হাওর বার্তা ডেস্কঃ এরপর ইরমার সাথে আমার তেমন কথাবার্তা হত না। ইরমা আমাকে প্রথমই বলেছিল তার জীবনকাহিনি শোনার পর তার প্রতি আমার ভালোবাসা থাকবে না। সে বাস্তববাদী তাই হয়ত বুঝতে পেরেছিল আমার ঠুনকো ভালোবাসা বেশিদিন টিকবে না। তার প্রতি ভালোবাসা না থাকলেও তার জন্য মায়া হয়। তার জীবনটা দুঃখ কষ্টে ভরপুর। ইরমার চোখের জল আমাকে ব্যথিত করে। তবুও অবচেতন মন চাচ্ছে না তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখি।
কয়েকদিন পর সে নিজেই ম্যাসেজ দিলো।
কি খবর?
-ভালো।
তোমার কি খবর?
-ভালো।
আজকাল তোমার কোনো খবর পাওয়া যায় না?
-আসলে একটু বিজি আছি।
-চলো একদিন ঘুরতে যাই।
-না আমার অফিসে কাজ আছে। ফ্রি থাকলে তোমাকে জানাব।
সে আর কথা বাড়াল না।
মাসখানেক পর, কোম্পানিতে কাজ কমে যাওয়ায় কর্মী ছাঁটাই চলছে। এর মধ্যে আমার নামও আছে। যেদিন দেশে চলে যাব সেদিন সকালে ইরমা ম্যাসেজ দিয়ে জানতে চায় আমি কোথায় আছি?
জবাবে বলি, কোম্পানি দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আর হয়ত সিঙ্গাপুরে আসা হবে না।
আমার কথা শুনে কল ব্যাক করল। কল রিসিভ করতেই সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, তুমি দেশে চলে যাচ্ছ অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না? আমি তার কথার জবাব দিতে পারলাম না। আসলে তার কথা আমার মনেই ছিল না।
সে বলল, শোনো আমি বিমানবন্দরে আসছি। প্লিজ আমার জন্য অপেক্ষা করো।
আমার বিমান ছাড়ার সময় তিনটে?
-আমি এখনই বের হচ্ছি। সে আর কথা বাড়াল না।
কেন জানি মনে হচ্ছে তার সাথে আমি এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছি। অথচ এতদিন তা অনুভব হয়নি। এখন সে কল দেওয়াতে এক ধরনের মায়া অনুভব করলাম। এ জীবনে আমাদের আর দেখা হবে না। ভাবতেই বুকের গহীনে পুঞ্জীভূত ভালোবাসা বের হয়ে এল।
আমি চোখ বন্ধ করে ভাবছি কী করা যায়। শেষেবারের মতো তার সাথে দেখা করব! হ্যাঁ অন্ততপক্ষে তাকে বুকে জড়িয়ে তার প্রতি আমার ভালোবাসা প্রকাশ করে যাই। তাকে জড়িয়ে ধরার সুখ স্মৃতি সঙ্গে করে নিয়ে যাই। ট্যাক্সি কল করে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে বের হই।
বিমানবন্দরে ভেতর আমি দাঁড়িয়ে আছি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পুরো এলাকা তবুও আমি ঘামছি। সিঙ্গাপুরে বিমানবন্দরের পরিবেশটা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে ভেতরে প্রবেশ করতে বাংলাদেশের মত দুইশ টাকা ফি প্রদান করতে হয় না। বিমানবন্দরের বাহিরে অপেক্ষমান আত্মীয় স্বজনের জটলা নেই। বেশিরভাগ যাত্রীই একা। কেউ কাউকে বিদায় জানাতে আসে না। তাই বিমানবন্দরের ভেতরটা মোটামুটি ফাঁকাই থাকে।
মানুষ আসছে আর ডিজিটাল মিশিনে নিজের মালামাল বুকিং করে বোডিং পাশ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। কিছু যুবক যুবতী কয়েকটি চেয়ার দখল করে বসে গল্পগুজব করছে। মনে হচ্ছে কোথাও ভ্রমণে যাবে। কেউ কেউ ট্রলিতে মালামাল নিয়ে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছে৷
আমি একটি ফাঁকা টুলে বসে ইরমার কথা ভাবছি। মেয়েটি কি আমাকে ভালোবাসে? আমার চলে যাবার কথা শুনে সে পাগলের মতো আচরণ করছে কেন? আর এভাবে বিমানবন্দরে ছুটে আসার মানে কি?
তাকে স্রেফ বন্ধু ছাড়া অন্যকিছু ভাবি না। হ্যাঁ একটা সময় ভালোবাসি বলেছিলাম, সেটা ছিল আমার আবেগ। তার জীবনের কাহিনি শোনার পর সব আবেগ বাতাসে উড়ে গেছে। তার প্রতি ভালোবাসা নাই, এজন্যই হয়ত আমি যে চলে যাচ্ছি তাকে তা জানানো গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি। তার জীবন কাহিনি শোনার পর থেকে বন্ধু হিসেবেই কথা বলেছি। কোনোদিন ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করিনি।
আমার আর সিঙ্গাপুরে আসা হবে না। অনেক দিনই তো সিঙ্গাপুরে থাকলাম। এবার দেশে ফেরার সময়। এখানে এসে তেমন সুবিধা করতে পারিনি। একাডেমিক সার্টিফিকেট না থাকায় কর্মক্ষেত্রে তেমন উন্নতি করতে পারিনি। যা ইনকাম করেছি তা দিয়ে দেশে ছোট খাটো ব্যবসা করে দিন কাটিয়ে দেব।
আমার পরিবারে একমাত্র সন্তান আমি। মা ইদানীং বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকেন। তাই বাবা চাচ্ছেন আমি যেন দেশে ফিরে বিয়ে করি। মা অন্ততপক্ষে একজন সেবা করার লোক পাবে। এখন সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। আমার হবু বউ অসুস্থ মায়ের সেবা করে কি না। মানুষ ভাবে এক হয় আরেক।
নানা কিছু ভাবছি এমন সময় আমার সামনে এসে ইরমা দাঁড়াল। তার চোখ দুটি ছলছল করছে। মনে হচ্ছে সে যেকোন সময় কেঁদেই দেবে। আমি তার চোখের উপর থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছি না। তার চোখে এমনকিছু দেখতে পাচ্ছি যা আমাকে আটকে রেখেছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার চুলের গন্ধ আমাকে বিমোহিত করে। এই প্রথম কোনো মেয়েকে বুকে নেওয়ার অভিজ্ঞতা হলো।
আশপাশের চোখগুলো আমাদের দিকে নিবন্ধ। আমি তাদের পাত্তা না দিয়ে তার চুলের ঘ্রান নিচ্ছি। হঠাৎ মনে এ আমি কি করছি। ইরমা তো আমার বন্ধু ছাড়া কিছুই নয়। নিজেকে মুক্ত করে বললাম, একি করছো? আর তুমি এভাবে কান্না করছো কেন?
হাতের টিসুতে চোখের জল মুছে সে বলল, আমাকে তোমার সাথে নেওয়া যায় না।
একি বলছে মেয়েটি। আমার সাথে তাকে নিয়ে কি করব। সবাই বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর ও বলছে সাথে নেওয়া যায় না। তাকে আমি কি পরিচয়ে দেশে নিয়ে যাব।
না তাতো সম্ভব নয়।
তুমি যদি আমার আপন ভাই হতে তাহলে আমাকে এভাবে একা রেখে যেতে পারতে?
ইরমার কথা শুনে আমি থমকে গেলাম। সে আমাকে ভাইয়ের আসনে বসিয়েছে আর আমি এগুলো কি ভাবছিলাম তাকে নিয়ে। এবার আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। বোন বলে তাকে আবারো জড়িয়ে ধরলাম। এবার তার থেকে ভালোবাসার ঘ্রান পাচ্ছি। ঘ্রানটি স্নিগ্ধ ও কোমল। বোনদের শরীরের এই ঘ্রান ভাইদের স্বর্গীয় সুখ দেয়।
এই প্রথম আমি কাউকে ছেড়ে যাবার বেদনায় কাঁদছি।
আমি সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। পিছন থেকে ইরমা তাকিয়ে আছে। তার চোখ থেকে অফুরন্ত ভালোবাসা ঠিকরে পড়ছে। মনে মনে বললাম ইরমা ভালো থেকো। বাস্তবতা বড়ই কঠিন। এই জীবনে হয়ত আমাদের আর দেখা নাও হতে পারে।