হতে জালাল পন্ডিতের বাড়ি পর্যন্ত, মুন্সিপাড়া মসজিদ হতে প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত, সাবালিয়া বটতলা হতে সদর হাসপাতাল হয়ে কোদালিয়া খালের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
পৌরসভার কচুয়াডাঙ্গা এলাকার রহিম মিয়া বলেন, কচুয়া ডাঙ্গা বেড়াবুচা খাল দিয়ে প্রায় ৪০ বছর আগে ধানের নৌকা, পাটের নৌকা নিয়ে আমরা করটিয়া হাটে যাইতাম। সেই খাল ভরাট হওয়ার কারণে আজ খালের কোনো চিহ্ন নেই। প্রবাবশালীরা যে যার যার মতো খালের জায়গা দখল করে বসতবাড়ি করেছে। অন্যদিকে খালের জায়গা দিয়ে পৌরসভা রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ করেছে। লৌহজং নদীর মতো শহরের খালগুলো উদ্ধারের দাবি জানাচ্ছি ডিসির কাছে।
বেড়াবুচনা এলাকার মো. হাসেম মিয়া বলেন, আমাদের এলাকার খালটি দিন দিন তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে। প্রভাবশালীরা খালটি দখল করেছে। একমাত্র প্রশাসনই পারবে খালটি উদ্ধার করতে। এছাড়া অন্য কেউ খালটি উদ্ধার করতে পারবে না।
টাঙ্গাইল নদী, খাল, বিল, জলাশয় ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক রতন সিদ্দিকী বলেন, জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজসে অনেক আগে থেকে খালের জায়গা ভরাট করে দখল হয়ে আসছে। যে কারণে বর্তমান সময়ে কাগজ কলমে খাল থাকলেও বাস্তবে দেখা খুব মুশকিল হয়ে পড়েছে।
টাঙ্গাইল পৌরসভার কাউন্সিলর সাজ্জাদ আহম্মেদ সবুজ বলেন, পৌরসভার রাস্তা ও ড্রেন সঠিক জায়গাতেই করা হয়েছে। কোনো খালের ওপর বা খালের জায়গা দখল করে ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণ করা হয়নি।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানের লৌহজং নদী উদ্ধার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে শহরের খালগুলো খনন করা হবে।
টাঙ্গাইলের ডিসি মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, খালগুলোর অবৈধ দখল নিয়ে যাচাই-বাছাই করে খাল উদ্ধারের প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।