একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার দায় অস্বীকার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিয়ে ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি করায় পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত এবং পাকিস্তানি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
অন্যদিকে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর এবং মুহম্মদ জমির বলেন, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়টি সর্বশেষ ধাপ, সেই ধাপে যাওয়ার আগে বিশ্বে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতা সম্পর্কে আরও বেশি করে প্রচার চালানো দরকার। তারা বলেন, পাকিস্তান মূলত সূর্যের মতো সত্যকে অস্বীকার করেছে, এ কারণে তাদের মিথ্যাচারের মুখোশ খুলে দিতেই কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা দরকার।
মঙ্গলবার সঙ্গে আলাপকালে তারা এসব কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানান, পাকিস্তান গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে আর পাকিস্তানে পাঠানো হবে না। নিচে সমকালকে দেওয়া বিশিষ্টজনের বক্তব্য তুলে ধরা হলো।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী :বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, পাকিস্তানে যারা বর্তমানে সরকারে আছেন তারা একাত্তরে গণহত্যার দায় অস্বীকার করে ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার করছেন, যা তাদের সুস্থ এবং মানবিক বোধের প্রকাশ নয় বলে বিবেচনা করা যায়। তাদের মনে রাখা উচিত, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, আমলারা পরে যে বই লিখেছেন তাতেই একাত্তরে গণহত্যার বিবরণ দিয়েছেন। যেমন সিদ্দিক সালিকের বই, খাদিম জাহান রাজার বই, এমনকি নিয়াজি এবং রাও ফরমান আলীও যে বই লিখেছেন সেখানে গণহত্যাসহ বাঙালির ওপর তাদের নিবর্তনের কথা স্বীকার করেছেন।
পাকিস্তান সরকার যে হামুদুর রহমান কমিশন গঠন করেছিল সেই কমিশনও তো গণহত্যার দায়ে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করেছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিকভাবেও একাত্তরে গণহত্যার বিষয়টি স্বীকৃত এবং প্রামাণিক তথ্য ও দলিলসহ গ্রন্থিত। এখন দায় এড়ানো নয় বরং পাকিস্তানকে দায় স্বীকার করে নিষ্ঠুরতম অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। এটাই হবে শোভন, দায় এড়িয়ে পাকিস্তানের বর্তমান সরকার বরং পাকিস্তানকেই হেয় করছে।
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সমকালকে বলেন, পাকিস্তান জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছে ১৯৭১ সালে, এটা সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়ের মতো সত্য। পাকিস্তান এ সত্য অস্বীকার করে নিজেদের ঘৃণ্য মানসিকতাকেই আরও একবার তুলে ধরল। তিনি বলেন, এখন দাবি হচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হোক। একটি সন্ত্রাসী ও বর্বর রাষ্ট্র হিসেবে সার্ক, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে পাকিস্তানকে বহিস্কার করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হোক।
তিনি স্পষ্ট করে জানান, একাত্তরে গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্ক ট্যুরসহ অন্যান্য শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমে পাকিস্তানে আর কোনো শিক্ষার্থী পাঠানো হবে না। তিনি আরও বলেন, এখন থেকে আর কোনো পাকিস্তানি পণ্য বাংলাদেশের মানুষের ব্যবহার করা উচিত নয়। তাদের সব পণ্য বর্জন করা উচিত।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন :একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সমকালকে বলেন, গণহত্যার দায় অস্বীকার করে পাকিস্তান ১৯৭১ সালের চরিত্রটি আবারও নতুন করে উন্মোচন করল। এর মধ্য দিয়ে এক অর্থে লাভই হয়েছে। কারণ আমাদের এখানে অনেক আধা বাঙালি আছেন যারা পাকিস্তানি চিন্তা-চেতনার অনুসারী, যাদের আমরা বিএনপি করতে দেখি, তারা এখন বুঝতে পারবেন, পাকিস্তান আসলে কী। শুধু তাই নয়, যারা পাকিস্তানি মানসিকতার, তাদের ভেতরে বিবেক থাকলে বুঝতে পারবেন, আসলে পাকিস্তান কী ধরনের রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানিরা কী ধরনের মানুষ।
বাংলাদেশে যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী যুদ্ধাপরাধী আছে, তারাও এটা বলে থাকে যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধাপরাধ হয়নি। তাদের পিতৃভূমি পাকিস্তানও একই কথা বলবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু জন্ম-মৃত্যুর মতোই ধ্রুব সত্য হচ্ছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের ভয়ঙ্কর গণহত্যা ও নির্যাতনের বিষয়টি। এই সত্য পৃথিবী যতদিন আছে সত্যই থেকে যাবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যারা পাকিস্তানের সরকারে আছে তারা শিষ্টাচার বোঝে না, তারা শুধু প্রতিরোধই বোঝে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ, এখন আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তান যে যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী একটা দেশ তা জোরালোভাবে তুলে ধরা হোক। একই সঙ্গে প্রয়োজন পাকিস্তান যে প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ দেয়নি তা আদায় করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করা। এ ছাড়া ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করার জন্য পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে বহিষ্কারের দাবিও বাংলাদেশের তোলা উচিত।
কারণ, এটা নিয়ম যে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার হতে হবে। এই বিচার না হলে বাঙালিদের প্রতি অন্যায় হবে। পাকিস্তান যেহেতু কূটনৈতিক শিষ্টাচার মানে না, সে কারণে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। প্রয়োজনে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর :সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনু বিভাগের প্রাক্তন মহাপরিচালক হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, পাকিস্তান অস্বীকার করলেও দালিলিক প্রমাণে জ্বলজ্বলে সত্য হচ্ছে ১৯৭১ সালে গণহত্যার দায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীরই ছিল। এই গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে পর্যাপ্ত দলিল রয়েছে। দায় অস্বীকার করে পাকিস্তান সবার সামনে নিজেদেরই হেয় করছে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়টি সর্বশেষ ধাপ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী এবং সার্কের কারণে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এখন দরকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের গণহত্যার বিষয়টি আরও বিস্তারিত ও জোরালোভাবে তুলে ধরা। বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিবাদ আরও কঠোর হওয়া।
সূত্র : সমকাল